মোঃ লুৎফর রহমান শিশির: ব্যাপক বিশ্বায়ন, আর্থ-রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে বিশ্বব্যাপী অগণিত মানুষ মাতৃভূমি ছেড়ে ভীনদেশে থিতু হচ্ছে বা প্রায়শঃ বাধ্য হচ্ছে। সেই সাথে জাতি, ধর্ম, গায়ের রঙ, অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদে মানুষ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন সেক্টরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ, হেইট স্পিচ ও জেনোফোবিয়া (Xenophobia) উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বিচার অঙ্গন এ-থেকে মুক্ত কি না তা নিয়ে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বিভিন্ন সময়ে বিচারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে বর্ণবাদ প্রভাব ফেলেছে বলে জোর ধারণা রয়েছে। কালো বর্ণের মানুষেরা যথাযথ ন্যায়বিচার থেকে প্রায়শ বঞ্চিত হন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্ণবাদের সংজ্ঞা আজ অনেকটাই নির্দিষ্ট। বর্ণবাদী আচরণকে যতোটা সহজে চিহ্নিত করা যায়, জেনোফোবিক আচরণকে চিহ্নিত করা প্রায়শঃ কঠিন হতে পারে। জেনোফোবিয়ার ধারণা ও সংজ্ঞায়নের প্রক্রিয়া এখনও চলমান রয়েছে। সাধারণভাবে জেনোফোবিয়া বলতে বিদেশী বা ভিন্ন নাগরিকদের প্রতি তীব্র অপছন্দ, ঘৃণা অথবা/এবং ভীতিকে বোঝানো হয়ে থাকে।
গত পাঁচ/ছয় বছরে বাংলাদেশে একটি বড় সংখ্যায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রবেশ করেছে। ভুলে যাওয়া যাবে না যে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হামলা ও নির্যাতনের মুখে জীবন হাতে নিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এই দেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে, যা একটি চলমান প্রক্রিয়া। রোহিঙ্গাদের মতো দুর্বল একটি জনগোষ্ঠীকে খুব সহজেই বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করা যাচ্ছে। বহু রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ অবৈধ মাদক ব্যবসার ও মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, যা স্থানীয়ভাবে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটিয়েছে এবং একটি অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। তবে এইজন্য গোটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দায়ী করা বা অপরাধপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। শুধু কঠোর শাস্তি প্রদান করেও মাদক নির্মূল করা যাবে না, তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগ। রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক তৎপরতার মাধ্যমে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সমস্যার শেষ সমাধান, তবে তা নিকট ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে বলে মনে হচ্ছে না।
ফৌজদারী বিচার প্রক্রিয়ায় জেনোফোবিয়ার প্রভাব বিদেশী নাগরিকদেরকে আইনশৃংখলা বাহিনী কর্তৃক অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ব্যবহার থেকে শুরু করে সহজে আদালতে আইনগত প্রতিনিধিত্ব না পাওয়া হয়ে বিচারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারকের পক্ষাশ্রিত মানস পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। রোহিঙ্গাদের অতীতের মানসিক ট্রমা, জীবন যাপনের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় না নিয়ে একজন রোহিঙ্গা অপরাধীকে রোহিঙ্গা হওয়ার কারণে স্বাভাবিক শাস্তির চেয়ে কঠোরতর শাস্তি প্রদান বা সর্বোচ্চ শাস্তি বাছাই জেনোফোবিয়ার প্রকাশ হতে পারে। ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে জেনোফোবিয়া যাতে প্রভাব না ফেলে, বিদেশী নাগরিক যাতে বিদেশী হওয়ার কারণে বৈষম্যের শিকার না হয়, তা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
বাংলাদেশ শরনার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর না করলেও জাতিসংঘ প্রণীত International Convention on the Elimination of All Forms of Racial Discrimination এর স্বাক্ষরকারী ও অনুমোদনকারী রাষ্ট্র। নিরাপদ অভিবাসন ও সকল ধরণের বৈষম্য হ্রাস Sustainable Development Goals (SDG) ও তার 2030 Agenda -এর অন্যতম লক্ষ্য। অনাগরিকদের প্রতি বৈষম্য রোধে আমাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। রোহিঙ্গারা এই দেশে থেকে, এই দেশেরই খেয়ে-পরে আবার এই দেশের মাটিতেই অপরাধ করছে -এমন ধারণা থেকে একটা জাতিঘৃণা যে অনেকের মনে দানা বেঁধেছে তা টের পাওয়া যায়। অন্ততঃ বিচার ব্যবস্থা এমন জাতিঘৃণাকে প্রশ্রয় দেবে না এটাই কাম্য।
লেখক: মোঃ লুৎফর রহমান শিশির; চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চুয়াডাঙ্গা।