নাটোরে নদী থেকে বালু উত্তোলন, সেই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
আদালত

ছিনতাইয়ের ঘটনায় মাদক দিয়ে মামলা দেয়ার অভিযোগে ৩ এসআইকে আদালতে তলব

নাটোরে ছিনতাইয়ের আসামীদের মাদক দিয়ে মামলা করার অভিযোগ উঠেছে খোদ পুলিশের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় পুলিশের তিন উপ-পরিদর্শককে সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত ব্যাখা দেয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত।

নাটোরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সাঈদ গত শনিবার (২৩ জুলাই) এ আদেশ দেন। আগামী ২৮ জুলাই সশরীরে হাজির হয়ে গুরুদাসপুর আমলী আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করার নির্দেশ দেন বিচারক।

আদালতসূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার গুরুদাসপুর থানার মধ্যমপাড়া এলাকায় দুইজন ভ্যান ছিনতাইকারীকে আটক করে স্থানীয় জনতা। পরে গুরুদাসপুর পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোখলেছ থানায় ফোন দিয়ে আসামীদেরকে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে পুলিশ গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে ভর্তি করান।

এরপর গত ২৩ জুলাই শনিবার আসামি মো. স্বপন এবং মো. আলহাজ্ব প্রামানিককে নাটোরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠায় পুলিশ। এসময় ম্যাজিস্ট্রেট আসামিদের কাছ থেকে গ্রেফতারের কারণ জানতে চাইলে আসামি মো. স্বপন এবং আলহাজ্ব প্রামাণিক জবানবন্দী দেন যে তারা ভ্যান ছিনতাই করেছিলো কিন্তু পুলিশ তাদের মাদক দিয়ে আদালতে চালান দিয়েছে।

এরপর গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জরুরি বিভাগের কর্মরত ডাক্তার মোঃ সুজাউদ্দিনের দেয়া সেই চিকিৎসা পত্র দেখেন ম্যাজিস্ট্রেট। চিকিৎসা পত্রের মতামতে ডাক্তার উল্লেখ করেন যে, রোগী ভ্যান চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত এবং ২৪ ঘন্টা আগে আসামিগণ জনতা কর্তৃক শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত।

আসামিদের বক্তব্য শুনে এবং গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত ডাক্তারের দেয়া রোগীদের চিকিৎসা পত্রের মতামত বিশ্লেষণ করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রতিয়মান হয়েছে যে আসামিদ্বয় যে ভ্যান চুরির বা ছিনতাইয়ের ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন তা বিশ্বাস করার মত যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।

পরে শনিবার নাটোরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সাঈদ ওই মামলার সংবাদদাতা ও গুরুদাসপুর থানার উপ-পরিদর্শক মো. মাহবুবুর রহমান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মো. জাহিদ হোসেন এবং অপর উপ-পরিদর্শক ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোঃ আখতারুজ্জামানকে আগামী ২৮ জুলাই সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত ব্যাখা দেয়ার আদেশ দেন।

নাটোরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের স্টেনোগ্রাফার মো. শহীদুজ্জামান ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

আসামীদের জবানবন্দির বরাত দিয়ে শহীদুজ্জামান বলেন, গুরুদাসপুর থানাধীন মশিন্দা ইউনিয়নের পাবনখোলা গ্রামের জনৈক ফুরুর কাছ থেকে মোঃ স্বপন ৮০০ টাকা পাওনা থাকায় সেই টাকা না দেয়ায় ভ্যান কেড়ে নিয়ে একই থানার গারিষাপাড়া গ্রামস্থ শরীফের নিকট ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেন বলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দী দেয় আসামী মো. স্বপন এবং আলহাজ্ব প্রামানিক।

জনৈক শরীফ গত ২২ জুলাই আসামি মো. স্বপনকে ৫০০০ টাকা দেয় বাকি ১২০০০ টাকা পরে দেবে দেয়ার কথা বলেন। এরপরই টাকাসহ আসামীদ্বয় গুরুদাসপুর থানাধীন মধ্যমপাড়া দোকানে যান। এক পর্যায়ে গুরুদাসপুর পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোখলেছ সেখানে আসেন। আসামিদ্বয় ৫০০০ টাকা জমা দেন কাউন্সিলরের কাছে।

ঘটনা বিস্তারিত শুনে কাউন্সিলার থানায় ফোন করলে থানা থেকে এসআই মাহাবুর রহমান আসেন। তখন কাউন্সিলর মোখলেস আসামিদের নিকট থেকে ৫০০০ টাকা নিয়ে এসআই মাহবুবুর রহমানের হাতে দেন। এরপর পুলিশ আসামিদেরকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নিয়ে গিয়ে আসামিদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ গ্রাম করে মোট ২০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার দেখিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর অধীনে মামলা রেকর্ড করে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করেন করে বলে জানায় আসামীরা।

আসামিদ্বয় আরো দাবি করেন যে পুলিশ তাদের কাছ থেকে কোন ধরনের মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেনি। মাদকের কোন বিষয়ই ছিল না। এটা ছিল ভ্যান কেড়ে নিয়ে বিক্রয় করার ঘটনা।

