প্রকৃত আসামি শনাক্ত করতে দেশের সব থানা ও কারাগারে ক্রমান্বয়ে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করার নির্দেশ সম্বলিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকশিত হয়েছে।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগে কর্মরত) ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ কর্তৃক ঘোষিত রায়ের ৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে বলে আজ মঙ্গলবার (৫ জুলাই) রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর এ-সংক্রান্ত রিটের ওপর জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ রায় দেন।
একইসঙ্গে নাশকতার অভিযোগে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় করা মামলায় প্রকৃত আসামি নোয়াখালীর মোদাচ্ছের আনছারী ওরফে মোহাদ্দেসের পরিবর্তে মো. জহির উদ্দিনের গ্রেফতারি পরোয়ানা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন আদালত।
আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
রায়ের বিষয়ে সেদিন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির জানান, আদালত পর্যবেক্ষণসহ রুলের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছেন। আবেদনকারী জহির উদ্দীনের বিরুদ্ধে জারি করা পরোয়ানা অবৈধ এবং আইন-বহির্ভূত হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
পর্যবেক্ষণে আদালত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তিনটি নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো হলো-
১. বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে সব থানায় আসামির হাতের আঙুল ও তালুর ছাপ, চোখের মণি, বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালুকরণ।
২. গ্রেফতারের পর আসামির সম্পূর্ণ মুখের ছবি (Mugshot photographs) ধারণ ও কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে (integrated) সংরক্ষণ।
৩. দেশের সব কারাগারে আঙুল ও হাতের তালুর ছাপ, চোখের মণির সংরক্ষণের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষণ সিস্টেম চালুকরণ।
নাশকতার অভিযোগে রাজধানীর খিলগাঁও থানার এক মামলায় প্রকৃত আসামি নোয়াখালীর মোদাচ্ছের আনছারী ওরফে মোহাদ্দেসের পরিবর্তে মো. জহির উদ্দিনকে আসামি করার বিষয়ে এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই আদেশ দেওয়া হয়।
এর আগে নাশকতার অভিযোগে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় দায়ের হওয়া এক মামলায় প্রকৃত আসামি নোয়াখালীর বসুরহাটের মোহাম্মদ জহির উদ্দিন নয়, মর্মে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলার প্রকৃত আসামি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের আহসান উল্লাহর ছেলে মোদাচ্ছের আনছারী ওরফে মোহাদ্দেস।
এ অবস্থায় করণীয় বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও রিট আবেদনকারীপক্ষের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা জানতে চান হাইকোর্ট। ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উভয়পক্ষকে ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলা হয়। ধার্যকৃত দিনে ওই প্রতিবেদনের ওপর শুনানি হয়।
এর আগে ভুক্তভোগী জহির উদ্দিনের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই।
হাইকোর্টের একই বেঞ্চ গত বছর ১০ মার্চ এক আদেশে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানার কার্যকারিতা স্থগিত করেন।
একইসঙ্গে নোয়াখালীর জহির উদ্দিন ওই মামলার যথাযথ আসামি কি না, তা তদন্ত করে দুমাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়ায় গত ১৮ আগস্ট হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং এ বিষয়ে কী অগ্রগতি হয়েছে, তা আদালতকে জানাতে নির্দেশ দেন।
এরপর পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম তদন্ত করে প্রতিবেদন পিবিআইয়ের ডিআইজি কার্যালয়ে দাখিল করেন। সেখান থেকে প্রতিবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। রেজিস্ট্রার কার্যালয় প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জহির উদ্দিনকে খিলগাঁও থানার মামলায় (নম্বর-১২(৪)১৩) গ্রেফতারি পরোয়ানার আসামি হিসেবে চিহ্নিত করার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জহির উদ্দিন প্রকৃতপক্ষে গ্রেফতারি পরোয়ানাধারী ব্যক্তি নয়। প্রকৃত আসামি মোদাচ্ছের আনছারী ওরফে মোহাদ্দেস।
অ্যাডভোকেট শিশির মনির জানান, রাজধানীর খিলগাঁও থানায় ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল দায়ের হওয়া মামলায় (নম্বর-১২(৪)১৩) পুলিশ নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের শাহজাদপুর গ্রামের আহসান উল্লাহর ছেলে মোদাচ্ছের আনছারীকে গ্রেফতার করে।
পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর মোদাচ্ছের তার নাম-ঠিকানা গোপন করে নিজেকে নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার আজগর আলী মোল্লা বাড়ি মসজিদ রোড এলাকার মোহাম্মদ আব্দুল কাদেরের ছেলে মোহাম্মদ জহির উদ্দিন নামে পরিচয় দেন।
এরপর ওই বছরের ৩১ অক্টোবর মোদাচ্ছের জামিন পেয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পালিয়ে যান। তিনি জহির উদ্দিন নামেই আদালতে জামিনের আবেদন করেছিলেন।
এদিকে, পুলিশ তদন্ত শেষে জহির উদ্দিনসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয়। এরপর ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর জহিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
এ অবস্থায় জহির উদ্দিন যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মূল আসামি মোদাচ্ছের আনছারীর ছবি এবং শারীরিক বর্ণনাসহ বিভিন্ন তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে জহির উদ্দিন তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন।