বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিজ নিজ জাতীয় স্লোগান থাকলেও বাংলাদেশের স্বীকৃত কোন জাতীয় স্লোগান ছিলনা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী স্লোগান ব্যবহার করে আসছিলেন। ফলে যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের স্লোগানই প্রায় জাতীয় স্লোগান হয়ে উঠত বারংবার উচ্চারিত হওয়ার কারণে। তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বশির আহমেদের উদ্যোগে সে ধোঁয়াশা কেটেছে। ২০১৭ সালে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন দায়ের করেছিলেন তিনি। ‘জয় বাংলা’ কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা চেয়ে দায়ের করা সেই রিট আবেদনের পক্ষে দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০২০ সালে হাইকোর্ট ‘জয় বাংলা’ কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করেন। আদালতের রায় বাস্তবায়নে মন্ত্রীসভায় এ সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন। ইতোমধ্যে ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে জারি করা হয়েছে প্রজ্ঞাপন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচির নেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই করা অ্যাডভোকেট ড. বশির আহমেদ জানিয়েছেন ‘জয় বাংলা’ রিট মামলায় জয়ী হওয়ার শুরু থেকে শেষ।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: একটি দেশের জাতীয় স্লোগান থাকার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
বশির আহমেদ: পৃথিবীর ১৬৩টি দেশে জাতীয় স্লোগান রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও ‘In God We Trust’ জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দেশটির সংবিধানেও স্লোগানটি যুক্ত করা হয়েছে। আমি মনে করি জাতীয় স্লোগান দেশের প্রতি ভালবাসা ও দেশপ্রেমিতাকে উৎসাহিত করে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: জাতীয় স্লোগান হিসেবে জয় বাংলাকেই কেন পছন্দ করা হল?
বশির আহমেদ: ‘জয় বাংলা’ একটি শক্তির নাম। একাত্তরের রণহুঙ্কার এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে জিন্দাবাদওয়ালা নরপশু পাকিস্তানিরা এবং তাদের এদেশীয় দোসররা ও স্বাধীনতা বিরোধীরা থরথর করে কাঁপত। মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকাররা বলত ‘জয় বাংলা বাহিনী’। স্বাধীন বাংলাদেশপন্থীদের বলত ‘জয় বাংলা’র লোক। এজন্য কোন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনী বা রাজাকারদের হাতে ধরা পরলে তাঁকে ‘জিন্দাবাদ’ বলার জন্য শক্তি প্রয়োগ করত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ বলাতে অটল থাকতেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ‘জয় বাংলা’ বলে ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন, কিন্তু ‘জিন্দাবাদ’ বলেননি। ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ই ছিল তাদের প্রেরণার উৎস। তাই জীবন দিয়ে হলেও তারা জয় বাংলাকে ধারণ ও লালন করেছেন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: জাতীয় স্লোগান নির্ধারণে রিট কেন, অন্য কোন উপায় ছিল কি না?
বশির আহমেদ: আমরা যারা স্বাধীনতার প্রথম প্রজন্ম, ’৭৫ –এর পর স্কুল-কলেজে পড়াকালীন নোয়াখালীতে কারারুদ্ধ হয়েছি। ’৮০’র দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে সামরিক জান্তা সেনানিবাস ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়েছে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দেয়ার অপরাধে! ‘জয় বাংলা’র শক্তি অনুভব করেছি ১৯৯২ সালের শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত গঠনের সময়।
আইন পেশায় যোগ দেওয়ার পরও ‘জয় বাংলা’র আর্তনাদ বিবেকের কাছে তাড়া দিয়ে চলছিল। তাই ‘জয় বাংলা পরিষদ’ গঠন করে ‘জয় বাংলা’কে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান করার দাবিতে গ্রাম-গঞ্জে, শহরে, দেশে, বিদেশে (লন্ডন, আমেরিকায়) অনেক ‘জয় বাংলা সমাবেশ’ করেছি। চিন্তায় আসলো জাতীয় সংসদে আইন পাস করে ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান করা হলে পাক-অনুসারীরা দলীয় তকমায় ফেলে দিবে। ভাবলাম আমি একজন আইনজীবী, তাই আইনের আওতায় কীভাবে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করা যায়। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগানের মর্যাদা না পাওয়ায় ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আদালতে লড়াইয়ের সংক্ষিপ্ত ঘটনা বিবরণী সম্পর্কে কিছু বলুন…
বশির আহমেদ: আমি খুব ভালভাবেই জানতাম এই রিট পিটিশন অন্যান্য কোন সাধারণ রিট পিটিশনের মতো নয়। এজন্য আমাকে ব্যপক গবেষণা করে দেশ-বিদেশের অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়েছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে অনুসন্ধান, গবেষণা করলাম। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পৃথিবীর ১৯৫টি দেশের সংবিধান ও পৃথিবীর বিভিন্ন সুপ্রিম কোর্টের রায় যাচাই-বাছাই করে সেই সকল দেশের এ সংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনা করে দেখলাম- পৃথিবীর সকল দেশের জাতীয় স্লোগানের চেয়ে ‘জয় বাংলা’র তাৎপর্য বহুগুণ বেশি। অনেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করলাম, প্রায় সকলেই পক্ষে মতামত দিলেন, দু-একজন ছাড়া।
রিটের সিদ্ধান্ত তো নিলাম, কিন্তু রিট আবেদনকারী হতে অনেককে বলার পরও কেউ রাজি হলেন না। বললেন, এটা অনেক বড় রিস্ক! এরপর নিজেই রিট আবেদনকারী হয়ে পিটিশন দায়ের করলাম। তিন দিন শুনানির পর ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘জয় বাংলা’কে কেন জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে সরকারের প্রতি রুল জারি করলেন মহামান্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহ্ –এর দ্বৈত বেঞ্চ।
এরপর রুল শুনানির জন্য বেঞ্চ পাওয়া যাচ্ছে না! অন্য দুটি বেঞ্চে চেষ্টা করেও শুনানি করতে পারলাম না। সর্বশেষ মাননীয় বিচারপতি এফ. আর. এম. নাজমুল আওহসান ও মাননীয় বিচারপতি কে.এম. কামরুল কাদের –এর ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি অনুষ্ঠিত হল। সর্বমোট ৮০ কার্য দিবসে শুনানি শেষে ২০২০ সালের ১০ মার্চ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ‘জয় বাংলা’কে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করতে রিট আবেদনে পক্ষে আদালতে উত্থাপিত যুক্তিগুলো কি ছিল?
