মো. রায়হান আলী: বিচার প্রার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল হল আদালত। আদালতের মাধ্যমে ন্যায় বিচারপ্রাপ্তি একজন নাগরিকের অধিকার। কেবল বিধিবদ্ধ আইনই নয়, আমাদের সংবিধানও নাগরিকের সে অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে,’সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’।
আমাদের সংবিধান বলছে, আইনের কাছে সমান আশ্রয় লাভের অধিকার শুধু অধিকারই নয়, মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত। মৌলিক অধিকার হচ্ছে এমন অধিকার যা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রদান করতে আইনত বাধ্য। অর্থাৎ রাষ্ট্র নাগরিকদের এসকল মৌলিক অধিকার বলবৎ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তবে আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিছু শর্ত ও পদ্ধতি আরোপ করেছে।
সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে কিছু শর্ত ও পদ্ধতির কথা বলা আছে যা পূরণ সাপেক্ষে মৌলিক অধিকার তথা আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রয়োগ করা যায়। বিদ্যমান আদালতের মাধ্যমেই মানুষের এ অধিকার প্রয়োগ করার বিধান আছে। রাষ্ট্র আদালতের মাধ্যমে নাগরিকদের এ অধিকার প্রয়োগ করে থাকে।
অর্থাৎ বিচার সংশ্লিস্টদের মাধ্যমেই বিচার প্রার্থীদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হয়। বিচার সংশ্লিস্টদের মধ্যে পড়ে আদালতের বিচারক,কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনজীবী ও আইনজীবী কর্তৃক নিযুক্তিয় ক্লার্ক ইত্যাদি। একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব বিচারপ্রার্থীদের আদালতের মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। আর এই ন্যায় বিচার নিশ্চিতে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। বর্তমানে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে অন্যতম হয়ে দাড়িয়েছে আদালতপাড়ায় টাউট,দালালের দৌরাত্ম্য। ইদানিং গণমাধ্যমেও এমন খবর সরব। নিয়ম অনুসারে বিচারপ্রার্থীদের মামলা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক সনদধারী একজন আইনজীবী। কিন্তু নিয়ম-নীতি কতটা প্রতিপালিত হচ্ছে সেটাই প্রশ্ন!
আমার ব্যক্তিগত পেশা হচ্ছে আইনপেশা অর্থাৎ আমি একজন বার কাউন্সিল কর্তৃক নিবন্ধিত আইনজীবী। গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার বিকালে হঠাৎ একটা অপরিচিত নম্বর থেকে আমার মোবাইলে কল আসলো আর অপর প্রান্ত থেকে বলছে স্যার আমি ওমুক, আমার ছেলেকে পুলিশ ধরেছে জামিন করাতে হবে। কালকেই জামিন করিয়ে দিন স্যার, ইত্যাদি ইত্যাদি।
জানতে চাইলাম কি মামলা? উত্তরে ভদ্রলোক বললেন, ১০ লিটার বাংলা মদসহ ছেলে গ্রেফতার। আমি বললাম, জামিন পেতে কিছুদিন সময় লাগবে তবে বিকেলে আমার চেম্বারে আসেন আগে, মামলার কাগজপত্র দেখতে হবে তারপর জামিন শুনানীর ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু নাছোড়বান্দা ওই ব্যক্তি বারবার বলছে, স্যার কালকেই আমার ছেলের জামিন হবে তো স্যার? আমি বললাম, ধৈর্য ধরেন বিকালে চেম্বারে আসেন মামলার কাগজপত্র দেখে বিস্তারিত কথা বলবো। ওই ভদ্র লোক সেদিন বিকালে আমার চেম্বারে আসলো না আর ফোনও দিল না।
এর কয়েকদিন পর সন্ধ্যায় আমার চেম্বারে ওই ভদ্রলোক হাজির। আমাকে সালাম দিয়েই কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছে, স্যার আমি দালালের খপ্পরে পড়েছি। সেদিন আপনার চেম্বারে আসার আগে ছেলেকে যখন কোর্টের গারদখানায়/হাজতখানায় নিয়ে এসেছিল আমিও আসছিলাম। তখন গারদখানার/হাজতখানার পাশে দাঁড়ানো একজন ব্যক্তি বলে, “তোমার ছেলেকে আমি কালকেই জামিন করাবো টাকা দেও, সব উকিল এসব আসামীর এত তাড়াতাড়ি জামিন করাতে পারে না”। তাই আমি তার কথা বিশ্বাস করে দুই ধাপে তাকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছি কিন্তু সপ্তাখানেক হলো আমার ছেলের জামিন করাতে পারলো না।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সে কি আইনজীবী? উত্তরে বলে না স্যার, সে দালাল। জামিন করানো তো দূরের কথা শুধু আরো টাকা চায়! কথাগুলো শুনেই আমারও খারাপ লাগলো যে, এভাবে বিচার প্রার্থীরা আদালত আঙ্গিনায় এসে প্রতারিত হচ্ছে! এমন অনেক বিচার প্রার্থীরা আদালত আঙ্গিনার বাইরে আইনজীবী ব্যতীত টাউট, দালালের খপ্পরে পড়ে মামলার ব্যয়ভার বহনে আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এ ক্ষতিতে তারা অনেকে হয়তবা গ্রামে গিয়ে বলে “কোর্টের লাল ইটেও টাকা খায়” অর্থাৎ সম্পূর্ণ বদনামটা বিচার সংশ্লিষ্টদের।
