মোহাম্মদ শিশির মনির: অসহায়-দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদানের তাগিদ অনুভব করছিলাম। কিন্তু বঞ্চিতদের সংখ্যা অনেক বেশি? তাহলে কিভাবে দিব? কেমনে নির্ধারণ করব? ফাইল পাব কোথায়? প্রকৃত ভুক্তভোগী কোথায় পাব? এই চিন্তা করে কিছু সময় কেটে গেল। তেমন কোন সমাধান পেলাম না। তাই বলে বসে থাকা যায় না। অবশেষে ঠিক করলাম সর্বাগ্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের জন্য কাজ করব। কারণ এরাই সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় আছে।
এরই অংশ হিসেবে আমার চেম্বারের জুনিয়র এবং হাইকোর্টের এডভোকেট নবাব অলী ভাইকে নিয়ে মিটিং করে সুনির্দিষ্ট কাজ ঠিক করলাম। আমার সহকারী নয়নকেও কাজ দিলাম। প্রথমেই ডেথ রেফারেন্স কোর্টের মামলার লিস্ট সংগ্রহ পর্যালোচনা করা হল। বেশ কিছু মামলায় কোন আইনজীবী ছিল না। আসামী জেল থেকে কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেল আপিল দায়ের করেছে। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র ডিফেন্স আইনজীবী নিযুক্ত করেছে। এই সকল মামলা নবাব আলী ভাই বাছাই করলেন। অতঃপর সেকশন থেকে পেপারবুক সংগ্রহ করা হল। পেপারবুক পড়ে মামলার ঘটনা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করা হল।কিছু মামলা নির্ধারণ করে ভুক্তভোগীদের সাথে যোগাযোগ করা হল। অনেকের কেউ নাই। তাদের জন্য জেল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নেয়া হল।
প্রতিটি মামলা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে রয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। তন্মধ্যে শংকর দেবনাথ ওরফে আনোয়ার স্মৃতিতে অম্লান। আজকে শুধু এই মামলা নিয়েই লিখব।
এই মামলার পেপারবুক হাতে পেয়ে বার বার পড়লাম। ঘটনার বর্ণনা পড়ে গা শিহরিয়া উঠল। ভৌতিক (Horror) সিনেমার মত বীভৎস বর্ণনা। যতই পড়ি ততই অবাক হই। আর ভাবী এটি কিভাবে সম্ভব! কিন্তু আইনজীবী হিসেবে অবাক হলেই ত হবে না! দেখাতে হবে প্রমাণ। সাক্ষী-সাবুদ। সেজন্য দরকার বার বার পড়া। ফিকির করা। গবেষণা করা। নজির খোঁজা। আমার জুনিয়র বন্ধু ইমরানকে বার বার পড়তে বললাম। রিসার্চ করতে দিলাম। নজির বের করার দায়িত্ব দিলাম। বেশ খাটাখাটি করল। প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্ট হলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম শংকরের জন্য আমরা সংগ্রাম করব।
আসামির পরিচিত একজনকে পেলাম। তার নাম এডভোকেট আলমগীর। জেলে থাকা আবস্থায় তার সাথে পরিচয়। তিনি ঢাকা জজ কোর্টে ওকালতি করেন। নবাব আলী ভাই তার মাধ্যমে জেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ওকালাতনামা ব্যবস্থা করলেন। জেল আপিলকে নিয়মিত আপিলে রুপান্তর করার জন্য দরখাস্ত দিলাম। আদালত মন্জুর করলেন। মামলাটি নিয়মিত আপিলে পরিণত হল। নতুন নম্বর পরল। এরই মধ্যে আদালত ১৫ দিলের জন্য ছুটি হয়ে গেল। সময় নিয়ে গভীরভাবে পড়ার সুযোগ পেলাম।
পড়াশুনা করে আমরা মোটামুটি বুঝতে পারলাম বর্ণনা যত বীভৎসই হউক না কেন এই আসামী নির্দোষ। সাক্ষী-সাবুদ কোন কিছুই সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। সে পরিস্থিতির শিকার। খুঁজাখুজির এর পর্যায়ে নজির পাওয়া গেল। আমাদের দেশের ৩টি আর ভারতীয় ২/৩ টি। সেগুলো ভালভাবে পড়লাম। কাছাকাছি আলোচনা। সত্যিই লিগ্যাল রিসার্চ অনিন্দ্য সুন্দর। এই কাজ করার জন্য দরকার গভীর মনোযোগ, কৌতুহলি মন এবং অগাধ ধৈর্য।
মামলার শুনানি শুরু হল। প্রথমেই রাষ্ট্রপক্ষ সম্পূর্ণ পেপারবুক পড়ে শুনাল। মাননীয় বিচারকগণ নানান প্রশ্ন করলেন। রাষ্ট্রপক্ষ সঠিক সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না। এডভোকেট নবাব আলী বসে বসে নোট নিল। দিন শেষে আমাকে ব্রিফ করত। আমরা জবাবের জন্য প্রস্তুতি নিলাম। ৫/৬ দিন পর আমার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় আসল।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পূর্বে ঘটনাটি সংক্ষিপ্তভাবে বলে নেয়া ভাল। আজ থেকে ১৬ বছর আগে কমলাপুর রেলস্টেশনের ৭ নম্বর প্লাট ফর্মের কাছে শংকর দেবনাথকে একটি দ্বিখণ্ডিত মাথাসহ পুলিশ গ্রেফতার করে। মাথাটি তার হাতে ব্যাগের ভিতর পাওয়া যায়। সাথে কিছু ঘাসও ছিল। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করে শাজাহানপুর থানায় নিয়ে যায়। দুইদিন পর তাকে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে। শংকর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। তার স্বীকারোক্তি মতে জাকির নামে আরেকজনকে গ্রেফতার করে চাঁদপুর থেকে। গ্রেফতারের পর শংকরকে নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুরের শালবনে। সেখান থেকে লাশের বাকি অংশ উদ্ধার করা হয়। এই মর্মে তারা দুজনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। তাদের ভাষায় একজনকে ভয় দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা আদায়ের জন্য একটি অনাথ ছেলেকে ব্লেড দিয়ে গলা কাটে। অতঃপর লাশের মাথা ব্যাগে রেখে দেয়। এমন সময় উপস্থিত লোকজন তাদের হাতে নাতে ধরে ফেলে। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। তখন থেকেই সে জেলে আছে। আর কোনদিন জামিন পায় নাই। ৭/৮ বছর কোন সাক্ষী আসে নাই। ৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়ে ঢাকার আদালত তাদের দুইজনকে ফাঁসির আদেশ দেয়। রায়ের প্রায় ৭ বছর পর Death Reference শুনানির জন্য হাইকোর্টে কার্যতালিকায় আসে।
৯. আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল। ৬টি নজির দিয়ে একটি রিসার্চ bundle বানিয়ে ৪ কপি করলাম। এক কপি রাষ্ট্রপক্ষ। দুই কপি দুইজন বিচারক ও আরেক কপি আমার নিজের। তার আগে মামলার মূল রেকর্ড কয়েকবার পর্যালাচনা করলাম। আমি ও আমার জুনিয়র ইমরান সামি তন্ন তন্ন করে পাতায় পাতায় খুঁজলাম। বার বার দেখলাম।হঠাৎ চোখে পরল অস্বাভাবিক একটি বিষয়। সকল কিছু মিলিয়ে কৌশল ঠিক করে রেখেছিলাম। সেভাবেই শুরু করলাম। নিম্নোক্ত তিনটি point এ যুক্তি উপস্থাপন করলাম:
ক। এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর আইনগত কোন মূল্য নেই।
খ। এই জবানবন্দী আমার নয়।
গ। বেকসুর খালাস চাই এবং আমার জীবনের মূ্ল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য ক্ষতিপূরণ/পুনর্বাসন চাই।
বুঝার সুবিধার্থে বিষয় তিনটি আলাদা করে আলোচনা করছি:
আইনগত মূল্য নাই
একটি স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী গ্রহণ করার আগে দুটি অনিবার্য বিষয় পরীক্ষা করতে হয়। যথা: এটি স্বেচ্ছায় করা হয়েছে কি না? এবং এটি সত্য কি না? এই দুটি শর্ত একসাথে পূরণ করতে পারলেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী গ্রহণ করা যাবে এবং এর আলোকে শাস্তি দেয়া যাবে। অন্যথায় এই জবানবন্দীর ভিত্তিতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। বললাম, ‘My Lords, these two conditions are inseparable twin. Prosecution must prove that the confessional statement is voluntary and true. These two conditions are concomitant side of the same coin. I will show your Lordships that it was neither voluntary nor true.’
