বাংলাদেশী বিচারকের গবেষণা: “বিচারকার্যে ব্যবহার্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পক্ষপাতিত্ব ও বৈষম্যকে উসকে দিতে পারে”

মোঃ হাসানুল বান্না: প্রযুক্তির বিস্ময়কর আবিষ্কার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবাধ ক্রমবর্ধনশীল অগ্রগতি অন্যান্য সরকারী খাতের ন্যায় বিচারাঙ্গনকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। বিগডেটা, মেশিনলার্নিং ও সম্ভাব্যতা নিরূপণকারী প্রযুক্তির যেমন নানাবিধ ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তেমনি অগণিত নব্যপ্রযুক্তিগত ঝুঁকি রয়েছে। কাজেই, আদালতপাড়ায় এমন দ্বিমুখী অভিনব প্রযুক্তির আগমনের প্রভাব সত্যিই আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। এমন গভীর ভাবনা ও উদ্বেগ ইতোমধ্যে দশদিকে ছড়িয়ে পরেছে; চলছে তুমুল বিতর্ক আইন ও নৈতিকতার প্রশ্নে।

এমন বাস্তবতার যোগসূত্রে, ফৌজদারী আদালতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে প্রযুক্তিগত বৈষম্য ও পক্ষপাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে কিনা, পারলে তা কিভাবে বৃদ্ধি করে, এমন কিছু জটিল বিষয়ে আইন-আদালত, প্রযুক্তিনীতি ও নৈতিকতার এক আন্ত-বিষয়ক গবেষণা কর্ম সম্পন্ন করেছেন রাজশাহীর সহকারী জজ মোঃ আব্দুল মালেক, যা সম্প্রতি বিখ্যাত ‘Springer Nature’ এর ‘AI & Ethics’ নামক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

ফৌজদারি আদালতে প্রবেশন, জামিন এবং দণ্ডের পরিধি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থায় সহায়ক প্রযুক্তি হিসেবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে।অপরাধীর প্যারোলে বা প্রবেশনে মুক্তি দেয়া বা আসামীকে জামিন দেয়া সমাজের জন্যে নিরাপদ কিনা, অথবা আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার সাজার মেয়াদ কত হবে, এমন সব বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি সম্ভাব্যতার নিরিখে তথ্য দিয়ে বিচারককে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করে। অনেকে মনে করেন যে, যুক্তিতে, বুদ্ধিতে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর এ প্রযুক্তি মানুষের চেয়ে অধিক স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য। এ কারণে, আদালত পরিচালনাকারী মানবীয় বিচারকের (অনিচ্ছাকৃত) খামখেয়ালি ও সুপ্ত পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের হার অনেকাংশে হ্রাস করবে বিধায় এমন প্রযুক্তির বেছে ব্যবহার সমীচীন বলে অনেকে যুক্তি দেখান। এছাড়াও, কেউ কেউ দাবী করেন যে, আদালতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ফৌজদারী বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

তবে, হালের গবেষকগণ সকলেই এমনটি মনে করেন তা নয়। যেমনটি আগেই বলেছি, বিচার প্রশাসনে এই ধরণের অনিয়ন্ত্রিত ও অভিনব প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রভাব বিষয়ে নানাবিধ আইনি এবং নৈতিকতার প্রশ্নে গোটা বিশ্বে ইতোমধ্যে জোরদার বিতর্ক জন্ম নিয়েছে। কোন সন্দেহ নেই যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন “রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট অ্যালগরিদম” বা  “অপরাধীর ঝুঁকি মূল্যায়ন ব্যবস্থা” বিপুল পরিমাণ ডেটা নিমিষেই বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে; সেখানে বিপুল পরিমাণ ডেটা ‘ইনপুট’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রাজশাহীর বিচারক আব্দুল মালেক দাবী করেন যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে সংস্করণটি বর্তমানে ফৌজদারি আদালতে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা প্রকৃতিগতভাবেই পক্ষপাতমূলক ডেটা দিয়ে তৈরি ও প্রশিক্ষিত।

