দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় টাকার বিনিময়ে চলা বিতর্কিত ‘সান্ধ্য কোর্স’ বন্ধসহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পরামর্শ মেনে না চলার বিষয়ে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা, জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে আজ সোমবার (৬ জুন) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।
ইউজিসিকে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে দেশের ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ইউজিসি আদেশ, ১৯৭৩ এর বিধান মতে কি আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানাতে বলা হয়েছে।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ।
আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে এই আইনজীবী জানান, দেশের ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করাসহ কিছু পরামর্শ প্রদান করে। কিন্তু সেসব পরামর্শ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেনে চলতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকলেও তা প্রতিপালন করেনি।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এবিষয়ে অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে, ইউজিসির পরামর্শ না মেনেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্ব স্ব ইচ্ছায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ক্যাব চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি মাননীয় আচার্য মহোদয়ের নিকট প্রয়োজনীয় গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করে, যা ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে।
তারপরও কোনো প্রকার ব্যবস্থা না নেয়ায় গত ২৯ মে উচ্চ আদালতে রিট দরখাস্ত দায়ের করে। রিটের শুনানি শেষে হাইকোর্ট আজ রুল জারি করেছেন জানিয়ে ব্যারিস্টার বড়ুয়া আরো বলেন, ইউজিসিকে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ইউজিসি আদেশ, ১৯৭৩ এর বিধান মতে কি আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানাতে বলা হয়েছে।
ইউজিসির ১৩ পরামর্শ
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইউজিসি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় টাকার বিনিময়ে চলা বিতর্কিত ‘সান্ধ্য কোর্স’ বন্ধসহ ১৩ দফা পরামর্শ দেয়। ইউজিসির মতে, সান্ধ্য কোর্স পরিচালনা করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বিধায় এসব কোর্স বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ইউজিসির ওই পরামর্শপত্রে বলা হয়, দেশের কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই নতুন বিভাগ, প্রোগ্রাম ও ইনস্টিটিউট খুলে শিক্ষার্থী ভর্তি করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা হচ্ছে। এমনকি পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে। সরকারের আর্থিক বিধি লঙ্ঘন করে দেওয়া হচ্ছে ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা।
এতে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে উপাচার্যরা মেধা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালন করে যাচ্ছেন। তবু নানা কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়মনীতি প্রতিপালনে শিথিলতা দেখা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষা প্রশাসনে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, যা কাম্য নয়।
সান্ধ্য কোর্স বন্ধের পরামর্শ ছাড়াও ১৩ দফা নির্দেশনার মধ্যে আরও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন অনুষদ, বিভাগ, প্রোগ্রাম বা ইনস্টিটিউট খোলার ক্ষেত্রে ইউজিসির পূর্বানুমোদন, নতুন পদ সৃজনে ইউজিসির পূর্বানুমোদন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও সরকারের নিয়মনীতি প্রতিপালন, বিধিবহির্ভূতভাবে ‘সেশন বেনিফিট’ সুবিধা প্রদান এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিম্নতর গ্রেড থেকে উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত না করা।
এ ছাড়া সরকারি আর্থিক বিধিমালা অনুযায়ী আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করা, ক্যাম্পাসে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নেওয়া, শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে হল, অফিস ও ক্যাম্পাসের সর্বত্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যৌন হয়রানি, র্যাগিং, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া, নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু এবং পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ, একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং এসব বিষয়ে প্রয়োজনে ইউজিসির পরামর্শ নেওয়া।
এক নজরে ইউজিসির ১৩ পরামর্শ
১) বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন অনুষদ, বিভাগ, প্রোগ্রাম ও ইনস্টিটিউট খোলা এবং নতুন পদ সৃষ্টি বা বিলুপ্তির ক্ষেত্রে কমিশনের পূর্বানুমোদন নেওয়া।
২) কমিশনের অনুমোদন ব্যতিরেকে নতুন পদ সৃজন বা বিলুপ্ত করা বিধিসম্মত নয়।
৩) শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, বিধিবিধান এবং সরকারের নিয়মনীতি প্রতিপালন করা অবশ্য কর্তব্য।
৪) বিধিবহির্ভূতভাবে ‘সেশন বেনিফিট’ সুবিধা দেওয়া এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিম্নতর গ্রেড থেকে উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত করা বাঞ্ছনীয় নয়।
৫) সরকারি ‘আর্থিক বিধিমালা’ অনুযায়ী আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা সংশ্লিষ্ট সবার জন্য প্রতিপালনীয়।
৬) ক্যাম্পাসে শিক্ষানুকূল শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অব্যাহত রাখা বাঞ্ছনীয়।
৭) শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে আবাসিক হল, কার্যালয় ও ক্যাম্পাসের সর্বত্র নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।
৮) যৌন হয়রানি, র্যাগিং, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
৯) সান্ধ্য কোর্স পরিচালনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বলে সান্ধ্য কোর্স বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
১০) নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু, পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা ও ফল প্রকাশ।
১১) তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ।
১২) একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
১৩) একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রমসহ যেকোনো বিষয়ে প্রয়োজনে কমিশনের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।