দীপজয় বড়ুয়া : মৃত্যুকালীন ঘোষণা বা Dying declaration হলো আদালতে প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত একটি পরিভাষা, যা সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ৩২নং ধারার (১) উপধারা বলে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রাহ্য করা হয়। পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলের (PRB) ২৬৬নং বিধিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণভাবে ব্যক্তির দেয়া মৌখিক সাক্ষ্য সেই ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে গ্রহণযোগ্য নয়। মৃত্যুকালীন ঘোষণা সেক্ষেত্রে একটি বিশেষ ব্যতিক্রম।
মৃত্যুকালীন ঘোষণার সংজ্ঞা
১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ৩২(১) মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রদত্ত বিবৃতিকে সাধারণত মৃত্যুকালীন ঘোষণা বলা হয়৷ সাক্ষ্য আইনের ৩২ ধারা মতে, কোন নিহত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে যদি তার মৃত্যুর কারণ, অবস্থা এবং পরিস্থিতি বর্ণনা করে কোন বিবৃতি বা জবানবন্দি প্রদান করে থাকেন তবে তাকে মৃত্যুকালীন ঘোষণা বলা হয়।
২০০৪ সালের 9 DLR (HC)(2004) 228 (231) Abdul Hatem Vs The state মামলায় High Court Division কর্তৃক মৃত্যুকালীন ঘোষণার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কর্তৃক তার মৃত্যুর পূর্বে প্রদত্ত মৌখিক বা লিখিত বিবৃতি হচ্ছে মৃত্যুকালীন ঘোষণা । এই ঘোষণা প্রশ্নের উত্তরে লিখিত, মৌখিক বা চিহ্ন এবং অঙ্গভঙ্গির দ্বারাও হতে পারে বলে আদালত মত দিয়েছেন।
মৃত্যুকালীন ঘোষণার সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে নিন্মলিখিত উপাদানগুলো দেখা যায়। যথা-
ঘোষণা প্রদানকারী ব্যক্তির মৃত্যুবরণ করতে হবে
উল্লিখিত বিবৃতিটি তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে হতে হবে।
মৃত্যু হওয়ার পূর্বেই যে কোন লোকের সম্মুখে লিখিতভাবে বা মৌখিকভাবে বা অঙ্গভঙ্গির প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে।
যার সামনে এইরূপ ঘোষণা করা হয়েছে সেই ব্যক্তিকে আদালতে গিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
অন্যান্য সমর্থনমূলক সাক্ষী থাকতে হবে।
মূলত উপরোল্লিখিত ৫টি উপাদানের সমন্বয়েই মৃত্যুকালীন ঘোষণার সংজ্ঞা গঠিত।
1970 Cr.LJ (Lahore) 383 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, মৃত্যুকালীন ঘোষণা হল –
(ক) মূল ঘটনার অব্যবহিত পরে বা
(খ) মৃত ব্যক্তি যখন মৃত্যুর প্রতীক্ষায় বা
(গ) এরূপ সময়ে যে তখন পর্যন্ত মৃত ব্যক্তি কারও সাথে পরামর্শ করার সুযোগ পান নাই কিংবা কারো নিকট হতে কোন ইঙ্গিত পায় নাই। এরূপ অবস্থায় প্রদত্ত ঘোষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অনুরূপভাবে, মৃত্যুকালীন ঘোষণার বিষয়বস্তু যদি এই আভাস দেয় যে, যা অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্ভবত সত্য এবং ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করার কিংবা ভুল ব্যক্তিকে জড়ানোর জন্য কোন প্রচেষ্টা হয় নাই, তবে সাধারণত ইহা একটি নির্ভরযোগ্য মৃত্যুকালীন ঘোষণা হিসাবে গণ্য হবে। মৃত্যুকালীন ঘোষণা সত্য ও খাঁটি বলে বিশ্বাস হলে সমর্থনকারী সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয় না, ঘোষণার ভিত্তিতেই অপরাধ সাব্যস্ত হতে পারে।
40 DLR 321 Nurjahan Bnegum Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “অচিরেই মৃত্যু হবে ভেবে কোন বিবৃতি মৃত্যুপথযাত্রী লোকের মৃত্যু পরবর্তী বিবৃতি বলে ধরে নেয়ার কোন প্রয়োজন পড়ে না। বিবৃতি স্বেচ্ছাকৃতভাবে, না বাহিরের কোনও চাপের মুখে দেয়া হয়েছে এটি হবে প্রাসঙ্গিক । এরূপ বিবৃতির উপর ভিত্তি করে আসামীকে শাস্তি দেয়া যায়”।
16 DLR (1964) 37 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ মৃত্যুকালীন ঘোষণাকে আদালতে যথেষ্ট মূল্য দেয়া হয়ে থাকে। যার মৃত্যু আসন্ন সে ব্যক্তি স্বভাবতই মিথ্যা বলতে পারে না এরূপ বিশ্বাস নিয়ে এটি করা হয়ে থাকে। ঘোষণাটি যদি সত্য ও যথার্থ বলে প্রমাণিত হয় তবে অন্য কোন সাক্ষ্য প্রমাণ ব্যতিরেকেই শুধুমাত্র এর উপর ভিত্তি করে আসামীকে শাস্তি দেয়া যেতে পারে”।
মৃত্যুকালীন ঘোষণা কার্যকর করার আবশ্যকীয় উপাদানমূহ
এ ধরনের ঘোষণা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। যথা-
ভিকটিমের ঐ বিবৃতি প্রদান করার শারীরিক সক্ষমতা ছিলো কি না?