সিনিয়র বিচারক বললেন,’আচ্ছা দেখান। কিভাবে দেখাবেন?’ প্রথমেই বললাম,’ আইনে আছে ২৪ ঘন্টার বেশি কাউকে পুলিশ হেফাজতে রাখা যাবে না। যদি রাখে এবং তারপর স্বীকারাক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে তাহলে ঐ জবানবন্দীর আইনগত মূল্য নাই। কারণ এ সময় তাকে illegal detention এ রাখা হয়েছিল। জজ সাহেবরা মাথা নাড়ালেন।আমি রেকর্ড থেকে দেখালাম তাকে ৪৮ ঘন্টার বেশি পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছিল। গ্রেফতার করার পর তাকে গাজীপুরের শালবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে লাশের কঙ্কাল উদ্ধার করার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তারপর ঢাকায় নিয়ে আসে। তারও একদিন পর আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এই বিলম্বের কারণে আদালতের কোন অনুমতি নেয়া হয় নাই।
জজ সাহেব বললেন, ‘কোন নজির আছে।’ সাথে সাথে উত্তর দিলাম,’Yes My Lords. I have prepared thin bundle for your kind assistance. In this bundle there are two earlier decisions from our Supreme Court (Appellate Division) and one decision from our High Court Division. In all these cases our apex Courts were pleased to acquit the condemned prisoners who were kept in police custody for more than two days.’
বিচারপতি মহোদয়গণ আমার সাথে সাথে নজিরসমূহ পড়লেন। আমি বললাম,’ My Lords, may I invite you to the page No…. and line no…..’ Both the Judges replied ‘yes.’ Then I read out those paragraphs and the Hon’ble judges also read those lines carefully and noted in their notebook. অতএব, এই জবানবন্দী voluntary নয়। এর উপর ভিত্তি করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।
জবানবন্দী আমার নয়
পরবর্তী point এই জবানবন্দী আমার নয়। এই ভাষ্য সত্য নয়। জজ সাহেব বললেন, কেন বলছেন? My Lord, দুই কারণে বলছি। এক. দেখুন এই জবানবন্দীর নিচে প্রদত্ত স্বাক্ষর কার? দুই. এই মাথা আর এই কঙ্কাল কার? মাথা তরুতাজা কিন্তু শরীর পুরানো কেন? ডাক্তারের পরীক্ষা কি বলছে?
