‘পুলিশ প্রহরায় ব্যালট বাক্স হাইজ্যাকের’ ঘটনা বিচারপতির মাধ্যমে তদন্তের দাবী

‘পুলিশ প্রহরায় ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করে নিজেরা নিজেরা ভোট গণনা করে ফলাফল ঘোষণা’কে ন্যক্কারজনক উল্লেখ করে অনতিবিলম্বে এ ঘটনা সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতির মাধ্যমে তদন্ত করানোর দাবি জানিয়েছেন সমিতির সাবেক সম্পাদক ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী নেতা এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। সেই সাথে এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবী জানান তিনি।

আজ বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টে ল’ রিপোটার্স ফোরামের কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবী জানান। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতা এ. জে. মোহাম্মদ আলী।

লিখিত বক্তব্যে সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফলাফল ঘোষণার মুহুর্তে নির্বাচন কমিশনারের সাথে যে অনভিপ্রেত আচরণ করা হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে সমিতির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে লঙ্ঘন করে নজিরবিহীনভাবে সন্ত্রাসী ও অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। যা সুপ্রিম কোর্ট বারের ৭৫ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। দেশবাসীর সামনে আইনের এই সর্বোচ্চ মানবপীঠে এ ন্যাক্ক্যরজনক ঘটনা দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে।

তিনি আরও বলেন, বিশেষ পেশাগত কাজে নিয়োজিত হাজার হাজার আইনজীবীর মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। আমরা এই আইনজীবীদের হাত থেকে অবিলম্বে সাংবিধানিকভাবে গঠিত নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ভোট গণনা করে ফলাফল ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। সেই সাথে আব্দুন নুর দুলালের অবৈধ প্রক্রিয়ায় সেক্রেটারি রুম দখলকে প্রত্যাখ্যান করছি। দলমত নির্বিশেষে সকল আইনজীবীকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে মৌখিক বক্তব্য পেশ করেন সমিতির সাবেক সম্পাদক ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী নেতা এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। এ সময় তিনি বলেন, কালো কোট পরে বহিরাগত ছাত্রলীগ-যুবলীগ এসেছে। সুপ্রিম কোর্টে পুলিশের ছত্রছায়ায় তারা ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করেছে। নিজেরা নিজেরা ভোট গণনা করে ফলাফল ঘোষণা করেছে!

ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন বলেন, সুপ্রিম কোর্ট চীফ জাস্টিসের কোর্ট, আমরা মাননীয় প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে নিয়োজিত বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান স্যারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, অনতিবিলম্বে এ ঘটনা একজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির মাধ্যমে তদন্ত করা হোক। এ ন্যক্কারজনক ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

বিএনপি সমর্থিত আরেক আইনজীবী নেতা সিনিয়র অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, পুলিশ দিয়ে ঘটানো এমন ঘটনা আমি আমার জীবনে দেখি নাই। ব্যালট বক্স যে জায়গায় রাখা ছিল সেখান থেকে পুলিশ প্রহরায় ভোট ডাকাতি করে নিয়ে গেছে।

জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, ইতোপূর্বেও পুলিশ আদালত অঙ্গনে বারংবার ঢোকার চেষ্টা করেছিল। আমরা বলেছিলাম, প্রধান বিচারপতির অনুমতি ব্যতীত, বারের সভাপতির অনুমতি ব্যতীত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য এখানে প্রবেশ করতে পারে না। এটা বেআইনি। যেহেতু বারের সভাপতি নেই, কাজেই দায়িত্বে রয়েছেন প্রধান বিচারপতি। এতো বড় কান্ড ঘটে গেল, অথচ এই অবস্থায় প্রধান বিচারপতির কোন ভূমিকা দেখা গেল না।

তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির উচিত ছিল আজকে বিষয়টি নিয়ে স্বপ্রণোদিত রুল জারি করা। যাতে করে যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে ভবিষ্যতে যেন পুনরায় এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়। আদালত অঙ্গনে পুলিশ কিভাবে আসলো সেটাও তদন্ত হওয়া দরকার।

অ্যাডভোকেট জয়নুল বলেন, বারের যেহেতু কোন সভাপতি নাই, মাননীয় প্রধান বিচারপতি আপনি অবকাশের পর কোর্ট খোলার আগেই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। পাশাপাশি সম্পাদক পদে রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ নির্বাচিত কমিটির হাতে বারের নেতৃত্ব পুনর্বহাল করতে হবে।

এই সময়ের মধ্যে প্রধান বিচারপতি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সংগঠনের পক্ষ থেকে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনে আইনজীবী ফোরামের পক্ষে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সিনিয়র অ্যাডভোকেট বদরুদ্দোজা বাদল এবং সম্পাদক পদপ্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী সংগঠনের অন্যান্য নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

দেড় মাস আটকে থাকা ফল ঘোষণা

এর আগে প্রায় দেড় মাস আটকে থাকা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী সভাপতির সঙ্গে সম্পাদক পদেও আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।