এরপর পুলিশ গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুরুদাসপুর জরুরি বিভাগে ভর্তি করান। উক্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জরুরি বিভাগের কর্মরত ডাক্তার মোঃ সুজাউদ্দিন আসামীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে একটা চিকিৎসা পত্র প্রদান করেন। সেই চিকিৎসা পত্রের মতামতে ডাক্তার উল্লেখ করেন যে রোগী ভ্যান চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত এবং ৪ ঘন্টা আগে আসামিগণ জনতা কর্তৃক শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত।

ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর আদেশের পর্যবেক্ষণে বলেন, “এখন প্রশ্ন হল যদি ঘটনাটা ভ্যানচুরি বা ছিনতাইয়ের হয়ে থাকে তাহলে আসামিদের বিরুদ্ধে চুরি বা ছিনতাইয়ের এজাহার দায়ের না করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে কেন মামলা দায়ের করা হলো? আসামীদ্বয় যদি চুরি ছিনতাই করে থাকে এবং তাদের বক্তব্য যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে তাদের নিকট হতে জব্দকৃত ভ্যান এবং ভ্যান বিক্রয় করার টাকা কেন জব্দ তালিকা মূলে জব্দ করা হলো না? এবং তাদের বিরুদ্ধে চুরি বা ছিনতাইয়ের মত গুরুতর অপরাধের অভিযোগে মামলা রেকর্ড করা হলো না?”

“আবার যদি ঘটনাটি চুরি বা ছিনতাইেয়র হয়ে থাকে তাহলে এই মামলায় জব্দকৃত আলামত তথা ২০ গ্রাম গাঁজা কোথায় পেলেন এজাহারকারি এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা? এই প্রশ্নগুলোর সুরাহা হাওয়া জরুরী। আর এই অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতরও বটে। পুলিশের কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তিকে মাদক দিয়ে মামলায় জড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। এই ঘটনা সত্য হলে পুরোনো অভিযোগকেই নির্দেশ করবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। আইনের শাসন ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নেও এই অভিযোগটা অত্যন্ত গুরুতর। এই মামলায় যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে বিষয়টা তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।”

যেহেতু এই বিষয়গুলো নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যৌক্তিক সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে তাই এই বিষয়য়গুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের নিকট থেকে লিখিত ব্যাখ্যা গ্রহণ করা জরুরী।

সার্বিক পর্যালোচনায় ন্যায় বিচার ও মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ম্যাজিস্ট্রেট মামলার সংবাদদাতা এবং গুরুদাসপুর থানার উপ-পরিদর্শক মো. মাহবুবুর রহমান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একই থানার উপ-পরিদর্শক মো. জাহিদ হোসেন এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোঃ আখতারুজ্জামানকে আগামী ২৮ জুলাই সশরীরে হাজির হয়ে গুরুদাসপুর আমলী আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করার নির্দেশ দেন।

এবিষয়ে জানতে চাইলে গুরুদাসপুর পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোখলেছ বলেন, স্বপন এবং আলহাজ্ব একটি ভ্যান চালককে মেরে গুরুতর আহত করে ভ্যান ছিনতাই করে বিক্রি করে দেয়। পরে তাদেরকে পুলিশে সোপর্দ করলে পুলিশ তাদেরকে আদালতে পাঠায়। মাদক উদ্ধারের কোন ঘটনা ছিল কিনা জানতে চাইলে মো. মোখলেছ বলেন কারো কাছে মাদক পাওয়া যায়নি তারা ভ্যান চুরির সাথে জড়িত।

পুলিশের জব্দ তালিকার অপর স্বাক্ষী মো. আবু সান বলেন, আমাকে ফোন করে জানালো স্বপন ভ্যান চুরি করেছে। আমি স্বপনকে ফোনে ডাক দেই পরে স্বপন আসে তার বাবা মাও সেখানে ছিলো। এরপর পুলিশ এসে তাদেকে নিয়ে যায়। স্বপন বা আলহাজ্বের কাছে গাঁজা পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আবু সান বলেন গাঁজা বা কোন মাদক পাওয়া যায়নি।

এসব বিষয়ে মামলার সংবাদদাতা গুরুদাসপুর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, কাউন্সিলর মোখলেছসহ স্থানীয়রা আসামীদের আটটক করে পুলিশে খবর দেয়। পরে তাদের কাছ থেকে গাঁজা উদ্ধার করা হয়। সেইভাবেই জব্দ তালিকা করে আসামীদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। আসামীদের কাছে গাঁজা পাওয়ার বিষয়ে স্বাক্ষীদের অস্বীকার করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন জব্দ তালিকায় স্বাক্ষীদের সই আছে। এখন অস্বীকার করলে তারা স্বাক্ষর করলো কিভাবে?

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একই থানার অপর উপ-পরিদর্শক মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জব্দ তালিকা করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আসামীদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।

গুরুদাসপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আব্দুল মতিন বলেন, ওইদিন তিনি ছুটিতে থাকায় বিষয়টি ভাল করে জানতেন না। তবে তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে আসামীদের গাঁজাসহ গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সেই মোতাবেক তাদেরকে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানান আব্দুল মতিন।

আদালতের শোকজ নোটিশ বা কারণ দর্শানোর বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল মতিন বলেন, আদালতের আদেশের বিষয়ে তিনি জানেন না। আদেশের কপি হাতে পেলে আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলে তিনি।