সাঈদ আহসান খালিদ: জুডিসিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার ফলাফলে মেধার ক্রমতালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অবস্থান কিংবা নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থীর মোট সংখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের যে চেষ্টা দৃশ্যমান হচ্ছে সেটি ভ্রান্ত, আঞ্চলিকতা তাড়িত, কূপমণ্ডূকতাপ্রসূত, এবং বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার বরখেলাপ। প্রতিযোগিতামূলক কোন পরীক্ষায় নিজ বিভাগের অগ্রজ, অনুজ বা বন্ধুরা উত্তীর্ণ হলে সেটি নিশ্চয় ব্যক্তিগত ও সামাজিক আনন্দ, তৃপ্তি ও গৌরবের। কিন্তু সেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ও মর্যাদার পরিমাপক বানানো এবং সেই মেজারমেন্ট স্কেলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রয়াস একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি এবং বর্ণবাদী আচরণ।
প্রথমত, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ কোচিং সেন্টারের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে; বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা ও উদ্দেশ্যের ব্যাপ্তি বিস্তৃত ও বিপুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে আইনের ডিগ্রিধারীদের সবাই একই পেশায় যাবে- সেটি সম্ভব নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ শিক্ষার্থীদের কোন নির্দিষ্ট পেশার জন্য প্রস্তুত করার ‘ট্রেনিং সেন্টার’ নয়।
আইন বিভাগ শিক্ষা কেন্দ্র, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মূল কাজ হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মনে আইনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা। আইন কী? আইন কীভাবে কাজ করে? সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর বিদ্যমান বিরোধ আইনে কীভাবে নিষ্পত্তি হবে? আইনগত গবেষণা কীভাবে করতে হয়? কীভাবে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে হয়? যে কোন বিষয়কে কীভাবে আইনের যুক্তিবোধ (Legal Reasoning) দিয়ে বিশ্লেষণ করতে হয়, এবং আইন সংক্রান্ত যে কোন পেশায় সারভাইভ করার বেসিক ও প্র্যাকটিক্যাল দক্ষতা অর্জন- মোটাদাগে এগুলোই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা যার যার এক্সপার্টাইজ এবং অভিরুচি অনুসারে কর্মক্ষেত্র বেছে নেবে, কেউ আইনজীবী হবে, কেউ বিচারক, কেউ আইন শিক্ষক, কেউ আইন কর্মকর্তা, কেউ আইন গবেষক প্রভৃতি। আবার সবাই যে আইন বিষয়ক ক্যারিয়ারই গঠন করে- সেটিও নয়। এই বৈচিত্র্য স্বাভাবিক, কাঙ্ক্ষিত, এবং রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয়।
তাই কোন বছরে নির্দিষ্ট একটি পেশার নিয়োগ পরীক্ষায় নির্বাচিত আইনের গ্র্যাজুয়েটদের সংখ্যা বা ক্রমতালিকায় অবস্থান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শ্রেষ্ঠত্বের ক্রম দাবি ও নির্ধারণ অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন, এবং সেই পেশার বাইরে অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত আইনের গ্র্যাজুয়েটদের জন্য অবমাননাকর।
দ্বিতীয়ত, জুডিসিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার মেধাতালিকা মানেই সেটি বাংলাদেশের আইনের গ্র্যাজুয়েটদের সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকা নয়। সেটি শুধুই সেই নির্দিষ্ট পরীক্ষার মেধাতালিকা।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অনেক শীর্ষ মেধাবী শিক্ষার্থী এই পরীক্ষায় অংশই নেয় না তাদের নিজস্ব ভিন্ন ক্যারিয়ার প্ল্যান এবং ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে। অনেকে জুডিসিয়াল সার্ভিসে নিয়োগ পেয়েও সেটি ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছে- এমন উদাহরণও অপ্রতুল নয়। তাদের বেশিরভাগ পরবর্তীতে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে। তাই, জুডিসিয়ারি পরীক্ষার নিক্তিতে আইনের শিক্ষার্থীদের জাতীয় মেধা পরিমাপ এবং তদনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের কৌলিন্য তালিকা নির্ধারণ একটি নিতান্তই বালখিল্য চেষ্টা।
