বিদায় বেলায় অনুভূতির গল্প বললেন চকরিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার দেব

বিদায় বেলায় অনুভূতির গল্প বললেন চকরিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার দেব

অর্পিত দায়িত্ব তিনবছর ছয়মাস কর্মস্থলে সুনাম আর দক্ষতার সাথে পালন শেষে বদলি জনিত বিদায় বেলায় কর্মস্থলের নানা স্মৃতি তুলে ধরে চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার দেব লিখেছেন ভালোলাগা আর অনুভূতির গল্প।

কক্সবাজারস্থ তিনটি চৌকি আদালতের মধ্যে চকরিয়া চৌকি একটি গুরুত্বপূর্ণ আদালত। এই চৌকির আওতাধীন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত দুইটি উপজেলার (চকরিয়া ও পেকুয়া) এখতিয়ারাধীন ফৌজদারি মামলা সমূহের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। স্বাভাবিক ধারণায় ভৌগোলিক অবস্থান ও ৩য় ক্যাটাগরির জেলার একটি চৌকি হিসেবে এই আদালত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মামলার সংখ্যা, বিজ্ঞ আইনজীবী ও তাদের সহযোগীদের সংখ্যা, কোর্ট স্টাফ ও কোর্ট পুলিশ এবং মামলায় পক্ষ দ্বয়ের সংখ্যা ও দৈনন্দিন বিচার প্রার্থীদের উপস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের একটি ব্যস্ততম চৌকি আদালত বলা যায়।

চকরিয়া চৌকির আওতাধীন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক হিসেবে পদায়নের পর তিন বছর ছয় মাস চৌদ্দ দিন অতিক্রম করে একটি বিচারিক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটালাম। এই কর্মকালীন বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় বহু ঘটনা, আবেগ অনুভূতি, বাস্তবতা, ভাললাগা, ভালবাসা স্মৃতির ভান্ডারে পাকাপোক্ত হয়েছে।

চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা দ্বয়ে ২৫টি গ্রাম আদালত আছে। আমি আমার কর্মকালে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নিয়মিত গ্রাম আদালতে মামলা প্রেরণ করেছি। আমার কর্মকালে মিথ্যা তথ্য বা মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করার কারণে সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযোগ আনয়নকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।

এই আদালতে দুইটি পৃথক বিচারাধীন মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছি অভিযুক্ত হিসেবে দুইজন শিক্ষক ছিলেন যারা পৃথক “বিচারাধীন মামলা কারণে” সরকারি চাকুরী হতে বরখাস্ত হয়ে মামলা পরিচালনা করে যাচ্ছেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে রায় পর্যায়ে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় দুইটি মামলায় দুইজন অভিযুক্ত শিক্ষককে খালাস দেওয়া হয় এবং বকেয়া বেতনসহ তাদের সরকারি চাকুরি ফেরতের জন্য সংশ্লিষ্টকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি মামলায় মাননীয় সেশন্স আদালত ও মাননীয় হাইকোর্ট উভয়ে আমার দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন এবং মামলাটি বর্তমানে মাননীয় আপীল বিভাগে বিচারাধীন থাকলেও আমার প্রদত্ত রায়টি স্টে করা হয় নাই মর্মে জেনেছি (নথিসূত্রে)। আমার রায়ের নির্দেশনা মতে ইতমধ্যেই উক্ত মামলার অভিযুক্ত শিক্ষককে চাকুরী ফেরত দেওয়া হয় এবং চাকুরী করে যাচ্ছেন।

আমার আদালতে কিছু মামলায় দেখেছি ঘটনাস্থল বন বিভাগের জায়গা কিন্তু সেখানে অভিযুক্তরা অবৈধভাবে দখলে আছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে ঘটনাস্থল উদ্ধারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া সংবাদ মাধ্যম হতে তথ্য জেনে চকরিয়া পেকুয়া এলাকায় বেদখলকৃত সরকারি জায়গা উদ্ধারে স্যু মোটো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমার স্যু মোটো পদক্ষেপে কক্সবাজার চট্টগ্রাম হাইওয়েস্থ চকরিয়া উপজেলার অন্তর্গত বড়ইতলি গরুবাজার (পেকুয়া রাস্তার মাথা) সড়ক ও জনপদের জায়গাটি বেদখল হতে উদ্ধার করা হয়।

বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতের বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ ও ডাক্তার সাক্ষীর অনুপস্থিতি যথাসময়ে মামলার বিচার নিষ্পত্তিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। সারা দেশে হাজার হাজার মামলা পুলিশ ও ডাক্তার সাক্ষী না আসার কারণে যথা সময়ে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন কি মাননীয় হাইকোর্ট একটি মামলায় পুলিশ ও ডাক্তার সাক্ষী না আসলে বিচারিক আদালত কে তাদের বেতন বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।