সাক্ষীরা ঐ বিবৃতি সঠিকভাবে শুনেছে কি না? এবং আদালতে আঘাতদানকারীদের নাম সঠিকভাবে পুনঃস্থাপন করেছে কি না?
মৃত্যুকালীন ঘোষণাকারীর সঠিকভাবে আঘাতদানকারীদের সনাক্ত করার সুযোগ ছিলো কি না?
সাক্ষ্য হিসেবে মৃত্যুকালীন ঘোষণার গ্রহণযোগ্যতা
আইন প্রণেতারা সাক্ষ্য হিসেবে মৃত্যুকালীন ঘোষণাকে গ্রহণযোগ্য করেছেন দুটি কারণে।
প্রথমত, বাস্তব প্রয়োজনে। নিহত ব্যক্তি হচ্ছে অপরাধের একমাত্র চাক্ষুষ সাক্ষী। তার বক্তব্য গ্রহণ না করলে বা বিবেচনায় না আনলে বিচারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। মৃত্যুর পূর্বে তার বক্তব্য গ্রহণ না করলে পরে আর তাকে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য পাওয়া যাবে না।
দ্বিতীয়ত, আসন্ন মৃত্যু বুঝতে পারলে সে ব্যক্তি আর মিথ্যার আশ্রয় নিবে না-এটাই স্বাভাবিক। পরলৌকিক বিষয় তার মনটাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। তাই আদালতে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে যে সাক্ষ্য দেয়া হয় এরূপ পরিস্থিতি সেরূপ শপথ গ্রহণের সমপর্যায় ভুক্ত বলে মনে করা হয়।
যে সাধারণ নীতির উপর এটা প্রতিষ্ঠিত তা হচ্ছে এই যে, চরম অবস্থায় এরূপ ঘোষণা বা বিবৃতি দেয়া হয় যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মৃত্যুর দুয়ারে উপস্থিত, জীবনে আর কোন আশা নেই; সে অবস্থায় মানুষ সত্য কথাটিই বলতে চায়। এরূপ একটা গাম্ভীর্যপূর্ণ ও পবিত্র পরিস্থিতি আদালতে শপথ বাক্য উচ্চারণের অনুরূপ।
মৃত্যুকালীন ঘোষণাকারী বেঁচে গেলে ঘোষণার গ্রহণযোগ্যতা
ঘোষণাকারী ব্যক্তি যদি বেঁচে যায় তখন সাক্ষ্য আইনের ৩২(১) ধারানুযায়ী গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে গৃহীত হবে না।
3 BCR 239 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সাক্ষ্য আইনের ১৫৭ ধারানুযায়ী তখন এই প্রকার বিবৃতি সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যেহেতু ঘোষণাদানকারী বেঁচে আছেন, সেহেতু তিনি আদালতে উপস্থিত থেকে শপথবাক্য পাঠ ও জেরার সম্মুখীন হতে পারে”।
40 DLR 321 Nurjahan Bnegum Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আসন্ন মৃত্যুর সম্ভাবনায় কোন বিবৃতি বা ঘোষণা প্রদান করা হলে পরবর্তীকালে ঘোষণাকারী বেঁচে গেলে, তিনি সাক্ষ্য দিতে আসলে তার বক্তব্য সমর্থনের জন্য উক্ত ঘোষণা ব্যবহার করা যায়”।
এছাড়াও সাক্ষ্য আইনের ১৪৫ ধারানুসারে বিরোধ দেখানোর জন্য ব্যবহার করা যায়।
পুলিশের নিকট প্রদত্ত মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণযোগ্যতা
পুলিশের নিকট মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করা যায় এবং তা সাক্ষ্য হিসেবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, সাক্ষ্য আইনে মৃত্যুকালীন ঘোষণা পুলিশের নিকট প্রদান করা হলে তা অপ্রাসঙ্গিক হবে এরূপ বিধান উল্লেখ করা হয়নি। এর মানে হচ্ছে, যেকোন ব্যক্তির নিকট মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদান করা যাবে।
মৃত্যুকালীন ঘোষণা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ১৬৪ ধারায় রেকর্ড কি বাধ্যতামূলক?