তৃতীয়ত, যে কোন পরীক্ষায় ‘মেধাতালিকা’ বিষয়টিই ভীষণ বৈষম্যমূলক ও বর্ণবাদী ব্যাপার। মেধার তালিকা দিয়ে সত্যিকার মেধার যাচাই সম্ভব নয়, প্রত্যেক মানুষ স্বতন্ত্রভাবে প্রতিভাবান ও মেধাবী- হয়তো ক্ষেত্র পৃথক। তাই একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ক্রমতালিকা করে কে মেধাবী ও অমেধাবী তা প্রচার ও প্রসার করা অন্যায়। এটি তালিকায় থাকাদের অকারণ সুপিরিয়রিটি দেয়, অপ্রয়োজনীয় বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, এবং তালিকার বাইরে থাকাদের হীনমন্য করে তোলে।
এই ব্যবস্থা মোটেই ইনক্লুসিভ নয়, এক্সক্লুসিভ। সে কারণেই বাংলাদেশের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় এখন আর জাতীয় মেধাতালিকা নেই, ‘বোর্ড স্ট্যান্ড’- ধারণার বিলুপ্তি ঘটেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগসমূহ এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাসমূহ এখনো মেধাতালিকায় আটকে আছে। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ, যেখানে আমি বর্তমানে অধ্যয়নরত আছি, সেটি সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং এ পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ২০ নং এ আছে। এখানে কোন পরীক্ষায় ‘সম্মিলিত ফলাফল প্রকাশ’ কিংবা ‘মেধার ক্রমতালিকা’ বলে কিছু নেই। প্রত্যেক শিক্ষার্থী ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে ঢুকে শুধু নিজের ফলাফল অর্থাৎ নিজের জিপিএ দেখার সুযোগ পায়। এখানে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড- এসব অস্তিত্বহীন। ক্লাসের মধ্যে মেধার ক্রমতালিকায় আমি কত ক্রমিকে আছি সেটি জানার কোন সুযোগ নেই। পৃথিবীর উন্নত ও সেরা সব বিশ্ববিদ্যালয় এই নিয়ম প্রয়োগ করে।
আমার জানামতে, বাংলাদেশের অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে। এটি উত্তম ব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়, জুডিসিয়াল সার্ভিস, বিসিএস সহ বাংলাদেশের সব জায়গা থেকে মেধাতালিকা নামের এই কুৎসিত ব্যবস্থা উচ্ছেদের দাবি জানাই।
জুডিসিয়াল সার্ভিসে চান্সপ্রাপ্ত প্রার্থীর সংখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি ও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি মানহানিকর মন্তব্য দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্বেষ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি করা ছাড়া ইতিবাচক কোন ভূমিকা রাখছে না। আঞ্চলিক গণ্ডি অতিক্রম করে নিজেকে ‘গ্লোবাল স্টুডেন্ট’ হিসেবে ভাবতে শেখা উচিত। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের আইন বিভাগ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন আগ্রহী শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত। ইউনিভার্সিটির সীমানা থাকে, জ্ঞানের কোন সীমানা নেই।
আমি মনে করি, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএল.এম. প্রোগ্রাম উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত- যাতে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগ্রহী যে কারো প্রবেশাধিকার থাকে। এতে জ্ঞানের বদ্ধতা দূর হবে, ডাইভারসিটি আসবে, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পার্সপেক্টিভ এর সাথে পরিচিত হবে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের গ্র্যাজুয়েটদের মিথস্ক্রিয়া ঘটবে, ইউনিভার্সিটিকেন্দ্রিক কৌলিন্য প্রথার অবসান হবে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর ক্ষুদ্র একটি দেশ, এখানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক মানদণ্ডে তলানিতে অবস্থান করছে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রচেষ্টার পরিবর্তে পাবলিক বনাম প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, সেরা আইন বিভাগ বনাম অসেরা আইন বিভাগ দাবি নিয়ে এসব ঝগড়াঝাটি মানসিক দৈন্যের পরিচয়। আমরা সবাই বাংলাদেশের আইন পরিবারের বিভিন্ন শাখা। নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দিন শেষে এখানে কেউ জিতে না। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগসমূহের মধ্যে অ্যাকাডেমিক এক্সচেঞ্জ, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বাড়ানোতে মনযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের সংগ্রাম হোক ইতিবাচক, আসুন, বিশ্বের সেরা আইন বিভাগের তালিকায় নিজেদের আইন বিভাগকে উন্নীত করতে সচেষ্ট হই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।