'কোর্ট ম্যারেজ' এর আইনগত ভিত্তি ও করণীয়
অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী

পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতা, যুব সমাজ ও আমাদের আইন

মো. রায়হান আলী: সামাজিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল পর্নোগ্রাফি আসক্ততা। এ ব্যাধির বিস্তার সমাজে দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশেষ করে যুব সমাজে এ আসক্ততার হার বেশি। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের আরেক নাম ইন্টারনেট। যাদুর পরশের মত যার কাজ! আধুনিকতার ছোয়ায় সবকিছু যেন হাতের নাগালে। ইন্টারনেট ছাড়া দাপ্তরিক কাজ থেকে অনেক কাজেই প্রায় অচল।

দীর্ঘ দু’বছর ধরে করোনা মহামারীর কারণে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে গিয়ে ক্লাস করতে পারেনি। সোস্যাল ডিসট্যান্স এর জন্য ঘরে বসেই বেশিরভাগ সময় শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়েছে শিক্ষার্থীরা। অনেক অবিভাবকরা চায় না তাদের সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে কিন্তু করোনায় শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস করার জন্য হলেও কিনে দিতে হয়েছে স্মার্টফোন। এই স্মার্টফোনে অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন।

স্মার্টফোনে ফেসবুক, ইউটিউব,পাবজি গেম সহ অনেক অ্যাপ ব্যবহার করা শিখেছেন তারা। গোপনে সর্বনাশ হল পর্নোগ্রাফি আসক্ততা বেড়েছে অনেকের। এমনকি ইন্টারনেট ভিত্তিক সাইবার অপরাধ,কিশোর গ্যাং সহ নানান প্রকার অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন অনেকে। অন্যান্য অপরাধের তুলুনায় সবচেয়ে বেশি আসক্ত হয়েছেন পর্নোগ্রাফি অপরাধে। অনেক শিক্ষার্থী ও যুবক পর্নোগ্রাফির কড়াল গ্রাসে আসক্ত। আমরা এবার দেখে নেই এ অপরাধ মূলত কি এবং এর পরিনতি কি?

পর্নোগ্রাফির সংজ্ঞা

নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধকল্পে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে “পর্নোগ্রাফি আইন, ২০১২” প্রণীত হয়। মূলত পর্নোগ্রাফি হল, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ,অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যাহা চলচ্চিত্র,ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিক্স বা অন্য কোন উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যাহার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই;যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, সাময়িকী, ভাস্কর্য, কল্পমূর্তি, মূর্তি, কাটুর্ন বা লিফলেট;

পর্নোগ্রাফির সাজা

পর্নোগ্রাফি আইনে সাজার বিধান আছে উক্ত আইনের ৮ ধারায়। এই আইনে বলা আছে- কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি উৎপাদন করিলে বা উৎপাদন করিবার জন্য অংশগ্রহণকারী সংগ্রহ করিয়া চুক্তিপত্র করিলে কিংবা কোন নারী, পুরুষ বা শিশুকে অংশগ্রহণ করিতে বাধ্য করিলে বা কোন নারী, পুরুষ বা শিশুকে কোন প্রলোভনে অংশগ্রহণ করাইয়া তাহার জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্থির চিত্র, ভিডিও চিত্র বা চলচ্চিত্র ধারণ করিলে তিনি সর্বোচ্চ ৭ (সাত) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

এছাড়া কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য কোন ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তি মর্যাদা হানি করিলে বা ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় বা অন্য কোন সুবিধা আদায় বা কোন ব্যক্তির জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ধারণকৃত কোন পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিকে মানসিক নির্যাতন করিলে তিনি সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

এছাড়াও কোন ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করিলে তিনি সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের মাধ্যমে গণউপদ্রব সৃষ্টি করিলে উক্ত ব্যক্তির সর্বোচ্চ ২ (দুই) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

পর্নোগ্রাফি উৎপাদন-বিপণনের সাজা

কোন ব্যক্তি— পর্নোগ্রাফি বিক্রয়, ভাড়া, বিতরণ, সরবরাহ, প্রকাশ্যে প্রদর্শন বা যে কোন প্রকারে প্রচার করিলে অথবা উক্ত সকল বা যে কোন উদ্দেশ্যে প্রস্ত্তত, উৎপাদন, পরিবহন বা সংরক্ষণ করিলে; অথবা কোন পর্নোগ্রাফি প্রাপ্তি স্থান সম্পর্কে কোন প্রকারের বিজ্ঞাপন প্রচার করিলে; অথবা এই উপ-ধারার অধীন অপরাধ বলিয়া চিহ্নিত কোন কার্য সংঘটনের উদ্যোগ গ্রহণ করিলে; তিনি সর্বোচ্চ ২ (দুই) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