এক. এই জবানবন্দীর মূল স্বাক্ষরটি দেখেন। এই কথা বলে আমি LCR (Lower Court Record) দেখার অনুরোধ করলাম। বিচারকদের হাতে তুলে দিলাম। বললাম,’ দেখেন My Lords, এই জবানবন্দী যার হাতের লেখা এই স্বাক্ষরও তারই হাতের লেখা। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নিজেই স্বাক্ষর দিয়েছেন এই কথা আমি বলছি না। আমি বলছি একই হাতের লেখা। তাহলে কে লিখল? ম্যাজিস্ট্রেট? আমি? নাকি পুলিশ? যেই লিখুক এটি বেআইনী। জালিয়াতি। গভীর মনোযোগ দিয়ে দুইজন বিচারপতি বার বার দেখলেন। চিন্তায় পড়ে গেলেন। কি করে হয় এটা? আমাকে আবার দেখতে বললেন। আমিও দেখলাম। রাষ্ট্রপক্ষ দেখল। সবাই অবাক করে তাকিয়ে রইল। শুনশান নীরবতা। বললাম হস্তলেখা বিশারদের মাধ্যমে পরীক্ষা করা দরকার। আপনারা নিজেরাও খালি চোখে দেখে বুঝতে পারছেন। আবারও নোট নিলেন।
আমি বললাম,’ My Lords, fraud has been practiced upon me and fraud vitiates everything. I have been put to condemned cell based on this fraud. Golden period of my life already passed. Who will be responsible for this irreparable loss? 16 years I am in jail. I was a young man and now I am 42 years old. Who will return those days? Can it be compensated by money? Who can replace my life?’ অনুভব করলাম বিচারকরা বেশ আবেগ প্রবণ হয়ে গেলেন।
দুই. এই লাশ আর এই মাথা এক নয়। দেখেন ডাক্তারের মতামত অনুযায়ী মাথার বয়স আনুমানিক ৮ বছর আর কঙ্কালের বয়স আনুমানিক ১৬ বছর। ঘটনা ঘটেছে আগেরদিন পরেরদিন দেহ কঙ্কাল হল কেমনে? কোথায় পেল সেই কঙ্কাল? মানবদেহের মাংস কি একদিনে পঁচে যায়? কঙ্কাল হয়ে যায়!! মেডিকেল সাইন্স কি বলে? এই কথা বলে Modi’s A Textbook of Medical Jurisprudence and Toxicology বই দেখালাম। পড়ে শুনালাম। কোনভাবেই সম্ভব না। তাহলে এই হাড্ডি কার? রাষ্ট্র DNA পরীক্ষা করল না কেন? কেন নির্ধারণ করেনি? না করেই আমাকে আসামী করল কিভাবে? এটাও প্রতারণা। বিচারকরা বেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন।
আমি শুধু বললাম,’My Lords, this is an unique case for compensation. This person needs to be rehabilitated by the state. State can not ignore responsibility. Your Lordship should look into this aspect very seriously. It is miscarriage of Justice.’
ক্ষতিপূরণসহ খালাস
খালাস আর ক্ষতিপূরণ। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমাকে বেখসুর খালাস দেন। একই সাথে ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেন। নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেন। আমাদের আলোকিত করেন। আপনাদের মহানুভবতা প্রতিষ্ঠিত হউক। কারণ miscarriage of Justice হয়েছে। এখানে খালাসই যথেষ্ট নয়। তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সময় কেউ ফেরত দিতে পারবে না। তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে আমরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে পারি। অন্যায় করা হয়েছে। তার জীবন শেষ করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রকে সেই দায় নিতে হবে। দায় স্বীকার করে অনুতপ্ত হতে হবে। ভবিষ্যতে নজির হয়ে থাকবে। এই কথা বলে একটি দরখাস্ত দেখালাম। এটি ছিল ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের দরখাস্ত। জজ সাহেব বললেন,’ বাহ! শুধু খালাসই চান না, ক্ষতিপূরণও চান।’ বললাম Yes, My Lords.’