ফলে, প্রযুক্তিগত পক্ষপাত, ডেটাসেট পক্ষপাত, নমুনা পক্ষপাত, অটোমেশন পক্ষপাত, নিশ্চিতকরণ পক্ষপাত, প্রতিনিধিত্ব পক্ষপাত, এবং মিথস্ক্রিয়া পক্ষপাতের মত বহুবিধ অভিনব পক্ষপাতসমূহ ফৌজদারী বিচারব্যবস্থাকে আরো পক্ষপাতদুষ্ট করে তুলবে।এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত পক্ষপাতসমূহ ফৌজদারী বিচারব্যবস্থার প্রাসঙ্গিকতায় চমৎকারভাবে আলোচনা করা হয়েছে এই বিচারকের গবেষণা কর্মে। এ প্রসঙ্গে, মার্কিন মুলুকের ২০১৬ সালের বিখ্যাত “রাষ্ট্র বনাম লুমিস” নামক মামলায় প্রদত্ত আদালতের পর্যবেক্ষণও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

এছাড়াও, আদালতের মত সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মত উন্নত-প্রযুক্তি ব্যবহারের দরুন সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য উপায় বাতলে দেয়া হয়েছে এ গবেষণা প্রবন্ধে। এ গবেষক মনে করেন যে, ফৌজদারী বিচারব্যবস্থায় এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের উপর বিচারকদের নির্ভরতা বৃদ্ধি পেলে সামগ্রিকভাবে ব্যক্তির অধিকার, বিচারিক মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, যা নিঃসন্দেহে ব্যক্তি ও গোপনীয়তার অধিকার এবং নৈতিকতার নিরিখে অনিরাপদ।

এ প্রেক্ষাপটে উদাহরণ হিসেবে এ গবেষণায় বলা হয়েছে, সারাবিশ্বে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সামরিক ও সামাজিক কল্যাণের মত সরকারি খাতগুলোতে ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বর্তমান সংস্করণ এখনও মানুষের ভুল-ভ্রান্তি, বৈষম্য এবং সহজাত পক্ষপাত সংশোধন করতে সক্ষম নয়। সুতরাং, সংগত কারণেই এ বিচারক অভিমত পোষণ করেন যে, ফৌজদারী বিচারব্যবস্থায় এই ধরনের স্বয়ংক্রীয় যন্ত্রের উপর বিচারকদের নির্ভরতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে শ্রেণীবিশেষের প্রতি যান্ত্রিক পক্ষপাত ও প্রযুক্তিগত বৈষম্যের মতো অবাঞ্ছিত ফলাফল বয়ে আনতে পারে, যা নিঃসন্দেহে বেআইনী ও অনৈতিক।

এ আই প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ডেটার গুণমান পরীক্ষা ও মূল্যায়ণ করার পন্থা সহজতর করার পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতা এবং আইনি মূল্যবোধের আলোকে নতুন ধরণের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি আবিষ্কার করার দিকে মনোযোগ দেয়া যেতে পারে বলেও অভিমত পোষণ করেন এ গবেষক। পাশাপাশি, ব্যক্তির অধিকার, বিচারিক মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বিধায় ফৌজদারি আদালতে এ আই প্রযুক্তি অন্ধভাবে ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন রাজশাহীর এই বিচারক। এছাড়াও, আদালতের মত সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মত উন্নত-প্রযুক্তি ব্যবহারের দরুন সৃষ্ট সম্যসার সমাধানের সম্ভাব্য উপায় যুক্তিসহ উপস্থাপন করা হয়েছে এ গবেষণাপত্রে।

সর্বোপরি, এ ধরনের সময়োপযোগী ও ভিন্নধর্মী গবেষণালব্দ জ্ঞান বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যহহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি। অধিকন্তু, এ ধরনের প্রযুক্তির উন্নয়ন, ব্যবহার ও গবেষণাসহ বিচার প্রশাসনের নীতি নির্ধারণে কার্যকরি প্রভাব বিস্তার করার উপাদান অধস্তন আদালতের বিচারকের এই গবেষণা কর্মে রয়েছে মর্মে আমার বিশ্বাস। পরিশেষে, বলা বাহুল্য যে, বিচারকর্ম যেহেতু একটি মানবীয়কর্ম, যান্ত্রিকতা যেন এই মহান কর্মকে কলুষিত না করে। এ প্রসংগে একটি মানবীয় আবেগ সম্পন্ন কবিতার দুটো লাইন উদ্ধৃতি করে শেষ করছি:

“দন্ডিতের সাথে

দন্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে

সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।

যার তরে প্রাণ

কোন ব্যথা নাহি পায়,

তার দন্ডে দান প্রবলের অত্যাচার।”

লেখক: মোঃ হাসানুল বান্না, আইনজীবী; ইমেইল: bannalink@gmail.com

জার্নালের লিঙ্কঃ https://link.springer.com/article/10.1007/s43681-022-00137-9