এমনকি কোন ব্যক্তি কোন শিশুকে ব্যবহার করিয়া পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, বিতরণ, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অথবা শিশু পর্নোগ্রাফি বিক্রয়, সরবরাহ বা প্রদর্শন অথবা কোন শিশু পর্নোগ্রাফি বিজ্ঞাপন প্রচার করিলে তিনি সর্বোচ্চ ১০ (দশ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫,০০,০০০ (পাঁচ লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। এই আইনের অধীন সংঘটিত কোন অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বা সহায়তাকারী ব্যক্তি প্রত্যেকেই একই দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

পর্নোগ্রাফি অপরাধের বিচার সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, কোন বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালকে এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার করিবার ক্ষমতা অর্পণ করেছেন।

উদ্বেগের কারণ

গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি বেশি দেখা হয় মোবাইল ফোনে৷ মোবাইল ফোনে অনলাইন এবং অফ লাইন দু’ভাবেই সুযোগ আছে৷ আর শুধু পর্নো সাইট নয়, কিছু নিউজ পোর্টালও পর্নোগ্রাফি প্রচার করে টেক্সট, ছবি এবং ভিডিও আকারে৷

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ২২ লাখেরও বেশি৷ এর মধ্যে ৫ কোটি ৮৩ লাখের বেশি মোবাইল ফোন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে৷ ফলে মোবাইল পর্নোগ্রাফি বাংলাদেশে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

বিটিআরসির এক কর্মকর্তা জানান, ‘‘পর্নোগ্রাফি চিহ্নিত করতে সাধারণ মানুষকেও সম্পৃক্ত করা হবে৷ সবার কাছে আহ্বান জানানো হবে পর্নোগ্রাফির সাইট ও লিংকের তথ্যের জন্য এবং তা আমলে নেয়া হবে৷”

পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে স্কুল ছাত্রদের নিয়ে একটি জরিপ করেছে বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’৷ এ জরিপে বলা হচ্ছে, ঢাকার স্কুল পড়ুয়াদের প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফি দেখে৷

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমকে জানান, ‘‘আমাদের এই জরিপটি অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে করা হয়৷ আর তাতে দেখা যায়, পর্নোগ্রাফি তারা ছবি, ভিডিও, অডিও এবং টেক্সট আকারে ব্যবহার করে৷ এসব পর্নোগ্রাফির আবার বড় অংশই দেশে তৈরি৷ এই শিক্ষার্থীরা প্রধাণত মোবাইল ফোনে অনলাইনে পর্নোগ্রাফি দেখে৷ এর বাইরে ট্যাব, ল্যাপটপেও তারা দেখে৷ আবার পেনড্রাইভ ব্যবহার করে বিনিময়ও করে৷”

বাংলাদেশে সাধারণভাবে পর্নোগ্রাফির ব্যবহার কেমন বা কারা এর ভোক্তা? এ প্রশ্নের জবাবে আব্দুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমকে আরোও জানান, ‘‘এ নিয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট জরিপ নেই৷ জরিপের ফলোআপে দেখা যায়, ৩০-৩৫ বছর যাদের বয়স এবং তাদের মধ্যে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের শতভগই একবার হলেও পর্নোগ্রাফি দেখেছেন৷ নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখেন ৯০ ভাগ৷ আর যুবনারীদের মধ্যে সংখ্যাটা শতকরা ৫০ ভাগ৷”

মন্তব্য

আজকের যুবকরাই আগামী দিনের কর্ণধার। এ যুব সমাজকে দেশ ও পরিবারের প্রয়োজনে হলেও জনসম্পদে পরিনত করতে হবে। যুব সমাজের সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গি বদলাতে প্রথমে পরিবারের অবিভাবকদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। সন্তানদের ছোট বেলা থেকেই ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটাতে হবে। অসৎ সঙ্গ থেকে যুব সমাজকে দূরে রাখতে পরিবারকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে। ইলেকট্রনিক্স ডিভাইজ বা গণমাধ্যম সংক্রান্ত অ্যাপগুলোয় শিক্ষামূলক সাইড ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নৈতিক স্খলন সংক্রান্ত কার্যাবলী থেকে কৌশলে তাদের দূরে রাখতে হবে। যেহেতু আধুনিক যুগ, তাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সংক্রান্ত সঠিক জ্ঞান তাদের মধ্যে বৃদ্ধি করাতে হবে।

আইসিটি’র ভাল-মন্দ দিক গুলো সন্তানদের বুঝাতে হবে। অবিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আইসিটি’র ব্যবহার সংক্রান্তে ভাল দিকের পাশাপাশি এটার অপব্যবহারে কিংবা অজান্তেই যে একজন পর্নোগ্রাফি অপরাধ ও সাইবার অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে সেদিক বিবেচনায় এটার প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বাড়াতে হবে। যুব সমাজকে সামাজিক দূরারোগ্য ব্যাধি “পর্নোগ্রাফি অপরাধ” থেকে বাঁচাতে সরকারী উদ্যোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অবিভাবক ও সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: আইনজীবী; জজ কোর্ট, খুলনা।