যুক্তিতর্ক শেষে জজ সাহেব রায়ের দিন ঘোষণা করার জন্য ফাইল নিলেন। তখন কথা উঠল ক্ষতিপূরণের দরখাস্তের কি হবে? জজ সাহেব বললেন,’ এই ধরনের নজির কি আছে? আমি বললাম জি আছে। আমার দেয়া Bundle টি দেখেন। আবার শুনানি শুরু হল। দুটি নজির দেখালাম। একটি আমাদের দেশের অন্যটি ভারতের। আমাদের দেশের নজিরটি রিট এখতিয়ারে দেয়া হয়েছিল। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা আছে। আর ভারতের নজিরটি ফৌজদারি এখতিয়ারে দেয়া হয়েছিল। দুটো রায় থেকে পড়ে শুনলাম। জজ সাহবে একমত হলেন। রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’ আছে ত নজির। এটি শুরু হওয়া দরকার। নতুন ধারণা। নতুন চিন্তা। এভাবেই Jurisprudence develop করে। এখানে miscarriage of Justice হয়েছে। তাই খালাসই যথেষ্ট নয়। ‘ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী দাঁড়িয়ে সময় চাইলেন। বললেন, ‘My Lords, মাননীয় Attorney General বিষয়টি জেনেছেন। তিনি এই বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। তিনি ৩ সপ্তাহ সময় চেয়েছেন। কারণ বিষয়টি আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। খালাসের পর ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন নতুন ক্ষেত্র খুলে দিবে।
এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হল। অন্য আসামীর জন্য আরেকজন আইনজীবী ছিলেন তিনি বললেন, My Lord, রায়ের দিন নির্ধারণ করে দেওয়াই ভাল। তাছাড়া আদালত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বন্ধের আগেই রায় ঘোষণা হওয়া জরুরী।জজ সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,কি করব? বলেন? আমিও রাজি হয়ে গেলাম।রায়ের দিন নির্ধারণ করে দিলেন।
আগে থেকেই বুঝতে পারছিলাম খালাস পাব। ক্ষতিপূরণ নিয়ে তিনি কি বলেন সেটা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। রায়ের দিন সবাই হাজির। জজ সাহেব ঘোষণা করলেন, ‘ফাঁসির আদেশ বাতিল করা হল। দুইজনকেই বেকসুর খালাস প্রদান করা হল। এই মামলায় miscarriage of Justice হয়েছে। আসামীরা চাইলে আলাদাভাবে ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন চাইতে পারে। একই সাথে ২১ জন পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিলেন।’ জজ সাহেব বললেন,’ রায়টি আমি তাড়াতাড়ি নামিয়ে দিব।’
১৩. রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আর আপিল করল না। প্রায় দুই মাস পর হঠাৎ নবাব আলী ভাই জানাল শংকর মুক্তি পেয়েছে। তার সাথে ফোনে কথা হয়েছে। শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। খুবই পুলকিত বোধ করলাম। এডভোকেট আলমগীরের সাথে কথা হল। বললাম, আমি তাকে দেখতে চাই। কথা বলতে চাই। একবার নিয়ে আসেন। বলল পরের দিন নিয়ে আসবে।
১৪. এনেক্স ৭ নম্বর কোর্টে বসে আছি। নবাব আলী ভাই ফোন দিয়ে বলল আলমগীর ভাই ও শংকর দেবনাথ ওরফে আনোয়ার দেখা করতে আসছে।নিজের অজান্তেই চোখের কোনে পানি এসে গেল। ভাবতে লাগলাম দেখতে কেমন সে? কোনদিন ত দেখিনি! তার চেহারা কেমন হবে? এতদিন মৃত্যুর সেলে থাকার পর তার অনুভুতি কেমন হবে? মুক্তির পরই বা কেমন অনুভূতি তার? অবচেতন মনে ভাবতে ভাবতে সে এসে গেল। আলমগীর পরিচয় করিয়ে দিল। আমি উঠে কোলাকুলি করলাম। অন্য রকম অনুভূতি। ভাষায় সব প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অনেক কথোপকথনের পর জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছিল? কেন আপনাকে গ্রেফতার করল?
তখন সে বলল, স্যার, আমি নতুন মুসলমান হয়েছিলাম। ঢাকায় মেসে থেকে দর্জির কাজ করতাম। কমলাপুর রেল স্টেশনের পাশে নতুন অভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছিল। কৌতুহল বশতঃ বিকালে দেখতে গিয়েছিলাম। হাটাহাটি করতে বের হয়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম কিছু মানুষ জড়ো হয়ে কি যেন দেখছে? আমিও দেখতে গেলাম। দেখি ট্রেনে কাটা পরা একটি মাথা সবাই ভীড় করে দেখছে। আমিও উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পুলিশ এসে সেখান থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতার করল। আমাকেও গ্রেফতার করল। অন্যদের অভিভাবক বা আত্মীয়-স্বজনরা এসে ছুটিয়ে নিয়ে গেল। আমার কেউ নাই। আমার জন্য কেউ আসল না। আমার কাছে ২০ হাজার টাকা চাইল। আমি দিতে পারি নাই। তাই আমার এই অবস্থা স্যার। বলতে বলতে সকলেরই চোখ ঝাপসা হয়ে গেল…
মোহাম্মদ শিশির মনির: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।