সম্পাদক পদে পুনরায় ভোট গণনা নিয়ে বুধবার (২৭ এপ্রিল) বিকেলে সমিতি ভবনের সম্মেলনকক্ষের সামনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল ও হাতাহাতি হয়।

পরে আইনজীবী মো. অজি উল্লাহর নেতৃত্বাধীন নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত নতুন উপকমিটি বিকেল চারটা থেকে ভোট গণনা শুরু করে। রাত ১০টার দিকে ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

ফলাফলে সভাপতি, সম্পাদকসহ সাতটি পদে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা। আর দুটি সহসম্পাদক, কোষাধ্যক্ষসহ অপর সাতটি পদে জয়ী হয়েছেন বিএনপি-সমর্থিত নীল প্যানেলের প্রার্থীরা।

ফলাফল অনুসারে সভাপতি পদে সাদা প্যানেলের মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির ৩ হাজার ২৪৪ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নীল প্যানেলের মো. বদরুদ্দোজা পেয়েছেন ২ হাজার ৪৭৯ ভোট।

আর সম্পাদক পদে সাদা প্যানেলের আবদুন নূর ২ হাজার ৮৯১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নীল প্যানেলের মো. রুহুল কুদ্দুস পেয়েছেন ২ হাজার ৮৪৬ ভোট।

সাদা প্যানেল থেকে সহসভাপতি দুটি পদে মো. শহীদুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হোসেন এবং সদস্য পদে ফাতেমা বেগম, শাহাদাত হোসেন ও সুব্রত কুমার কুণ্ডু জয়ী হয়েছেন।

অন্যদিকে নীল প্যানেল থেকে সহসম্পাদকের দুটি পদে মাহফুজ বিন ইউসুফ ও মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান খান, কোষাধ্যক্ষ পদে মো. কামাল হোসেন এবং চারটি সদস্য পদে মাহদীন চৌধুরী, গোলাম আক্তার জাকির, মঞ্জুরুল আলম ও কামরুল ইসলাম নির্বাচিত হয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত ১৫ ও ১৬ মার্চ সমিতির নির্বাচনে (২০২২-২৩) ভোট গ্রহণ হয়। ১৭ মার্চ ভোট গণনায় সভাপতি পদে সাদা প্যানেলের মোমতাজ উদ্দিন ফকির এগিয়ে থাকলেও সম্পাদক পদে নীল প্যানেলের রুহুল কুদ্দুস এগিয়ে ছিলেন। একপর্যায়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলে সাদা প্যানেল থেকে সম্পাদক প্রার্থী আবদুন নূর পুনরায় ভোট গণনা চেয়ে আবেদন করেন।

এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে হইচই-হট্টগোল হয়। একপর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মসিউজ্জামান সমিতির কমিটির কাছে পদত্যাগপত্র দেন। এতে ভোটের ফলাফল ঘোষণা আটকে যায়।

যেভাবে ফল ঘোষণা

গত মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) আইনজীবী মো. অজি উল্লাহ স্বাক্ষরিত এক লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, ১২ এপ্রিল সমিতির কার্যকরী কমিটির মেয়াদের শেষ এক সভায় তাঁকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি নির্বাচন উপকমিটি করা হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় ২৭ এপ্রিল বেলা ৩টায় নির্বাচনপরবর্তী বাকি কাজ শেষ করা হবে।

তবে বুধবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে আইনজীবী সমিতির সম্পাদক (নীল প্যানেল থেকে সম্পাদক পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী) হিসেবে মো. রুহুল কুদ্দুস দাবি করেন, ১২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। কাজেই ওই সভায় গৃহীত যেকোনো সিদ্ধান্ত অবৈধ।

প্রত্যক্ষদর্শী বেশ কয়েকজন আইনজীবী বলেন, আগের ঘোষণা অনুসারে বুধবার বেলা সোয়া তিনটার দিকে মো. অজি উল্লাহর নেতৃত্বে নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত নতুন উপকমিটি সমিতির তিনতলায় অবস্থিত সম্মেলনকক্ষে ঢুকতে গেলে হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়। আগে থেকে সমিতির সম্মেলনকক্ষের অন্য পাশে অবস্থান নিয়ে বিএনপি–সমর্থক আইনজীবীরা এই উপকমিটি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে, অজি উল্লাহর নেতৃত্বে আইনজীবীরা ভোট গণনার জন্য সম্মেলনকক্ষে ঢুকতে গেলে বিএনপি–সমর্থক আইনজীবীরা এতে আপত্তি জানান ও বাধা হয়ে দাঁড়ান। সম্মেলনকক্ষে নির্বাচনের ব্যালটসহ অন্যান্য জিনিস রয়েছে। ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতির মধ্যে তালা ভেঙে সম্মেলনকক্ষে ঢোকেন তাঁরা। পরে বিএনপি–সমর্থকেরা কক্ষের কাচ ভাংচুর করেন। বিকেল চারটার দিকে ভোট গণনা শুরু করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি। এরপর সমিতি ভবনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।