আসলে এ চিত্র শুধু খুলনার আদালতপাড়াতেই নয় বরং দেশের সব আদালত আঙ্গিনায় এমন টাউট, দালালের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেক বিচারপ্রার্থী-এমন খবর পত্র-পত্রিকাগুলোতেও আসছে। সম্প্রতি সরকার নিবন্ধিত আইন বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল “ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম”-এ প্রকাশিত খবরের হেডলাইন “সনদ ছাড়াই চেম্বার খুলে প্র্যাকটিস, মামলা গ্রহণকালে হাতেনাতে আটক”।
সংবাদে বলা হয়- “বার কাউন্সিলের সনদ ছাড়াই চেম্বার খুলে দীর্ঘদিন যাবৎ দিব্যি নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্র্যাকটিস করে যাচ্ছেন। শুধু জজ কোর্ট নয়, তার চেম্বার আছে সুপ্রিম কোর্টেও! বিচারপ্রার্থীদের সাথে প্রতারণা করে গ্রহণ করছিলেন মামলাও। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের টাউট উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার সময় ধরা পরেন আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণাকারী এক টাউট।ঢাকার অধস্তন আদালত এলাকার কোর্ট হাউজ স্ট্রিটের পারজোয়ার সেন্টার থেকে নুর নবী (স্বপন) নামের ওই টাউটকে আটক করা হয়। এসময় তার চেম্বারে আইনজীবী হিসেবে পরিচয়ে দিয়ে বানানো ভিজিটিং কার্ড, অ্যাডভোকেট সীল পাওয়া গেছে।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট আবু সুফিয়ান ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এই আইনজীবী জানান, আটককৃত ব্যক্তি এখনো আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হননি। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ আইনজীবী হিসেবে পরিচয়ে দিয়ে ভিজিটিং কার্ড, অ্যাড.সীল এবং নিজের নামে চেম্বার ভাড়া নিয়ে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করে আসছেন।
অ্যাডভোকেট সুফিয়ান আরো বলেন, আজ ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের টাউট উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার সময় পারজোয়ার সেন্টারের রুম নং- বি-১৭ হতে ক্লায়েন্টসহ মামলা রিসিভ করার সময় তাকে আটক করি। আইনজীবীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদ কর্তৃক টাউট উচ্ছেদ অভিযান নিয়মিত পরিচালিত হবে বলেও জানান তিনি।”
এমন ঘটনা দেশের বিভিন্ন আদালত পাড়ায় হরহামেশাই ঘটছে। আদালতপাড়া থেকে ভুয়া আইনজীবী, টাউট, দালাল, ভুয়া মুহুরি, ক্লার্ক শনাক্ত করে বিভিন্ন আইনজীবী সমিতি ব্যবস্থাও নিচ্ছে। কিন্তু তাতেও মনে হয় এ অপরাধ কমছে না। এ সমস্যাটি নিরসনে ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল হয়।
রিট আবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাক্টিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২ এর ৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনপেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে বার কাউন্সিল সনদপ্রাপ্ত হতে হবে। অন্যথায় ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বার কাউন্সিল এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়ায় আদালত অঙ্গনে টাউট-দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে”।
এর প্রেক্ষিতে সারাদেশের আইন অঙ্গন থেকে টাউট,দালাল,ভুয়া আইনজীবীদের দৌরাত্ম ও তৎপরতা বন্ধে কার্যকরি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। দুই মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত আবেদন নিষ্পত্তি করে বার কাউন্সিল সচিবকে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত। (তথ্যসূত্রঃ দৈনিক প্রবর্তন, ২ মার্চ, ২০২০ ইং)।
আদালতপাড়ার এ সমস্যা নিরসনে আইনজীবী সমিতিগুলো বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। কিন্তু সমস্যাটি সমাধানের কার্যকর পদক্ষেপ কতটুকু নেয়া হয়েছে এটাই এখন বড় প্রশ্ন। যদিও সাধারণ জনগণ আগের চেয়ে কিছুটা সচেতন হয়েছে। তথাপিও টাউট-দালালদের খপ্পর থেকে রেহাই পেতে মামলা-মোকদ্দমা সংক্রান্ত বিষয়াদি থাকলে সরাসরি একজন আইনজীবীর পরামর্শ নিতে হবে।
বিচারপ্রার্থীদের আইনজীবী ব্যতীত কারো কাছে আইনি পরামর্শ ও আর্থিক লেনদেন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আদালতপাড়া থেকে টাউট-দালাল নির্মূল করতে হলে বিচারপ্রার্থীদের নিজে আরো সচেতন হতে হবে। এ বিষয়ে বার সমিতিগুলোর আরো পরিকল্পিত গৃহীত পদক্ষেপই আদালতপাড়া টাউট-দালালমুক্ত করতে সক্ষম হতে পারে।
লেখক: আইনজীবী; জজ কোর্ট, খুলনা। Email: advrayhan520@gmail.com