বশির আহমেদ: শুধু আমাদের দেশেই না, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশে-বিদেশে একটাই স্লোগান ধ্বনিত হত, ‘জয় বাংলা’। এছাড়া পাকিস্তানেরও কিছু কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের করাচি শহরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের ব্যাপক গুরুত্ব ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপ্রিয় ধ্বনি ছিল ‘জয় বাংলা’।
১৯৬৯-৭০ –এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বহুল প্রসার ঘটে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সকল গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ শেষে ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছেন। যাতে সমগ্র বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় বঙ্গবন্ধু তাঁর সকল ভাষণের সমাপ্তি টানেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে।
এছাড়া সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে ‘বাংলা’কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ৪(১) অনুচ্ছেদে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমার ভালবাসি’ সঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; ৪(২) অনুচ্ছেদে জাতীয় পতাকা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে; ৪(৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় ফুল শাপলার বিবরণ দেয়া হয়েছে। উল্লিখিত অনুচ্ছেদসমূহের ধারাবাহিকতায় ৪(৪) অনুচ্ছেদে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত এবং এটা সময়ের স্বীকৃত দাবি। এই যুক্তি আদালতে নিবেদন করা হয়েছিল।
এছাড়াও পৃথিবীর ১১৫টি দেশের সংবিধান যাচাই করে ১০টি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান নেতা ও শহিদদের ওই সকল দেশের সংবিধানে কীভাবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা সহ মোট ১৬৩টি দেশের জাতীয় স্লোগানের নাম উল্লেখপূর্বক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুপ্রিম কোর্টের ল্যান্ডমার্ক জাজমেন্টসমূহ আদালতে উপস্থাপন করেছি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: রায়ে হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো কি ছিল এবং আদালতের রায় অনুযায়ী কোন কোন ক্ষেত্রে জাতীয় স্লোগান ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে ?
বশির আহমেদ: আদালতের নির্দেশনার মধ্যে বলা হয়েছে, ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হবে। প্রতিপক্ষগণ (সরকার) অবিলম্বে এই ঘোষণা কার্যকরী করার জন্য পদক্ষেপ নিবেন। অর্থাৎ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন।
আদালতের রায় অনুযায়ী, সকল জাতীয় দিবসগুলোতে এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারকারীগণ এবং রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তাগণ রাষ্ট্রীয়/সরকারী অনুষ্ঠানের বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন, সেইজন্য প্রতিপক্ষগণ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
এছাড়া দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ (অ্যাসেম্বলি) সমাপ্তির পর ক্ষেত্রমতে, সভা-সেমিনারে ছাত্র-শিক্ষকগণ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন তার জন্য প্রতিপক্ষগণ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে রায়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: এই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে কোন বাহ্যিক চাপ এসেছিল কি না, বা কোন ধরণের বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল কি না?
বশির আহমেদ: প্রথমে তো রিট আবেদনকারী পাইনি। সেটা একটা সমস্যা ছিল, আগেই বলেছি। এরপর রিট শুনানির জন্য বেঞ্চ না পাওয়া আরেকটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আর বাহ্যিক চাপ তো ছিলই। প্রাণনাশের হুমকিও পেয়েছি। কিন্তু ‘জয় বাংলা’র শক্তি ও প্রেরণায় পিছপা হয়নি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আদালতের রায় বাস্তবায়নে ‘জয় বাংলা’ কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করতে সরকারের মন্ত্রীসভায় প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে গেজেটও প্রকাশ হয়েছে। অক্লান্ত শ্রমে আদালতের রায় ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, কেমন লাগছে?
বশির আহমেদ: অসাধারণ অনুভূতি। ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। দীর্ঘ দিনের নিরলস শ্রম আর একনিষ্ঠ কর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বলতে পারেন। বলতে পারেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে কেনা হারিয়ে যাওয়া প্রিয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আমার দুঃখিনী বাংলা মায়ের বুকে ফিরে আসার বর্ণনাতীত আনন্দ। এজন্য সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম পাঠকদের জন্য দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।