সিরাজ প্রামাণিক: বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে বাংলাদেশীদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর (UNHCR) এর পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশীদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গেল কয়েক বছরের তুলনায় ১০ গুণ বেড়েছে। অনেকেই বিদেশে গিয়ে দেশে না ফেরার ফন্দিতেই আবেদন করে থাকেন। আবার বিদেশে গিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের বা অ্যাসাইলাম আবেদন করে থাকেন অনেকেই।
অ্যাসাইলাম হচ্ছে অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রাজনৈতিক শরণার্থী। কোনো দেশে যদি আপনার জীবন হুমকির মুখে থাকে বা আপনাকে রাজনৈতিক কারণে যদি আপনার জীবননাশের আশংকা থাকে তাহলে এর প্রমাণ সাবমিট (দাখিল) করে বিদেশের অনেক দেশে অ্যাসাইলাম ভিসা নেওয়া যায়। এই ভিসা নিয়ে আপনি সেই দেশে স্থায়ী এবং বৈধভাবে বসবাস করতে পারবেন।
তবে এ ভিসা পেতে আপনার জীবন যে এই দেশে ঝুঁকিপূর্ণ তা কিন্তু প্রমাণ করতে হবে। বিশেষ করে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হেনস্তা করতে কিংবা বিপক্ষ দলকে দূর্বল করতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মামলায় জড়ানো কিংবা প্রকৃত অপরাধীরাও নিজেদের কৃত অপরাধের ফলে সৃষ্ট মামলা কিংবা যে কোনো ধর্মীয়, জাতি বা গোষ্ঠীগত কোনো সমস্যার কারণে কোনো ব্যক্তি যদি নিজ রাষ্ট্রকে অনিরাপদ মনে করে তবে যথাযথ কারণ দেখিয়ে অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের কাছে বসবাসের জন্য তিনি বা তারা আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারে।
আপনি যে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চান, সে দেশের দূতাবাসে নির্দিষ্ট আবেদনপত্রে আবেদন করতে হয়। আবেদনপত্রে আশ্রয় চাওয়ার কারণ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করতে হয়। এখানে যে ঘটনার কারণে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে, সেই ঘটনার বিবরণসহ তারিখ দিতে পারলে আশ্রয় প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশি থাকে। সম্ভব হলে ঘটনার কোন লিখিত সংবাদ প্রতিবেদন থাকলে তা আবেদনপত্রের সাথে যুক্ত করে দেওয়া ভাল। এর বাইরে নিজের পরিচয়, পেশা, ও রাজনৈতিক আদর্শ সতর্কতার সাথে দিতে হবে।
এছাড়া রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীকে নিজ দেশের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বর্ণনা দিতে হবে। আবেদনপত্র যে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে সে দেশের এই সংক্রান্ত অধিদপ্তর বরাবর প্রেরণ করতে হবে। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের আবেদন নির্দিষ্ট দেশটির কর্মকর্তারা ও শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় আবেদনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ শরনার্থী কমিশন আবেদনপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। সবকিছু প্রার্থীর পক্ষে গেলে দেশটির আইন অনুসারে প্রার্থীকে রাজনৈতিক শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণের আবেদনটি গ্রহণ করবেন।
আবেদনপত্র তিন মাসের মধ্যে গৃহীত হয়ে থাকে। তবে ব্যক্তির রাজনৈতিক গুরুত্বের ওপরে সময় কম লাগতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গৃহীত হলে, এক বছরের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণকারীকে গ্রীণ কার্ড দেওয়া হয়। সেখানে তিনি আর দশজনের মত কাজ করার সুযোগ পাবেন। কোন রাজনৈতিক আশ্রয়কারী যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ বছর বাস করার পর দেশটিতে স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভ করতে পারেন। তবে অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে আবেদনকারীর বাধ্যতামূলক জবাবদিহি শিবিরে থাকতে হবে। এখানে আবেদনকারীকে সর্বোচ্চ ৭৪ দিন বাস করতে হতে পারে। কানাডা রাজনৈতিক বা যুদ্ধ শরণার্থীদের অতি সহজেই আশ্রয় দান করে। এই দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণকারীরা আর দশ জনের মতই কাজ করতে পারে।
রাজনৈতিক আশ্রয় একটি আন্তর্জাতিক মৌলিক মানবাধিকার। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৪ (ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে যে, নিজ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বা আদর্শগত কারণে নিপীড়ন বা গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির অন্য রাষ্ট্রের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করার এবং আশ্রয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই অধিকার যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো রাষ্ট্রের কাছেই চাইতে পারে। যে কোনো রাষ্ট্র নীতিগত দিক থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে বাধ্য। তবে এর দুটি ব্যতিক্রম রয়েছে।
প্রথমত: যদি সম্ভাব্য আশ্রয় প্রদানকারী রাষ্ট্রের নিজের জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো সন্দেহ থাকে তখন ঐ রাষ্ট্র আবেদনকারী ব্যক্তিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে বাধ্য নয়।
দ্বিতীয়ত: আশ্রয়ের আবেদনকারী যদি গুরুত্বর কোনো অপরাধে বা ওই ব্যক্তির নিজ দেশের সমাজের জন্য বিপজ্জনক কোনো অপরাধের অপরাধ হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকে, তাহলেও ওই ব্যক্তিকে কোনো রাষ্ট্র রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান থেকে নির্দ্বিধায় বিরত থাকতে পারে।
রাজনৈতিক আশ্রয় নিতান্তই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বহিঃপ্রকাশ, যা হতে পারে প্রথার ভিত্তিতে কিংবা চুক্তির ভিত্তিতে। আবার আশ্রয় দানকারী রাষ্ট্রের আশ্রয় দানের ক্ষমতাকে অঞ্চলের ভিত্তিতে ভূখণ্ডগত ও অতি-রাষ্ট্রিক আশ্রয় এ দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তির কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কারণে গ্রেপ্তার, নির্যাতন, হুমকির ইত্যাদির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সেই ব্যক্তি অন্য কোনো রাষ্ট্রে প্রবেশ করে সেই রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় চাইতে পারেন। তখন ওই রাষ্ট্র সেই ব্যক্তিকে তাদের নিজ ভূখণ্ডে আশ্রয় প্রদান করতে পারে।
আবার জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যায় আশ্রয়প্রার্থী থাকলে তখনও নিজ রাষ্ট্রের জনগণের জন্য হুমকি সৃষ্টি হতে পারে এমনটা ভেবে আশ্রয় নাও দিতে পারে। তবে ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ভূখ-গত আশ্রয় সংক্রান্ত ঘোষণা বলছে, নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আশ্রয় প্রার্থীকে রাষ্ট্রীয় সীমানায় চেকপয়েন্টে প্রত্যাখান করা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি ভূখ-ে প্রবেশ করেই থাকে তাহলে তাকে ফেরত পাঠানো যাবে না।
শুধু নিজ ভূখণ্ডে নয় এর বাইরে গিয়েও একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারে। যে রাষ্ট্র তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে প্রস্তুত, সেই রাষ্ট্রের দূতাবাসে প্রবেশ করলেই ওই দূতাবাস তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারবে। কেননা প্রত্যেক দেশে নিযুক্ত হাই কমিশনাররা যে দূতাবাসে অবস্থান করেন তা তাদের রাষ্ট্রের ভূখ- হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই নিজ দেশে থেকেও অন্য দেশের দূতাবাসে ‘রাজনৈতিক ‘আশ্রয়’ নেয়া সম্ভব।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com