সাইফুল ইসলাম পলাশ:
“হামার কী কোটত আইসতে টাকা খরচ হয় না! মোর ম্যালা টাকা খরচ হইল। এলা এতুগুলা টাকা মোক কায় দিবে?“ – পিপি, পেশকারের নিষেধ উপেক্ষা করে হরহর করে কথাগুলো বলছিলেন সুলতান। দু’দিন আগে আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে তীব্র ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন তিনি। মন চাচ্ছিল আদালতে চিৎকার চেঁচামেচি করে বিচার কাজে বাধা দেওয়ায় জন্য তাকে দণ্ড দেই। কোনোভাবে নিজেকে সংবরণ করলাম।
খেয়াল করে দেখলাম, পড়নে তার ফিনফিনে পাতলা একটা লুঙ্গি আর কালো-হলুদ রঙের টি-শার্ট। নাম সুলতান হলেও তিনি একজন হতদরিদ্র জেলে। বাড়ী দেশের সবচেয়ে মঙ্গাপীড়িত উপজেলা চর রাজিবপুরে। সারাদেশে দারিদ্রের হার ২৪.৩ শতাংশ হলেও এখানে ৭৯.৮ শতাংশ (ঢাকাপোস্ট অনলাইন, ২২ মে ২০২২)। অত্যন্ত প্রান্তিক জনপদের বাসিন্দাদের মূল পেশা কৃষি ও মাছ ধরা হলেও বছরের এক সময় এখানে চর জেগে উঠে। বর্ষার সময় পানি বেড়ে গেলে চর ডুবে যায়। ফলে সেখানে তারা স্থায়ীও হতে পারেন না। সুলতানেরও স্থায়ী বাড়ী নেই।
দীর্ঘ সময় আদালতে বসে থাকার পর তার কথাগুলো কানে এসে বাজছিল। জিজ্ঞেস করলাম, কী সমস্যা? তিনি জানালেন, চার বছর আগে বিজিবি স্থানীয় দুজন ছেলেকে ০৬ বোতল ফেন্সিডিলসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে। মাছ ধরে বাড়ী ফেরার পথে বিজিবি তাকে ডেকে জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর নেয়। বিজিবি বলেছিল, সাক্ষী হতে হবে না। কোনোদিন আদালতেও যেতে হবে না। কিন্তু সুলতান হিসেব মিলাতে পারেন না।
মামলার পর তদন্তকালীন সময়ে একবার পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এরপর গত চার বছরে তিনবার পুলিশ এসেছে। বললেন, “মোর অপরাধ কী? মোর বাড়িত এত পুলিশ আসিল ক্যা। মোর কী মান-সম্মান নাই। মুই তো সাক্ষী হবার চাং নাই (চাইনি)।”
পুলিশ এতবার যাওয়ার পরেও কেন আদালতে আসেননি জিজ্ঞেস করলে বলেন, “মুই আরো দুইবার আচ্ছু। মোক কোটত ঢুকবারই দ্যায় নাই। মুই বারান্দাদি হাটি গেছু”।
কাজ করলে খাবার জোটে, না করলে অনাহারে থাকতে হয় সুলতানদের। আজ আদালতে আসায় তার একদিনের আয় খরচ হয়েছে। পাশাপাশি একদিন কাজ করতে না পারায় দু’দিনের ক্ষতি।
ক্ষোভ ঝাড়লেন, “মোর কাজটা মোখে করার নাগে। মোর ধান ঢুবি গেইছে। আইজ কোটত মোক আইসের হইল। আইজ সিনেসিন মুই কোট চিননু! এলা মুই সরকারি কামোত আইচ্ছো। মুই সাক্ষী দিনু। মোক এলা খরচ দ্যাও।”
কত্ত বড় সাহস… কোর্ট এর কাছে টাকা চায়! চিৎকার চেঁচামেচি করে! এবার তো দণ্ড দিতেই হবে।
আইনে আছে তল্লাসির সময় দুই বা ততোধিক সম্মানিত ব্যক্তির উপস্থিতিতে তল্লাসি করার। তবে পরের লাইনে এটাও বলেছে আদালত যদি বিশেষভাবে সমন দিয়ে তলব না করেন তাহলে তাদের হাজির হতে নির্দেশ দেয়া যাবে না [(সিআরপিসি, ১০৩(২)]। কিন্তু পুলিশ সুলতানকে অভিযোগপত্রে সাক্ষী মান্য করেছে। আমিও তাকে তলব করেছি। এখন, সুলতান তো আদালতের কাছে টাকা চাইতেই পারে।
