কক্সবাজার থেকে মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী: চার বছরের শিশু হত্যাকে করে গুম করার অপরাধে এক নারীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে দুই লক্ষ ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড, অনাদয়ে আরো এক বছর এক মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুল্লাহ আল মামুন মঙ্গলবার (৭ জুন) এ রায় ঘোষণা করেন।
যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত আসামি হলেন- চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নলবুনিয়া গ্রামের ছৈয়দ হোসনের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালু (২২)।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন এডিশনাল পিপি অ্যাডভোকেট মোজাফফর আহমদ হেলালী এবং আসামী পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মোস্তফা।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
২০১২ সালের ৬ অক্টোবর কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নলবুনিয়া গ্রামের ছৈয়দ আকবরের স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। ছৈয়দ আকবর ও ছেনুয়ারা বেগম হাসপাতালে থাকায় তাদের ৪ বছরের শিশু পুত্র রিফাত’কে তাদের বাড়িতে দেখাশুনা করার জন্য ছৈয়দ আকবর বৃদ্ধা মা’কে দায়িত্ব দেন।
২০১২ সালের ৭ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে রিফাত হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে রিফাতের দাদী রিফাতের চাচী জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালু’র কাছে রিফাতকে কোথাও দেখেছো কিনা সেটা জানতে চাইলে রিফাতকে টয়লেটের দিকে যেতে দেখেছেন বলে জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালু রিফাতের দাদীকে জানান।
জাকিয়া সুলতানা’র কথামতো রিফাতের দাদী রিফাতকে খুঁজতে টয়লেটের সেফটি ট্যাংকের দিকে গেলে ঢাকনাবিহীন খোলা সেফিটি ট্যাংকের ভেতরে রিফাতকে ভাসতে দেখেন। তখন রিফাতের দাদী শোর চিৎকার করলে স্থানীয় ও বাড়ির অন্যান্য লোকজন এসে সেফটি ট্যাংক থেকে রিফাতের মরদেহ উদ্ধার করে।
পারিবারিক বিরোধের জের ধরে জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালু ৪ বছরের শিশু রিফাতের পিতা-মাতার অনুপস্থিতিতে কোমলমতি রিফাতকে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য জন্য সেফটি ট্যাংকে ফেলে দেয় বলে স্থানীয় লোকজন আইনশৃংখলা বাহিনীকে জানায়।
এ ঘটানায় অবুঝ শিশু রিফাতের পিতা ছৈয়দ আকবর বাদী হয়ে ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি রিফাতের চাচী জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালুকে আসামী করে চকরিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার চকরিয়া থানা মামলা নম্বর: ২০/২০১৩, জিআর মামলা নম্বর: ২০/২০১৩ এবং এসটি মামলা নম্বর: ৬০৮/২০১৩ ইংরেজি। ফৌজদারি দন্ডবিধির ৩০২/২০১ ধারা।
এ মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালত জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালু’র ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ডে আসামী জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালু রিফাতকে হত্যার কথা স্বীকার করে।
বিচার ও রায়
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) চকরিয়া থানার এসআই মোঃ জামাল হোসেন ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেন। যার নম্বর ৮১।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর মামলাটির চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয় এবং ২০১৯ সালের ১২ মে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত হতে মামলাটি বিচারের জন্য কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করা হয়।
অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলার ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ, আসামী পক্ষে সাক্ষীদের জেরা, জব্দ করা খুনের আলামত প্রদর্শন, সুরতহাল, ময়নাতদন্ত, ফরেনসিক প্রতিবেদন যাচাই ও পর্যালোচনা, যুক্তিতর্ক শেষে বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন আসামি জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালু’কে দোষী সাব্যস্থ করে রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে আসামিকে ফৌজদারী দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ২ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড প্রদান, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো এক বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন। একই রায়ে রিফাতকে হত্যা করে লাশ গুম করার অপরাধে ফৌজদারী দন্ডবিধির ২০১ ধারায় আসামী জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালুকে ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদয়ে আরো এক মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করছেন।
সকল কারাদন্ড একই সাথে চলবে বলে বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর রায়ে উল্লেখ করেন। অর্থদন্ডের ২ লক্ষ ৫ হাজার টাকার মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সাপেক্ষে ৫ হাজার টাকা মামলা পরিচালনার খরচ বাবদ রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা করার এবং অবশিষ্ট ২ লক্ষ টাকা খুন হওয়া শিশু রিফাতের পিতা ও মামলার বাদী ছৈয়দ আকবরকে প্রদান করার জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর রায়ে আদেশ দেন।
মামলার রায়ে বিচারক তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, দন্ডিত আসামি জাকিয়া সুলতানা প্রকাশ লালু একজন নারী, তার বয়স কম, তার শিশু সন্তান রয়েছে, অভ্যাসগত অপরাধী নয়, তার আগে কোন ফৌজদারি মামলা নেই এবং তার আগের রেকর্ড ভাল বিবেচনায় মৃত্যুদন্ডের অপরাধ করলেও তাকে মৃত্যুদন্ড কিংবা আমৃত্যু কারাদন্ড না দিয়ে শুধুমাত্র যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেছেন।