কাজী হেলাল উদ্দিন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল্যের ছাত্র মহিউদ্দিন রনি বিগত ১৫ দিন যাবত কমলাপুর রেলস্টেশনে হাতে শিকল বেঁধে, দুর্নীতি বিরোধী প্ল্যাকার্ড নিয়ে অবস্থান করছেন। রনি বাংলাদেশ রেলওয়ের দুর্নীতি বিরোধী ৬ দফা দাবী পেশ করেছেন। তিনি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।
তিনি অন্য সবাইকে বলেছেন, যারা তাঁর সঙ্গে এই আন্দোলনে যুক্ত হতে চান, তাঁরা যেন ভায়োলেন্স না করেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহা-পরিচালককে একটি স্মারক লিপি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেখানেও বাঁধা আসে। নিরাপত্তা বাহিনী অনেক নাটকীয়তা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে স্মারকলিপি দিতে দেওয়া হয়নি।
রনির আন্দোলনের কথা ইতোমধ্যে সারা দেশের মানুষের নজরে এসেছে। রনির আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাড়া দেশের দুর্নীতি বিরোধী ছাত্র জনতার মধ্যে সাড়া পড়েছে। তাঁরা কিছু জায়গায় রেল গাড়ি আটকে দিয়েছেন। আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। কোমলে কঠোর বাঙালি স্বরূপে আত্মপ্রকাশিত হতে শুরু করেছে।
মহিউদ্দিন রনির এই আন্দোলনের চিত্র দেশের উচ্চ আদালতের নজর এড়ায়নি। রেলের তিন কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, রেল কি আপনারা গিলে খেতে চাইছেন? আদালত রেল বিভাগ কে কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন। আদালত গত ২১ জুলাই এই বিষয়ে রুল জারি করেছেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে রনির এই রুখে দাঁড়ানোর পিছনে ছিলো রনির নিজে ভুক্তভোগী হওয়ার কাহিনী। রনি সহজ ডটকমের মাধ্যেমে রেলের টিকেট ক্রয় করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মোবাইল বিকাশ থেকে টাকা কেটে গেলেও রনি টিকেট পাননি। তাই তিনি সরাসরি কমলাপুর স্টেশনে গিয়েছিলেন, এই সমস্যার প্রতিকার পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেখানে তিনি প্রতিকার পাননি। বরং রেল কর্তৃপক্ষের আচরণে তিনি দুর্নীতির চিত্র দেখতে পেয়েছেন। তিনি ভোক্তা অধিকার দপ্তরে অভিযোগ করেও তেমন কোন ধনাত্মক সাড়া পাননি। তাই তিনি আন্দোলনের পথ অবলম্বন করেন।
প্রথমে অনেকে তাঁর আন্দোলন নিয়ে অনেক ঋণাত্মক মন্তব্য করলেও পরে অনেকেই বুঝতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে রনির দৃঢ় প্রত্যয়ের বিষয়টি। শেষ পর্যন্ত ভোক্তা অধিকার দপ্তর রনির অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করে সহজ ডটকমকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন। ভোক্তা অধিকার দপ্তর জরিমানা করায় সহজ ডটকমের প্রতারণা বা ভোক্তা হয়রানির বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
ভোক্তা অধিকার দপ্তর রেলওয়ের টিকেট এজেন্ট সহজ ডটকমকে জরিমানা করলেও রনির আন্দোলন সমাপ্ত হয়ে যায়নি। তিনি ৬ দফা বাস্তবায়নের জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। তিনি যে আল্টিমেটাম দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব মনে করি না। কিন্তু রেলের কর্তারা কেন রনির কথা কানে তুলছেন না বা কেন রনির কথা কানে তুলতে এত সময় ক্ষেপণ করছেন, তা আমার বোধগম্য নয়।
রেলের এক বড় কর্তা রনির আন্দোলন ও দাবীর বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তিনি রেলের অনেক সীমাবদ্ধতা ও নিজেদের সাফাই গেয়েছেন। তিনি এমন বিবৃতি দিয়েছেন যেন, রেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কখনো কোন দুর্নীতি করেন না, তাঁরা যেন দুধে ধোয়া তুলসী পাতা। তিনি এদেশের জনগণের চোখে ধুলো দিতে প্রয়াস পেয়েছেন। রেলের কর্মচারীরা যদি দুধে ধোয়া তুলসী পাতা হন। তাঁরা যদি যদি সততার উদহারণ হন, তবে এদেশে দুর্নীতি করে আর কে!
রনি এখন একা নন। রনি এখন অনেক। দুর্নীতির মূলোৎপাটন না করে রনিদের আন্দোলন থামবে না। রনিদের আন্দোলনকে সমর্থন করে কমলাপুর স্টেশনে উপস্থিত হয়ে লাইভে এসেছেন দুর্নীতি বিরোধী আর এক বাঙালি যুবক ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন। রনির আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন, আরও অনেক মানুষ ও মানুষদের সংগঠন। রনির সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন অনেক দুর্নীতি বিরোধী মানুষ। সময়ের সাথে সাথে রনির দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হচ্ছে।
মহিউদ্দিন রনি রেলের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চালিয়ে গেলেও, দেশের উচ্চ আদালত ও দেশের প্রায় সকল শীর্ষ স্থানীয় মিডিয়া রনির আন্দোলন প্রচার করলেও, দেশের কোটি মানুষের হাতে সোশাল মিডিয়ায় রনির আন্দোলন দাবালনের মত ছড়িয়ে পড়লেও মাননীয় রেল মন্ত্রীর কোন বক্তব্য এখনো পর্যন্ত আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। আমি মাননীয় রেল মন্ত্রীর এহেন নিরবতায় হতাশ, বিষণ্ণ, ক্ষুব্ধ ও আমার সিনিয়র সহকর্মী হিসাবে মাননীয় মন্ত্রীর এহেন আচরণে আমি লজ্জিত।
রনিদেরকে কমলাপুর স্টেশনে ঢুকে আন্দোলন করতে বাধা দেওয়ায় রনি ও তাঁর সঙ্গীরা কমব্যাট পোশাক পরিহিত নিরাপত্তা রক্ষিদের ব্যারিকেড ভেঙে, “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর বাংলায় দুর্নীতিবাজের ঠাই নাই” শ্লোগান দিতে দিতে কমলাপুর রেল স্টেশনে ঢুকে পড়েছেন। রনির আন্দোলন সফল হোক।
রনি ও তাঁর দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থনকারীদের সতর্ক থাকতে হবে যেন তাঁর বা তাঁদের এই দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকে কেউ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না করতে পারে। মনে রাখতে হবে জাতির পিতা ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, “শত্রু ঢুকেছে, তাঁরা কলহ সৃষ্টি করবে, “… বাঙ্গালীরা বুঝে সুঝে কাজ করবেন।”
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা অনেক বার দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর জিরো টলারেন্স ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু হাইব্রিড “চাটার দল” তাঁর কথা কানে না তুলে দু’হাতে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন, “… আমি পেয়েছি চোরের খনি।”
এবার এদেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক রনির দল যদি জেগে ওঠে তবে দুর্নীতিপরায়ণেরা পরাজিত হবেই। রনিদের দাবায়ে রাখতে পারবে না! ইনশাআল্লাহ্!!
লেখক: আইনজীবী; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।