আদালতে যারা সাক্ষী দিতে আসে তাদের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট, চিকিৎসক, পুলিশ, বিজিবি ইত্যাদি সকল সরকারি সাক্ষীই সরকারি খরচ পান। মজার ব্যাপার হচ্ছে আদালতের জজ সাহেব বেতন পান, উকিল সাহেব ফি পান, আদালত কর্মচারীরাও বেতন পান। কিন্তু যারা সুলতানের মত বেসরকারি সাক্ষী তাদের কোনো বেতন নেই, কোনো ভাতার ব্যবস্থা নেই। আমরা তাদের সময়মতো আদালতে প্রত্যাশা করি, না আসলে দণ্ড দেওয়ার হুমকি দেই। কিন্তু সরকারি সাক্ষীর বেলায় ২৪ বছর না আসলেও নীরব থাকি। বিষয়টি আমার কাছে স্ববিরোধীই মনে হয়।
আইন খুঁজে দেখলাম সিআরপিসির ৫৪৪ ধারায় প্রণীত বিধি সাপেক্ষে ফরিয়াদি ও সাক্ষীর যুক্তিসংগত খরচ প্রদানের বিষয় উল্লেখ আছে। আরো পেলাম, ১৯৮২ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের দুটো প্রজ্ঞাপন মূলে এরূপ সাক্ষীদের পথ খরচ, খাবার খরচ ও রাত্রিকালীন থাকার খরচ বৃদ্ধির আদেশ রয়েছে। এদেশের মানুষ দীর্ঘদিন এরূপ ভাতাও পেয়েছেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এটি আর পাচ্ছেন না। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর থেকেই দেখে আসছি এ খাতে কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই।
অথচ চীন, নিউজিল্যান্ড, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সংক্রান্তে বিধি-বিধান আছে। ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষা বিষয়ে পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের অনেক দেশ আইন প্রণয়ন করেছে। পাশ্ববর্তী ভারতেরও কয়েকটি রাজ্যে সাক্ষীদের উপস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্ট খরচের বিধান করে বিধিমালা করেছে।
আমাদের দেশে এরকম ভাতার নিয়ম বন্ধ হওয়ায় সাক্ষীরা আদালতে আসতে অনাগ্রহী হন, আসামীরা বছরের পর বছর বিচার ছাড়া আদালতে যাওয়া আসা করে হয়রানির শিকার হন। অথচ শুধু এরূপ সাক্ষীর ভাতা নিশ্চিত করা গেলে বেসরকারি সাক্ষীর উপস্থিতি কয়েকগুণ বাড়বে। নিষ্পত্তিও বাড়বে।
২০১৭ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট থেকে বাজেটে সাক্ষীদের খরচ বরাদ্দ দিতে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা আর আলোর মুখ দেখেনি। সাক্ষী সাক্ষ্য না দিলে সিআরপিসি ৪৮৫ ও ৪৮৫ক ধারায় যথাক্রমে অনধিক সাতদিন জেল এবং ২৫০ টাকা জরিমানার বিধান আছে সত্য। কিন্তু তাদের ন্যায্য যাতায়াত ভাতা প্রদান না করে অনুপস্থিত সাক্ষীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বিধানগুলো কাযর্কর করা যায় কী!
বি.দ্র. ঘটনা সত্য। সাক্ষীর প্রতি সম্মান রেখে নাম-পরিচয় গোপন করে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
পুনশ্চ, দণ্ড সুলতানকে দিলাম না, দিলাম নিজেকে। সে দণ্ড হলো বিবেকের।
লেখক: সাইফুল ইসলাম পলাশ; যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, কুড়িগ্রাম।