বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতন দমন আইনের প্রয়োজনীয়তা, প্রেক্ষাপট ও একটি পর্যালোচনা

বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতন দমন আইনের প্রয়োজনীয়তা, প্রেক্ষাপট ও একটি পর্যালোচনা

ঘটনা ১

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা চকবাজারের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ২০১৫ সালে বিয়ে করে। বিয়ের কয়দিন পর তার স্ত্রী তার ছেলেবন্ধুদের নিয়ে বাসায় আসে। বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি স্বামী। স্ত্রীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হলে স্ত্রী স্বামীকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তালাক দিয়ে দেয়। স্বামীকে অক্ষম সাব্যস্ত করে তার পরিবারের কাছে। যদিও ঘটনার দুই বছর পর ঐ ব্যবসায়ী আবার বিয়ে করেন, বর্তমানে তার ঘরে দুইট ফুটফুটে পুত্রসন্তান রয়েছে। পুরুষ এই হয়রানির বিচার কার কাছে দিবে? তাই পুরুষ নির্যাতন আইন করা এখন সময়ের দাবী।

ঘটনা ২

স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বিশ বছর ধরে একাকী জীবনযাপন করছেন সরকারি কর্মকর্তা মাহমুদুল হক (ছদ্মনাম)। বিয়ের দশ বছরের মাথায় তার স্ত্রী পরকীয়া করে অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যায়। মাহমুদুল হকের ১০ বছরের সংসারে এক ছেলে ও মেয়ে জন্ম নিয়েছিল।

তিনি বলেন, একটু বেশি বয়সে বিয়েটা করেছিলাম। আমার স্ত্রী তখন অনার্সে পড়াশোনা করতেন। বিয়ের পর আমার দায়িত্বেই অনার্স-মাস্টার্স শেষ করাই। এরপর তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন আমাকে ভাবিয়ে তোলে। বিভিন্ন বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা করত। আমি কিছু বললেই পরিবারের লোকজনকে জানানো হতো আমি নির্যাতন করছি। একবার আমার সঙ্গে ঝগড়া করে ১০ দিন কোনো যোগাযোগ ছিল না। পরে জানতে পারলাম অন্য ছেলেকে নিয়ে সে কক্সবাজার গেছে। এভাবেই চলছিল সংসার।

চক্ষুলজ্জায় কাউকে কিছু বলতাম না। কাছের দুই একজন শুধু জানত। এভাবে পারিবারিক অশান্তির মধ্যেই একদিন আমার সন্তানদের ফেলে অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে যায়। এরপর ডিভোর্স এবং নতুন বিয়ে কার্যকর করে সে প্রকাশ্যে আসে।

আমাকে নিঃস্ব করেই সে ক্ষান্ত হয়নি, নতুন বিয়ের পর সবাইকে বলে বেরিয়েছে আমি শারীরিকভাবে অক্ষম। সেজন্যই আমাকে ছেড়ে গেছে। অক্ষমতার সেই কালিমা নিয়েই সন্তানদের নিয়ে জীবন কাটছে। হাটে-বাজারে এমনকি অফিসেও স্ত্রীর বেহাল্লাপনার জন্য কটাক্ষ শুনতে হয়েছে আমাকে। পরকীয়ার পর অধিকাংশ নারীই পুরুষের বিরুদ্ধে এমন নোংরা অভিযোগ তোলেন।

পুরুষ সুরক্ষায় কোন আইন নেই

দেশের বিচারব্যবস্থায় নারীদের সুরক্ষায় আইন থাকলেও পুরুষ সুরক্ষায় কোন আইন নেই। ফলশ্রুতিতে নীররবে নিভৃতে এদেশের পুরুষরা নির্যাতিত হলেও লোক লজ্জার ভয়ে মুখ খোলে না। বিষয়টি নিয়ে সবাই হাসাহাসি করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরুষের জন্য আইন একান্ত প্রয়োজন।

চক্ষুলজ্জা আর পরিবারের কথা চিন্তা করে অগণিত পুরুষ দিনের পর দিন স্ত্রীর নানা ধরণের নির্যাতন-নিপীড়ন আর হুমকি-ধমকি নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন। পুরুষ অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বলছে, সমাজে অনেক পুরুষই স্ত্রীর যন্ত্রণায় নীরবে কাঁদেন। লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে চোখ মোছেন; কিন্তু দেখার কেউ নেই। বলারও উপায় নেই। বিভিন্নমহল থেকে পুরুষ নির্যাতন বন্ধে দাবী তোলা হচ্ছে কিন্ত সবচেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় পুরুষ নির্যাতনের জন্য কোন আইন নেই দেশে।

