সিরাজ প্রামাণিক: আইন বলছে, ধর্তব্য ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থানা গ্রহণ করবেন। অভিযোগ না নেয়াটা রীতিরকম বড় ধরনের অপরাধ। ফৌজদারি কার্যবিধি, পিআরবি এবং উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী ধর্তব্য অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা নিতে বাধ্য। বাংলাদেশের সকল থানার বাইরে টাঙানো সিটিজেনস চার্টারে কীভাবে মামলা করতে হবে, পুলিশের ভূমিকা কী হবে এবং থানা অভিযোগ নিতে না চাইলে ভুক্তভোগী কী প্রতিকার পেতে পারেন, সে সম্পর্কে বলা আছে।
ইয়াসমিন সুলতানা বনাম বাংলাদেশ (৫৪ ডি.এল.আর. পৃ. ২৬৯) মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ধর্তব্য অপরাধের তথ্য পেলে এফআইআর দায়ের ও তদন্ত শুরু করতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আইনগতভাবে বাধ্য। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় কীভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হবে, তাও বলা আছে। যেমন, ‘ধর্তব্য অপরাধের’ তথ্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দিলে তিনি তা লিখে তথ্যদাতার সই নেবেন। কী লিখেছেন, তা তথ্যদাতাকে পড়ে শোনাবেন এবং নির্দিষ্ট বইয়ে সংরক্ষণ করবেন। তথ্যটি নির্ধারিত ফরমে লিখে লিপিবদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় হচ্ছে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বা এফআইআর। এখানে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার ‘স্বীয় বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত’ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, প্রাথমিক তথ্য বিবরণী দায়েরের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। টেলিফোনেও কেউ যদি ধর্তব্য অপরাধের অভিযোগ করেন এবং পুলিশ কর্মকর্তা যদি তা লিপিবদ্ধ করেন, সেটাও প্রাথমিক তথ্যবিবরণী হিসেবে গণ্য করে পুলিশ তদন্ত শুরু করতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে ধর্তব্য অপরাধ কোনগুলো? এ সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলে লেখা আছে। সহজভাবে বলতে গেলে বড় ধরনের যেকোনো অপরাধ, যেমন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ এসবই ধর্তব্য অপরাধ।
পুলিশ রেগুলেশন্স বেঙ্গল-১৯৪৩ (পিআরবি)-এর ২৪৪ নম্বর প্রবিধানে বলা হয়েছে, আপাতদৃষ্টে অপরাধকে সত্য মনে হোক বা মিথ্যা, অপরাধ গুরুতর হোক বা মামুলি যদি অপরাধ পেনাল কোড, কোনো বিশেষ বা স্থানীয় আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘটে তাহলে অভিযোগ নিতে হবে পুলিশকে। পিআরবি এর এই প্রবিধানে মামলা গ্রহণ বা রেকর্ড করার বাধ্যবাধকতায় শব্দ ‘শ্যাল’ ব্যবহার করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে থানায় যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে কেউ মামলা করতে পারবে কি-না? উত্তর হলো হ্যাঁ। তাহলে আবারও প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এভাবে মামলা হলে অগণিত মামলা হবে কি-না? এর উত্তরে বলা যায় অগণিত মামলা হবে সাধারণ দৃষ্টিতে। কিন্তু গভীর দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, যে কোন তথ্য মামলা হিসেবে রেকর্ড করার কথা আইনে বলা হলেও সব মামলার তদন্ত নাও হতে পারে। কারণ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৭ (১) (গ) ধারায় বলা হয়েছে যে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে যদি এটা প্রতীয়মান হয় যে, মামলাটির পর্যাপ্ত ভিত্তি নেই, তাহলে তিনি মামলাটির তদন্ত করবেন না। আবার দ-বিধিতে উল্লেখিত ২১১ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়েরের পাল্টা ব্যবস্থা রাখার ফলে থানায় মামলা রেকর্ড করার বিষয়টিকে ভারসাম্য করা হয়েছে।
থানায় মামলা না নেয়ায় পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে যে শাস্তি হতে পারে তা পুলিশ আইন ১৮৬১ এর ২৯ নম্বর ধারায় পরিস্কারভাবে উল্লেখ আছে। সেখানে বলা আছে, কোন পুলিশ কর্মচারী যদি কোন নিয়ম বা রেগুলেশন স্বেচ্ছাকৃত ভাবে অমান্য করে বা গাফিলতি এবং পূর্ণভাবে তা পালনে শৈথিল্য করা; তবে তাকে বিচারার্থে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সোপর্দ করা চলবে এবং বিচারে অপরাধী প্রমাণিত হলে ৩ মাসের বেতনের সমপরিমাণ জরিমানা অথবা তিন মাস পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ- অথবা উভয়বিধ দ- হতে পারে। আইনের এই বিধান মামলা গ্রহণ না করার অপরাধকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে রোধ করার ব্যবস্থা করেছে। এখানে নিয়ম বা রেগুলেশন লংঘন বা গাফিলতি বলতে পিআরবি-এর মামলা গ্রহণ সংক্রান্ত ২৪৪ নিয়মের লংঘনকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ থানায় পুলিশ মামলা গ্রহণ করেননি, এটা প্রমাণিত হলে তার উপরোক্ত শাস্তি হবে।
আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করতে গেলে সাথে একটি হলফনামা দিতে হয় এরকম যে, অভিযোগকারী থানায় মামলা করতে গিয়েছেন কিন্তু থানা মামলা নেয়নি। আদালতের মামলাজটসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক কাজের মধ্যেও ট্রাইব্যুনাল মামলা গ্রহণ করছেন। কিন্তু থানা কেন মামলা নেয়নি-সে বিষয়ে আদালত কিন্তু কোনরুপ প্রশ্ন তুলছেন না কিংবা কোনো অনুসন্ধানও করছেন না। থানা মামলা নেয়নি হলফনামার সাথে সাথে মামলা চলাকালীন এটাও নিশ্চিত করা হোক থানা কেন মামলা নেয়নি। তাহলে আমাদের সংবিধানের বানী চিরন্তন রুপ পাবে, শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক: আইনের শিক্ষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com