আমার কর্মকালে সকল ডাক্তার ও পুলিশ সাক্ষী কে আসতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো; গৃহীত ব্যবস্থার কারণে কোন মামলায় কোন পুলিশ বা ডাক্তার সাক্ষী কে না এসে থাকতে দেখি নাই। এমন কি অবসরে যাওয়ার পরও পুলিশ ও ডাক্তার সাক্ষীকে সাক্ষ্য দিতে আসতে দেখেছি।

আমার কর্মকালে পিতা/মাতা, সন্তানদের মধ্যে অনেক মামলা দেখেছি। তবে চেষ্টা করেছি উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে পরবর্তী তারিখেই যাতে মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সাফল্য প্রায় শতভাগ।

আমার আদালতের আদেশ অনুবলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপককে এক মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। তিনি মাননীয় হাইকোর্টের আদেশ মোতাবেক মাননীয় সেশন্স জজ কোর্টে সারেন্ডার পূর্বক ধার্য তারিখ পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন জামিন লাভ করেন। আমার আদালতে হাজির হলে তাকে সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার চকরিয়ার কমপক্ষে ১০ রোগীকে বিনা ফি তে চিকিৎসা প্রদানের শর্তে জামিন বর্ধিত করা হয়। তিনি এখনো শর্ত মোতাবেক চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন।

বর্তমান ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় “প্রবেশন” একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে। আমার কর্মকালে বিভিন্ন মামলায় প্রবেশন দিয়েছি যারা সাজার পরিবর্তে প্রবেশন ভোগ করছেন অথবা করে ফেলেছেন।

ডিজিটালাইজেশনের প্রতিফলন বিচার বিভাগেও দৃশ্যমান। আমি সকল সাক্ষীর জবানবন্দি, অভিযুক্তদের ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ২২ ধারার জবানবন্দি, সকল রায়, আদেশ আমি নিজেই আমার ল্যাপটপে টাইপ করে প্রিন্ট দিই।

আমার কর্মকালে (করোনার সময় বাদ দিয়ে মোট ৩৫ মাসে) সর্বমোট ১২,৩৬৫ টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে মোট রায় হয়েছে ১৩৯৯টি তদনন্তর মোট সাজা হয়েছে ৫৫৫ টি মামলায়। এই সময়ে মোট ৪০৬৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গৃহীত হয়েছে যার মধ্যে পুলিশ ও ডাক্তার সাক্ষীও অন্তর্ভুক্ত। এই নিষ্পত্তি, রায় ও সাক্ষ্য গ্রহণে অত্র বারের বিজ্ঞ আইনজীবী সহ আমার কোর্ট স্টাফ, কক্সবাজার এসপি অফিস, চকরিয়া ও পেকুয়া থানা পুলিশ এর সহযোগিতা প্রশংসার দাবি রাখে।

এছাড়াও কর্মকালীন হাজার হাজার বিচারিক আদেশ হয়েছে। আমার কর্মকালে সর্ব্বোচ্চ বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬,১৫১ টি দেখেছি এবং বর্তমানে (অর্থাৎ মে, ২০২২ পর্যন্ত) মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৯৬০টি। আমার কর্মকালে আদালতের এজলাস, খাসকামরা ও সংলগ্ন রুমসমূহ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। তবে এই ক্ষেত্রে উদ্যোগ সমূহ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছেন গণপূর্ত বিভাগ, কক্সবাজার।

আমার কর্মকালে বিচারিক নথিসমূহ ও বিচারিক কাজকে আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, আন্তরিক প্রচেষ্টা দিয়ে কোর্ট স্টাফ ও জি আর শাখার পুলিশ, বিজ্ঞ আইনজীবী, শিক্ষানবিশ ও তাদের সহযোগী সকল মুন্সি, দুইটি থানা, সার্কেল এবং সকল তদন্ত কারী সংস্থা বা কর্মকর্তার সহায়তায় ন্যায়নিষ্ঠ বিচারিক পরিসমাপ্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

নিয়মিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কাজে গতি আনা এবং চিত্ত বিনোদনের অংশ হিসেবে অত্র আদালতের সকল স্টাফ ও জি আর শাখার পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নদীতে নৌকা ভ্রমণ, কুতুবদিয়া ভ্রমণ, সোনাদিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সবার প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। কুতুবদিয়া ভ্রমণে রাজীব কুমার বিশ্বাস দাদা ও হেলাল উদ্দিন অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করে আমাদের চমৎকার সঙ্গ দিয়েছিলেন।

এছাড়া শীতকালে নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেলে চমৎকার সময় কাটাতাম। একটি ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টও আয়োজন করেছিলাম। ২০১৯ সনে অত্র আদালতের কোর্ট স্টাফ ও জিআর শাখার পুলিশ সদস্যদের নিয়ে টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলাম। ফাইনালে এসি ল্যান্ড, দুই থানার ওসি, বারের সদস্যবৃন্দসহ অসংখ্য দর্শক ছিল।

আমার কর্মকালে তিনবার রোজার ঈদে ইফতারের আয়োজন করেছি। চকরিয়া ইউএনও সাহেব, এসি ল্যান্ড, সার্কেল সাহেব, ওসি চকরিয়া, বারের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, এপিপি সহ অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন।

আমার কর্মকালে ডেইলি স্টার (ছাপা সংস্করণ), ডেইলি অবজারভার (ছাপা সংস্করণ), ডেইলি সান (ছাপা সংস্করণ) এবং দৈনিক বাংলা পত্রিকা দেশ রূপান্তর, আইন বিষয়ক অনলাইন পত্রিকা ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম, 70 DLR, 71 DLR এ আইনের বিষয়ের উপর বিভিন্ন লিখা প্রকাশিত হয়েছে।

এই দীর্ঘ কর্মকালীন অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি খন্দকার হাসান ফিরোজ স্যার (অবঃ জেলা জজ, সম্প্রতিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন), ইসমাইল হোসেন স্যার (বর্তমানে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, কক্সবাজার) এবং সাবেক সি জেএম তৌফিক আজিজ রানা স্যার (বর্তমানে জেলা জজ, শ্রম আদালত-১ চট্টগ্রাম), সাবেক সিজেএম রেজাউল করিম স্যার (বর্তমানে সিএমএম, ঢাকা)। উল্লেখ করার মতো বর্তমানে সিজেএম হিসেবে পেয়েছি বিচার বিভাগের মেধাবী বিচারকদের মধ্যে একজন- অতি সুপরিচিত, মেধাবী, কর্মঠ, আন্তরিক এবং আমার চাকুরির শুরু থেকে যিনি আমার আইন চর্চা বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোজ খবর রাখেন শ্রদ্ধেয় বড় ভাই আলমগীর ফারুকী মহোদয়।

আমি আমার কর্মকালে অভিভাবকদের প্রকৃত অভিভাবকসুলভ আচরণ পেয়েছি। আমি দেখেছি তারা তাদের অভিভাবক সুলভ আচরণ দিয়ে আমাকে সার্বক্ষণিক আগলে রেখেছেন। বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ইসমাইল হোসেন স্যার এবং সাবেক সিজেএম রেজাউল করিম স্যার উভয়ে আমার বিচারিক অবস্থানকে জোরালোভাবে সমর্থন করে অপ্রত্যাশিত প্রতিকূলতা প্রশমিত করেছেন। বর্তমান চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ও একই ধারাবাহিকতায় সুষম বিচারিক পরিবেশ বজায় রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আমাকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছেন।

কক্সবাজার আদালতের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত বিজ্ঞ/মাননীয় বিচারকদের ভ্রাতৃত্বমূলক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ আমার কর্ম পরিচালনায় কর্ম উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। এছাড়া কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুই পর্যায়ে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগে অত্র ম্যাজিস্ট্রেসির সকল পর্যায়ের স্টাফগণের সাথে আমার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের সহযোগিতা ও আনুগত্য আমার কর্মকালে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বিচারকদের সম্মান রক্ষা করা এবং ক্রান্তিকালে বিচারকের পাশে থাকা তাদের আন্তরিকতা ও আনুগত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

আমার দৈনন্দিন কর্ম পরিচালনায় প্রত্যেক্ষভাবে সহযোগিতা পেয়েছি আমার আদালতের কোর্ট স্টাফ ও জি আর শাখার পুলিশ সদস্যদের। আমার আদালতে ৭ জন স্টাফ ও পুলিশ ইন্সপেক্টর, এসআই, এএসআই সহ ১৪ জন পুলিশ সদস্য কর্মরত ছিলেন। দায়িত্ব পালনে তাদের আন্তরিকতা, কর্মদ্যমতা, কর্মদক্ষতা আমাকে সব সময় বিমোহিত করেছে এবং আমার বিচারিক কর্ম সম্পাদনে উৎসাহিত করেছে। বিশেষ করে অত্র আদালতের এস আই মো. শফিকুল ইসলাম সাহেবের কর্মদক্ষতা, কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও অভিজ্ঞতা আমাকে বিমোহিত করেছে।

