সাইফুল ইসলাম পলাশ: গতকাল পত্রিকায় দেখলাম, তথ্য অধিকার আইন অনুসারে সুপ্রিম কোর্টে ৬০ দিনের মধ্যে তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি মাননীয় বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মাননীয় বিচারপতি খিজির হায়াত মহোদয়গণের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুলসহ এই আদেশ দেন।
মনে পড়ে গেল ৫ বছর আগের কথা। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে রাজশাহী চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নতুন ৮ তলা বিল্ডিং উদ্বোধন হয়। তখন সিজেএম ছিলেন আল আসিফ মোঃ আসিফুজ্জামান স্যার। বিল্ডিং উদ্বোধনের পর পরই তিনি আমাকে বিল্ডিং ইনডেক্স বোর্ড করার নির্দেশ দিলেন। বললেন, “নতুন বিল্ডিং কোথায় কী সমস্যা খেয়াল রাখ। বিচার প্রার্থীদের যাতে সমস্যা না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে”। পাশাপাশি বিল্ডিং মনিটরিং করার জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে দু’পাশের দু’গেটে দু’জন করে জারীকারক রাখার দায়িত্ব দিলেন। সামনের গেটে একটা টেবিল দিয়ে নাম দেয়া হলো হেল্প ডেস্ক।
স্যার আমাকে ৪/৫ হাজার টাকা দিলেন। সেখানে একটা কক্ষে ফিল্টার পানির ব্যবস্থা করতে বললেন। মোশারফ হোসেন ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ স্টাফ। বলার আগেই সব কাজ হয়ে যায় এমন। সে হিসেবে পরের দিনই একটা ইনডেক্স বোর্ড করা হলো। ড্রিংস কর্নার স্থাপন করে বিচার প্রার্থীদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হল। এভাবে চলতে চলতে আসিফুজ্জামান স্যার ঢাকায় বদলী হয়ে গেলেন।
২০১৮ সালের মে মাসে সিজেএম হিসেবে মুহাঃ হাসানুজ্জামান স্যার জয়েন করলেন। নতুন স্যার জয়েন করার অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমাকে নেজারতের দায়িত্ব দিলেন। হেল্প ডেস্ক চলছিল একই নিয়মে শুধু জারীকারক দিয়ে। কিন্তু একটা শূণ্যতা অনুভব করছিলাম। বার বার মাথায় ঘুরপাক খায় এই ডেস্ক থেকে মানুষ আর কী কী সুবিধা পেতে পারে।
আদালতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ আসে। কিন্তু আদালতে আসলে সবাই বোকা হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও আদালতের কার্যক্রম বোঝে না। আমার এক আত্নীয় একবার বললেন, যে উকিল সাহেব চেম্বারে এত সুন্দর করে কথা বলে সেই একই ব্যক্তি আদালতে পাত্তা দেয় না কেন? বললাম, উকিল সাহেবের তো এক মামলা থাকে না। একই সময়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা উঠে। মামলার চাপে এমন করে হয়তো। আমার কথায় তিনি সন্তুষ্ট হন নি।
তার সাথে কথা বলে বুঝলাম, একজন বিচার প্রার্থীর মনে নানা প্রশ্ন থাকে। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর সময় নিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে আদালতে এমন একটা পয়েন্ট থাকা দরকার যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের মনে থাকা প্রশ্নগুলো করতে পারবে। কোন আদালতে কী কাজ হয়, কোন দপ্তরটা কোথায়, মামলার স্তর, জামিন প্রক্রিয়া, নকল প্রাপ্তি পদ্ধতি, মামলা সম্পর্কে ইত্যাদি যেকোনো তথ্য বা সাধারণ কোনো পরামর্শ যেন একটি পয়েন্ট থেকেই পাওয়া যায়।