এই ধরনের ঘোষণা কাছাকাছি যেকোন ব্যক্তি কর্তৃক রেকর্ডকৃত হতে পারে। এমন কোন বিধান নেই যে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৬৪(৩) অনুসারে দোষস্বীকারমূলক বিবৃতির মতো মৃত্যুকালীন ঘোষণাও ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক রেকর্ডকৃত হতে হবে।
শুধুমাত্র মৃত্যুকালীন ঘোষণার উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত দন্ড
আইনের এমন কোন বিধান বা নীতি নেই যে যদি মৃত্যুকালীন ঘোষণা সাধারণ সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত না হয়, তাহলে তার উপর ভিত্তি করে কোন দন্ড দেয়া যাবে না। কিন্তু khushal Rao PLD 1958, Supreme court (Ind) 203 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সার্বিক দিক থেকে মৃত্যুকালীন ঘোষণা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং এর সত্যতা যাচাই করার পর আদালত যদি মনে করে যে মৃত্যুকালীন ঘোষণা ত্রুটিপূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য নয় প্রতীয়মান হয়, তখন স্বাধীন সমর্থনমূলক সাক্ষ্য ব্যতীত উক্ত মৃত্যুকালীন ঘোষণার উপর ভিত্তি করে দন্ড দেয়া যাবে না”।
Taj Mahmud 12 DLR (WP) Lahore 30 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, যদি একটি মৃত্যুকালীন ঘোষণা খাঁটি এবং নির্ভুল বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে উক্ত মৃত্যুকালীন ঘোষণা স্বয়ং দন্ডের ভিত্তি হতে পারে। অর্থাৎ সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত না হলেও এই ঘোষণার ভিত্তিতে দন্ড প্রদান করা যাবে, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ঘোষণাটি খাঁটি এবং নির্ভুল বলে প্রমাণ হতে হবে।
আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির বর্ণনামতে দাখিলি এজাহারের বিবরণ তার মৃত্যুর পর মৃত্যুকালীন জবানবন্দির গ্রহণযোগ্যতা
54 DLR 33 Rashid Ahmed vs The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, মৃত্যুর পূর্বে নিহিত ব্যক্তি নিজে এজাহার প্রদান করায় তার মৃত্যুর পর তা সাক্ষ্য আইনের ৩২ ধারায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করা যায় এবং তার উপর নির্ভর করে আদালত আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারে।
মৃত ব্যক্তির দাখিলি এজাহারে ঘাতক হিসেবে কোন ব্যক্তির নাম উল্লেখ থাকলেও তার নাম মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে উল্লেখ করা না হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পেতে পারেন।
1985 BLD (AD) 63 Amjad hossen vs The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির জবানবন্দির ভিত্তিতে লিপিবদ্ধ এজাহারে একজন ঘাতক হিসেবে উল্লেখ থাকলেও, তার নাম মৃত ব্যক্তির মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে উল্লেখ না থাকলে অভিযুক্ত ব্যক্তি যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের অবকাশে খালাস পেতে পারে।
শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে মৃত্যুকালীন ঘোষণা
61 DlR 54 Shahbuddin vs The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুকালীন ঘোষণা দেয়ার সময় উপযুক্ত অবস্থায় ছিল এর সপক্ষে মেডিকেল সার্টিফিকেটের অনুপস্থিতিতে শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে মৃত্যুকালীন ঘোষণা গ্রহণ করা ঝুঁকিপূর্ণ।
মৃত্যুকালীন ঘোষণা হুবহু এবং একইরূপ হওয়া আবশ্যক কি না?
মৃত্যুকালীন ঘোষণা হুবহু এবং একইরূপ হতে হবে এমন নয়। যদি মৃত্যুকালীন ঘোষণার অন্যান্য শর্তাবলী পূরণ হয় তাহলে উক্ত ঘোষণা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
সুতারাং বলা যায় যে, কোন নিহত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে যদি তার মৃত্যুর কারণ, অবস্থা এবং পরিস্থিতি বর্ণনা করে কোন বিবৃতি বা জবানবন্দি প্রদান করে থাকেন তবে তাকে মৃত্যুকালীন ঘোষণা বলে।
লেখক : আইনজীবী, চট্টগ্রাম।
তথ্য কণিকা: সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য- গাজী শামসুর রহমান, এডভোকেট নাসির উদ্দিন – আইন শব্দসমূহ, সাক্ষ্য আইন- বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া, বিডি ল’ পোর্টাল, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২, এডভোকেট মাহমুদ ওয়াজেদ-আইনের সহজপাঠ, উইকিপিডিয়া, সাক্ষ্য আইন- বাসুদেব গাংগুলি।