চকরিয়া আইনজীবী সমিতির সহযোগিতামূলক অবস্থান এবং আমার বিচারিক কাজের প্রতি আনুগত্য আমার কর্ম পরিচালনায় প্রতিনিয়ত উৎসাহ যুগিয়েছে। এই সমিতিতে ৭০ জনের উপর বিজ্ঞ সদস্য আছেন যাদের ৫৫-৬০ জন সদস্য সার্বক্ষণিক আমার আদালতে থাকতেন। প্রত্যেক শুনানিতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের বলিষ্ঠ পেশাগত অবস্থান প্রশংসার দাবি রাখে। আমি প্রত্যেক বিজ্ঞ আইনজীবীকে প্রত্যেক আদেশ মাথা পেতে নিতে দেখেছি। সাক্ষ্য গ্রহণ কালে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর প্রত্যেক্ষ অংশগ্রহণ ও সরব উপস্থিতি মামলার বিচার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি। সাক্ষী উপস্থাপন এবং সাক্ষ্য গ্রহণে সহযোগিতা চকরিয়া আইনজীবী সমিতির পেশাগত সততা হিসেবে প্রমাণ পেয়েছি।

আমার কর্মকালে চকরিয়া ও পেকুয়া দুইটি থানা, দুইটি তদন্ত কেন্দ্র, দুইটি হাইওয়ে থানা পুলিশের সহযোগিতা পেয়েছি। দুই থানায় নিয়োজিত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা – ইন্সপেক্টর, এসআই, এএসআই এর বড় ধরনের ত্রুটি চোখে পড়েনি; তবে ছোট খাট ভূল ত্রুটি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে ডেকে ঠিক করে দিয়েছি। সিনিয়র এএসপি (চকরিয়া সার্কেল) ও তার টিম কে আমার আদালতের বিচারিক কার্যক্রমে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি।

আমার কর্মকালে বিচারিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন মামলার তদন্ত পরিচালনায় দুইটি থানা পুলিশ, সার্কেল, দুইটি তদন্ত কেন্দ্র, দুইটি হাইওয়ে থানা ছাড়াও র‍্যাব-১৫, পিবিআই, সিআইডি, ডিবি, ট্যুরিস্ট পুলিশ, এপিবিএন কে নিয়োগ করেছি। এছাড়াও চকরিয়া ও পেকুয়ায় কর্মরত উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা যেমন- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এসিল্যান্ড (ভূমি), সমাজ সেবা, পল্লী উন্নয়ন, আনসার ভিডিবি, মহিলা বিষয়ক, সাব-রেজিস্ট্রার, কৃষি কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য, সড়ক ও জনপদ, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিককে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেছি।

এছাড়া বিচারাধীন মামলায় মেডিকেল সনদ সংগ্রহে চকরিয়া ও পেকুয়ার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দ্বয়, কক্সবাজারের সদর হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল কে ব্যতিব্যস্ত রেখেছি। প্রত্যেক কে তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে আমার আদালতের বিচারিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে দেখেছি।

চকরিয়া আইনজীবী সমিতি কর্তৃক আয়োজিত বিদায় অনুষ্ঠানে সমিতির সকল আইনজীবীকে স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। বিজ্ঞ আইনজীবী অনুভূতি প্রকাশের এক পর্যায়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে কান্নার আওয়াজ শুনেছি। চকরিয়া ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রতিষ্ঠার (১৯৮২ সনের পর) পরে এই সর্বপ্রথম স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে বিচারকের বিদায় অনুষ্ঠান আয়োজনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের কথা শুনেছি।

আমার কর্মকালে চকরিয়া ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সম্পূর্ণভাবে দালালমুক্ত হওয়ার কথা শুনেছি। আমার প্রস্থানে চকরিয়া পেকুয়ার আইন শৃংখলা পরিস্থিতি অববতি হওয়ার আশংকা ব্যক্ত করতে শুনেছি বারংবার। কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ইসমাইল হোসেন স্যার কেও একই কথা বলতে শুনেছি। বিদায় বেলায় আমার বিচারিক ভূমিকায় সমাজ সংস্কারে প্রত্যেক্ষ অবদান রাখার কথা শুনেছি।

আমার বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে একই নীতি অনুসরণ ও অনমনীয়তা রক্ষা করার কথা শুনেছি। বিদায় বেলায় কারো কথায় বা কোন চাপে নতি স্বীকার না করে কিংবা প্রভাবশালীদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বিচারিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা শুনেছি। বিজ্ঞ আইনজীবী দের বক্তব্যে আমার বিচারিক পদক্ষেপে সরকারি জমি উদ্ধারের কথা বারংবার প্রতিফলিত হয়েছে।

অত্র আদালতের মুন্সি সমিতির অনেক সদস্য কে বিদায় বেলায় অশ্রুসিক্ত নয়নে দেখেছি। আদালতের কোর্ট স্টাফ ও জি আর শাখা কর্তৃক আয়োজিত বিদায় অনুষ্ঠানে আমার প্রশাসনিক ও বিচারিক নের্তৃত্ব দ্বারা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে কর্মঘণ্টার সঠিক ব্যয়ে প্রত্যেক কে যথাযথ কাজে লাগিয়ে তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করানোর কথা শুনেছি।

অত্র চৌকি আদালতের সিভিল কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক জিয়া আহমেদ ও তার স্টাফ কর্তৃক বিদায় অনুষ্ঠানে আমি আরো সম্মানিত হয়েছি।

থানা পুলিশ কর্তৃক আয়োজিত বিদায় অনুষ্ঠানে আমার বিভিন্ন বিচারিক পদক্ষেপ এবং তদন্ত কার্যে মনিটরিং ও সুপারভিশন এর কারণে তদন্ত কার্যে সহায়তা সহ যৌক্তিক সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারার কথা শুনেছি। আমার আদালতের বিজ্ঞ এপিপি কর্তৃক বিদায়ে সিক্ত হয়েছি।

কক্সবাজার এর মাননীয় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এর সভাপতিত্বে কক্সবাজার জজশিপ ও ম্যাজিস্ট্রেসি কর্তৃক আয়োজিত বিদায় অনুষ্ঠানে বিজ্ঞ নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের বিচারকত্রয়, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়বৃন্দ এবং অন্যান্য বিচারক দের অংশগ্রহণে আয়োজিত বিদায় অনুষ্ঠানে প্রত্যেককে আমার বিচারিক কাজের মূল্যায়নের পাশাপাশি চকরিয়া পেকুয়া এলাকায় জুডিসিয়াল এক্টিভিজম প্রতিষ্ঠা করার কথা বলতে শুনেছি। সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে পরিপক্ক ও সুষম বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রদানের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচারিক ভূমিকা রাখার কথা শুনেছি।

মাননীয় সিজেএম মহোদয় কর্তৃক আয়োজিত বিদায়ে সকল ম্যাজিস্ট্রেট ভাই বোনদের অংশগ্রহণে আমি সিক্ত হয়েছি। চকরিয়া আদালতে আমার দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর কর্মকাল শেষে শ্রদ্ধেয় অভিভাবকদ্বয় সহ মাননীয়/বিজ্ঞ বিচারক এবং শুভানুধ্যায়ীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত বিদায় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রিয় চকরিয়া আদালতের কর্মকাল সমাপ্ত করলাম।

আদালতের প্রতিটি নথি, প্রত্যেক বিজ্ঞ আইনজীবী ও তাদের সহযোগী, কোর্ট স্টাফ, পুলিশ, খাস কামড়া ও এজলাসের প্রতিটি দেওয়াল, চেয়ার, টেবিলের সাথে যেন আমার ঋদ্ধতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি এই সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন হলেও হৃদয়ের গভীরে সারা জীবন স্থায়ীভাবে বেঁচে থাকবে।

সবশেষে চকরিয়া আদালতের কর্মকাল নিঃসন্দেহে আমার চলার পথে এক সোনালী অধ্যায় স্থাপন করেছে এবং সকল অভিজ্ঞতা আমার পেশাগত জীবনে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। গত সপ্তাহের রবিবার হতে বৃহস্পতিবার অবধি পাঁচ দিনে চকরিয়া আইনজীবী সমিতি, মুন্সি সমিতি, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্টাফ ও জিআর পুলিশ, সিভিল কোর্ট স্টাফ, থানা পুলিশ, কক্সবাজার জেলা জজশীপ ও ম্যাজিস্ট্রেসি, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির সকল বিজ্ঞ বিচারক, আইনজীবী, মুন্সি, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ আমাকে নিয়মিত কাজের পাশাপাশি বিদায় ও দাওয়াতে ব্যস্ত রেখেছেন এবং বিদায় বেলায় যেভাবে আমাকে সম্মানিত ও মূল্যায়ন করেছেন তাতে আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনারা সবাই ভাল থাকবেন৷ আমার পরিবারের জন্য আশীর্বাদ/দোয়া করবেন। বিদায় চকরিয়া….. বিদায় ভালবাসার কর্মস্থল….. বিদায় ভাল লাগার ম্যাজিস্ট্রেসি।