এ বিষয় নিয়ে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন পড়ে দেখলাম। উক্ত আইনের ৪ ধারা অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আর তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই উক্ত আইন অনুসারে কোনো নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উক্ত আইনের ৭ ধারায় বর্ণিত বিধি নিষেধ সাপেক্ষে তথ্য সরবারাহ করতে বাধ্য থাকবে [ধারা-৪ ও ৭ ]।
এখানে কর্তৃপক্ষ বলতে সাংবিধানিক সংস্থা, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কার্যালয়, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, সরকারী অর্থায়নে পরিচালিত বা সরকারের সাথে বা সরকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি মোতাবেক পরিচালিত কোনো বেসরকারী সংস্থাকে বুঝাবে [ধারা-২ এর (খ) ]। এই আইনে নাগরিকের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এরূপ প্রত্যেক অফিসে একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার বিধানও আছে [ধারা-১০]। তাছাড়া এটি আমাদের বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তির কৌশলগত উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে বিচার প্রাপ্তিতে অভিগম্যতার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ।
হাসানুজ্জামান স্যারকে জানালাম আমার ভাবনার কথা। স্যারকে বললাম “আইনগত তথ্য ও সেবা কেন্দ্র’’ নামে আদালতের নীচতলায় একটি কাচে ঘেরা পয়েন্ট করা যায়। এখানে অফিসের ২ জন স্টাফ পর্যায়ক্রমিকভাবে বসবে। একটি অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থাকবে যা প্রতিদিন আপডেট করা হবে। “আদালত বার্তা” নামে একটি বোর্ড থাকবে যেখানে আদালতের গুরুত্বপূর্ণ রায় ও আদেশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, নিলাম বিজ্ঞপ্তি, জনস্বার্থ বিষয়ক প্রশাসনিক আদেশ থাকবে। দুটো হোয়াইট বোর্ডে থাকবে চলতি মাসসহ সারা বছরের মামলা দায়ের, নিস্পত্তি, সাজা, খালাস ও সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয় লিপিবদ্ধ থাকবে। হাসানুজ্জামান স্যার আমার কথা শুনে একবাক্যে রাজী হয়ে গেলেন। আমাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বললেন।
আমি এ বিষয় নিয়ে গণপূর্ত বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার অমিতদার সাথে কথা বললাম। তিনি দ্রুততার সাথে চিহ্নিত জায়গাটি ইট-সিমেন্ট দিয়ে ঘিরে দিলেন। একটু টাইলস করে সাজিয়ে দিলেন। সচিত্র আইন শিক্ষার জন্য দু’একটি মানবাধিকার সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা হলো। জার্মান দাতা সংস্থা জিআইজেড এর সাথে যোগাযোগ করা হল। তারা জানালেন হেল্প ডেস্ক নিয়ে তারাও কাজ করতে চান। তাদের জামিনের পদ্ধতি, বিচার প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে কিছু ডিজিটাল ফেস্টুন আছে। ইতোমধ্যে তারা মাদারীপুরে হেল্প ডেস্কে সহযোগিতা করেছেন। সেখানে একজন অফিস স্টাফের পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষিত একজন প্যারালিগ্যাল টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে। আমাদের এখানেও এমন সহযোগিতা করতে চাইলেন। জিআইজেড আরো কিছু দৃশ্যমান ম্যাটেরিয়াল দিয়ে সহযোগিতা করলেন।