নারীদের সুরক্ষায় যত আইন

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনের ধারা ৩ অনুসারে, পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোন ব্যক্তি কতৃর্ক পরিবারের অপর কোন নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বুঝাবে।

এই সংজ্ঞাটি নিজেই গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকার হিসাবে একজন পুরুষের মর্যাদা উপেক্ষা করে এবং তাই এটি স্ব-বৈষম্যমূলক। আইনটি যেহেতু পুরুষদের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য সহিংসতাকে উপেক্ষা করে, তাই এটি নারী বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য দ্বারা নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনি সহায়তা চাওয়া থেকে পুরুষদের বঞ্চিত করে।

নারীদের গার্হস্থ্য হয়রানির ক্ষেত্রে, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন, ২০০০ এবং ১৮৬০ এর দণ্ডবিধির বিধানও রয়েছে। কিন্তু পরিবারের কেউ নির্যাতনের শিকার হতে পারে এমন পুরুষদের পক্ষে কোনো আইন নেই।

এছাড়া বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮(৪), ২৯(৩) এ নারীদের সুরক্ষায় যথেষ্ট পথ খোলা রাখা হয়েছে। নারীদের সুরক্ষায় নারী নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ করা হয়েছে। কিন্ত অন্তত দুঃখের বিষয় দেশে পুরুষ নির্যাতনের জন্য স্বতন্ত্র কোন আইন নেই। নারীদের জন্য আরো রয়েছে এসিড নিরোধ আইন, পারিবারিক সহিংসতা ও দমন আইন, যৌতুক নিরোধ আইন উল্লেখযোগ্য।

নির্যাতনের শিকার পুরুষের সঠিক পরিসংখ্যান নেই

পুরুষ নির্যাতন ও অধিকার বিষয়ক এককভাবে সক্রিয় কোন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) না থাকায় পারিবারিক নির্যাতনের শিকার পুরুষের সংখ্যা বা সঠিক পরিসংখ্যানও পাওয়া যায় না। তাই নারীদের হাতে কত পুরুষ হয়রানির শিকার হন তা সবসময়ই অজানা থেকে যায়। যদিও এটি উল্লেখযোগ্যভাবে একটি সত্য যে পুরুষরা ব্যক্তিগতভাবে স্বামী-স্ত্রীর সহিংসতার অভিযোগ করে এবং সামাজিক বিব্রত হওয়ার ভয়ে জনসমক্ষে কথা বলা এড়িয়ে যায়।

তবে একটি সংস্থার মতে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ ‘মানসিক’ নির্যাতনের শিকার৷ সামাজিক লজ্জার ভয়ে অনেকেই এসব বিষয় প্রকাশ করতে চান না৷ নিজেদের পরিচালিত এক গবেষণার ভিত্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ মেন’স রাইটস ফাউন্ডেশন।

তালাক হলেও রেহাই নেই

কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে অথবা স্ত্রীকে তালাক দিলে অথবা উচ্ছৃঙ্খল স্ত্রীকে শাসন করলে অথবা স্ত্রীর পরকীয়ায় বাধা দিলে সেই স্ত্রী ও তার পরিবারের লোকজন থানায় বা আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০-এর ১১(খ) অথবা যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০-এর ৪ ধারায় একটি মামলা করেন। একজন পুরুষের জীবন অতিষ্ঠ করার জন্য এমন একটি মামলাই যথেষ্ট।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না পুরুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, চক্ষুলজ্জা, জেল-পুলিশ আর উল্টো মামলার ভয়ে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর নির্যাতন নীরবে সহ্য করে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। পুরুষ চাইলেও নির্যাতনের কথা বলতে পারছে না। অন্যদিকে একজন নারী আইনের অপব্যবহার করে ইচ্ছে করলেই ঘটনা সাজিয়ে পুরুষের বিরুদ্ধে থানা বা আদালতে সহজেই নারী নির্যাতনের মামলা বা যৌতুক মামলা দিতে পারছেন।

এক ভুক্তভোগীর বক্তব্য

নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা ইমরান হাসান। বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাতকারে অভিযোগ করেন বিয়ের নামে তিনি প্রতারণার শিকার হয়ে উল্টো মামলার মুখে পড়েছেন।

“আমি বিয়ে করেছিলাম ২০১৮ সালে। মেয়ে ছিলো আমেরিকান নাগরিক। তথ্য গোপন করে সে আমাকে বিয়ে করেছিলো। পরে সে আরেকজনকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে যায় এবং সেখান থেকে দশ লাখ টাকা দাবি করে। এক পর্যায়ে আমি ডিভোর্স দিলে আমার নামে যৌতুক ও নারী নির্যাতনের মামলা করে। আমার বাবা, মা ও আমার নামে ওয়ারেন্ট করালো। শেষে খোরপোশের মামলা। এখনো মামলা চলমান আছে। আরও কয়েকটি থানায় আমার নামে অভিযোগ করেছে।”

পুরুষ নির্যাতনের হাতিয়ার

বাংলাদেশ সংবিধানে নারী পুরুষের সমতার বিধান থাকলেও পুরুষরা যেন বরাবরই অসহায়। পুরুষদের বিপক্ষে মিথ্যা মামলা দায়ের, হুমকি, হয়রানি করা এগুলো যেন নিত্যদিনের নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে।

১. মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুভঙ্করের ফাঁকি হচ্ছে ২০ লাখ, ৩০ লাখ দেনমোহর লিখিয়ে এদেশের সমাজব্যবস্থায় নারীকে পরিশোধ করা হয় ১/২ লাখ টাকা। পরবর্তীতে যখন দাম্পত্য কলহ লাগে তখন এই দেনমোহরই কাল হয়ে দাঁড়ায় পুরুষের বিপক্ষে। দেনমোহরের ঘানি টানতে টানতে অনেক পুরুষই আজ নিঃস্ব, রিক্ত। চট্টগ্রামের মেধাবী ডা. আকাশ অকালে প্রাণ দিয়েছেন এই অতিরিক্ত দেনমোহর শোধ করতে না পেরে, অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে স্ত্রীর পরকীয়াও মেনে নিতে হয়েছে তাকে।

২. দাম্পত্য কলহ শুরু হলেই (নারী, পুরুষ যার মাধ্যমেই শুরু হোক) নারীর হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় যৌতুক মামলা। ফলশ্রুতিতে একটি সুন্দর পরিবার মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। যৌতুকের অপরাধ প্রমাণ করতে হলে ঘটনার তারিখ থেকে এক বৎসর কাল সময়ের মধ্যে যৌতুকের মামলা করতে হয়। উক্ত সময় অতিক্রান্তের পর মামলা রুজু করলে তা সম্পূর্ণ বেআইনি হবে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ (এ) ধারামতে বাতিল যোগ্য হবে। (১৬ বিএলডি, এডি, ১১৮)।

আবার দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যখন একজন পুরুষের নামে মিথ্যা মামলা হয় তখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে হলেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, ততদিনে ঐ পুরুষ ও তার পরিবারের মিথ্যা মামলার ঘানি টানতে টানতে নাজুক পরিস্থিতির তৈরি হয়, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।

৩. ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা দেয়া হয়। তবে বলাই বাহুল্য এই ক্ষমতার অপব্যবহার আজকে সবচেয়ে বেশি হয়।

মন্তব্য

আশার কথা হচ্ছে, দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৫ সংশোধনের জন্য চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল, যার মধ্যে “নারী” শব্দের পরিবর্তে “ব্যক্তি” শব্দটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতে বলাৎকারের শিকার পুরুষ শিশুদের রেহাই পাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। কিন্তু রিট পিটিশনটি এখনো বিচারাধীন হওয়ায় শেষমেশ কি হবে তা বলা যাচ্ছে না এখনই।

পরিশেষে বলতে চাই, অপরিসীম নির্যাতনের হাত থেকে পুরুষদের রক্ষার জন্য অবিলম্বে পুরুষ নির্যাতন আইন দরকার। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে অতি দ্রুত যেন আমরা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে পুরুষ নির্যাতন দমন আইন দেখতে চাই।

লেখক: ফাইজুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮; Dw.com–নভেম্বর ২০, ২০২০; নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০; Bangladesh constitution.