ইতোমধ্যে হাসানুজ্জামান স্যারের বদলির আদেশ হলো। ১৫ নভেম্বর চার্জ দিতে হবে। কিছু কাজ অসমাপ্ত থাকলেও সেদিনই উদ্বোধনের জন্য দিন ধার্য করা হলো। স্যারের আকস্মিক বদলিজনিত কারণে ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু সেদিন সকাল থেকে তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে লাল-নীল ব্যানার ফেস্টুনে ভরে গিয়েছিল। কষ্টের মাঝে একটা উৎসবের ছোঁয়াও ছিল। জারীকারক সাজু হোয়াইট বোর্ড দু’টি স্বল্প সময়ে সুন্দর করে মামলার পরিসংখ্যান আর্ট করলেন।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মাননীয় জেলা জজ মীর শফিকুল আলম স্যার লাল ফিতা কেটে আইনগত তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন করলেন। সেদিন বক্তারা সবাই বললেন, এটি যেন শুধু রাজশাহী ম্যাজিস্ট্রেসির নয়; জেলার সমগ্র আদালত ও ট্রাইব্যুনালেরও হেল্প ডেস্ক হিসাবে কাজ করে।
এটি চালু হওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেসির স্টাফের সাথে প্যারালিগ্যালরা দারুণ সমন্বয় করে কাজ করছিল। সেখানে পরবর্তীতে সাক্ষী সহায়তা সেলও যুক্ত করা হয়। কোনো গুরুত্বপূর্ণ রায়-আদেশ হলে তাৎক্ষনিকভাবে সেটা চলে যাচ্ছিল আদালত বার্তায়। আমি নিজে প্যারালিগ্যালদের ডেকে এ বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে “আইনগত তথ্য ও সেবা কেন্দ্র “ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বাড়ছিল। রঙ্গিন কাগজে সাটা আদালতের নিউজগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল।
আমার কাছে মনে হলো প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আদালতে আসে। তাদের কাজ শুধু থাকে ১টি মামলায় হয়তো আধাঘণ্টার জন্য। কারো হয়তো ৫ মিনিটের একটা হাজিরা। কিন্তু এজন্য তাকে পুরো দিনটাই আদালতে থাকতে হয়। মনে হল এখানে আইনের কিছু সহজপাঠ্য বই থাকলে দারুণ হতো। এই সেবাকেন্দ্রের সাথে আদালত ভিত্তিক মিনি পাঠাগার স্থাপনের কথা মনে হলো। আরডিআরএস বাংলাদেশ, ব্লাস্ট, আইন ও সালিস কেন্দ্রসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের এমন সহজবোধ্য কিছু বই ছিল। আমি সেই চিন্তা করে একটা বুক সেলফও সেখানে নামিয়েছিলাম। কিন্তু বইগুলো আর খুঁজে পাইনি।
পরে জানলাম জিআইজেড ‘আদালত বার্তা’ অংশটি বাদ দিয়ে দেশের ২৮টি জেলায় আইনগত তথ্য ও সেবা কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। গতকাল জানলাম তাদের প্রকল্প এলাকার সবগুলোতে তারা এটার বাস্তবায়ন করেছে। ভীষণ ভালো লাগলো জেনে। কৌতুহলবশত গতকাল খোঁজ নিয়ে জানলাম, গত ০৪ বছরে রাজশাহীর এই তথ্য ও সেবা কেন্দ্র হতে ২ হাজার ১৭১ জন সেবাগ্রহীতাকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সেবা প্রদান করা হয়েছে। রেজিস্টার অনুসারে এদের মধ্যে পুরুষ ১ হাজার ৪৩৬ জন এবং নারী ৭৩৫ জন। এই সংখ্যার বাইরে তারা বিভিন্ন জনকে পরামর্শও দিয়েছেন।
খুব ছোট্ট একটা বিষয়। অথচ হাজার মানুষের উপকার। আইনি সেবা সহজীকরণে এবং জনগণের বিচারের অভিগম্যতায় আইনগত তথ্য ও সেবা কেন্দ্র দারুণ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আদালতসমূহে তথ্যের এই সরবরাহে নিঃসন্দেহে সেখানে কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আরো বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণের মধ্যে তথ্যের মালিকানাবোধ সৃষ্টি হবে। তাই আইনের মধ্যে থেকে জনগণকে তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করতে হবে। জনগণ ক্ষমতায়িত না হলে কোনো সামষ্টিক উন্নয়ন অর্জন সম্ভব নয়।
লেখক: মো. সাইফুল ইসলাম, বিচারক (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), প্রাবন্ধিক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা।