শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান : আইনের শাসন, সুবিচার লাভ ও সুন্দর জীবনযাপনের অধিকার প্রত্যেক মানুষের রয়েছে। এই আদর্শকে লালন করে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক (১৯৩৬-২০২২) আজীবন আইনের সাধনা করেছেন। একজন খ্যাতিমান আইনজীবী ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি হিসেবে তিনি এই মূলনীতিকে সবসময় ধারণ করতেন। কেউ ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আইনজীবী হিসেবে তাঁর স্মরণাপন্ন হলে তিনি তার পক্ষ সমর্থনে আন্তরিকভাবে মামলা পরিচালনা করে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
আইন পেশার আদর্শ কোথাও লঙ্ঘিত হলে তিনি ব্যথিত হতেন। বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বিচারপতি পদে আসীন হওয়ার পূর্বে প্রায় চব্বিশ বছরের বেশি সময় আইনজীবী পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি টানা আট বছর আইন সাময়িকী ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনস’ সম্পাদনা করেছেন।
আইনজীবী হিসেবে তিনি যেমন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন- তেমনি বিচারক হিসেবেও তিনি প্রজ্ঞা ও ন্যায়নীতির জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি সর্বদা বিশ্বাস করতেন বিচারের আসনে বসে উভয় পক্ষের কথা শুনে নিরপেক্ষ ও নির্ভুল সিদ্ধান্ত দেওয়া একজন বিচারকের প্রধানতম কর্তব্য।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক শুধু বিচারালয়েই নয়, এই আদর্শবাদী ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন একেবারেই সহজ সরল। তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির জীবনসদস্য। বাংলা একাডেমির সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভাসহ নানা অনুষ্ঠানে তিনি একাডেমিতে আসতেন। সেই সময় তাঁর কথাবার্তায় মাধুর্যমণ্ডিত চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যেত। বাংলা একাডেমি থেকে গ্রন্থ প্রকাশ করে, একাডেমির আইন প্রণয়নের বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন মনে প্রাণে বাঙালি।
১৯৫২ সালে তিনি যখন ঢাকা কলেজে ও পরবর্তীকালে কিছুকাল অধ্যয়ন করে বদলি হয়ে ফেনী কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন সেই সময় ভাষা আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ভাষা আন্দোলন তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরেও তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণয় কাজী এবদুল হকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ১৯৫৯ সালে ফেনী মহকুমা আদালতে আইন পেশায় যুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা জেলা আদালতে ও ১৯৬৬ সালে তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে নিয়োজিত হন। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। এরপর ১৯৯০ সালে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি ও ২০০০ সালে আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ২০০১ সালে সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত বয়স পূর্ণ হওয়ায় আপিল বিভাগের বিচারপতি পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বিচারপতি কাজের সমান্তরালে লেখালেখির সাথেও যুক্ত ছিলেন। আইন বিষয়ে তাঁর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ প্রামাণিক ও আকর গ্রন্থতুল্য। তিনি আইন বিষয়ে বেশ কয়েকটি মূল্যবান গবেষণাধর্মী গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- ‘বিচার ব্যবস্থার বিবর্তন’, ‘ভূমি আইন ও ভূমি ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ’, ‘দি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিস ইন বাংলাদেশ’, ‘নজির আইন সংহিতা’ দুই খণ্ডে সমাপ্ত, ‘উচ্চ আদালতে বাংলার চর্চা ও বাংলায় রায়’ প্রভৃতি। এছাড়া তিনি আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকথাও লিখেছেন- ‘ফেলে আসা দিনের কথা’।
তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাপিডিয়া’, ‘কালচারাল সার্ভে অব বাংলাদেশ’ ও ‘হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থের আইন বিষয়ক অনেক ভুক্তি ও প্রবন্ধের রচয়িতা। ‘ঢাকা ল’ রিপোর্টাস’ ও ‘বাংলাদেশ ল্যিগ্যাল ডিসিশনস’সহ কতিপয় আইন সাময়িকীতে তাঁর বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক এশিয়াটিক সোসাইটির জীবনসদস্য ছিলেন এবং বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের উপর্যুক্ত গ্রন্থগুলোর মধ্যে আইন বিষয়ে চারটি গ্রন্থ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থগুলো হলো- ‘বিচার ব্যবস্থার বিবর্তন (১৯৯৮), ‘ভূমি আইন ও ভূমি ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ’ (২০০০), ‘নজির আইন সংহিতা’ প্রথম খণ্ড (২০১১) এবং ‘নজির আইন সংহিতা’ দ্বিতীয় খণ্ড (২০১৩)। তাঁর এ চারটি গ্রন্থ পাঠক মহলে বহুলভাবে পঠিত হয়। এ গ্রন্থ চারটি তাঁর অতুলনীয় কীর্তি। এসব গ্রন্থে আইন বিষয়ে বহুমাত্রিক আলোচনা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য তিনি সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। বাংলা ভাষায় আইনচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থগুলো অপরিসীম ভূমিকা রাখছে।
বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৮ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বিচার ব্যবস্থার বিবর্তন’ প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে বাংলাদেশের বর্তমান বিচারব্যবস্থা উদ্ভব কিভাবে হয়েছে এবং বর্তমান বিচার ব্যবস্থা উদ্ভবের পূর্বে বাংলাদেশ কি ধরনের বিচার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা যেমন সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে তেমনি বাংলাদেশের বর্তমান বিচার ব্যবস্থার গঠন, প্রকৃতি, বিচারকদের এখতিয়ার, ক্ষমতা ইত্যাদি সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিচারাদালতে, আধাবিচারমূলক প্রতিষ্ঠান ও ট্রাইব্যুনালের গঠন পদ্ধতি, তার ক্ষমতা ও বিচার পদ্ধতি সম্পর্কে এ বইতে আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- ‘ভূমি আইন ও ভূমি ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ’। আবহমান কাল থেকে বাঙালি একটি ভূমি নির্ভর জাতি। বাঙালির ভূমির আকর্ষণে দ্রাবিড, মঙ্গোলেয়ড, অস্ট্রিক, আর্থ, মোগল, পাঠান, ইংরেজ প্রভৃতি জাতি এদেশে এসেছে এবং ভূমি ও সম্পদ কুক্ষিগত করেছে। এদশে এসে তারা কখনও কখনও বাঙালি কৃষককে ভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে বা তাদের উৎপাদিত কৃষি সম্পদের উপর ভাগ বসিয়ে তাদের শোষণ করেছে।
বাংলার আদি জনগোষ্ঠীর সাথে বাংলার বাহির থেকে আসা অনেক জনগোষ্ঠীর কালক্রমে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। আদিকাল থেকেই বাংলাদেশে ভূমি নিয়ে আত্মকলহ, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সালিশ বিচার, মামলা-মোকদ্দমা, যুদ্ধবিগ্রহ, নানা সংগ্রাম ও আন্দোলন হয়েছে। এই ভূমি বাঙালির অতি প্রিয়। এই ভূমিতে আদিকালে স্বত্ব দখল কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো, ভূমিতে কার কিরূপ অধিকার ছিল। ভূমিতে অধিকার কালক্রমে কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে। ভূমি অধিকার কি ধরনের নিয়মকানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, কালক্রমে উক্ত নিয়ম কানুন কিভাবে ক্রমবিকাশ লাভ করেছে প্রভৃতি সম্পর্কে নানা ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ মেলে তাঁর ‘ভূমি আইন ও ভূমি ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থে।
এছাড়া এ গ্রন্থে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট জমিদারি প্রথা ও ইহার কুফল এবং ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত ভূমি আইন, ভূমি ব্যবস্থাপনা কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা বর্ণনা করা হয়েছে।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বিচারপতি বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের আরও একটি গ্রন্থ ‘নজির আইন সংহিতা’ প্রথম খণ্ড। এ গ্রন্থে নজির আইন বলতে কি বোঝায়, উচ্চাদালতের রায়ের কোন অংশকে নজির বলে গণ্য করা হয়, উচ্চাদালতের সব রায়কে কেন নজির সৃষ্টিকারী গণ্য করা হয় না, কোন দেশের বিচার ব্যবস্থায় সর্ব প্রথম উচ্চাদালতের নজির পরবর্তী মোকদ্দমায় অনুসরণ করা বাধ্য এ বিষয়গুলো তথ্যসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া বর্তমানে কোন কোন দেশের বিচার ব্যবস্থায় নজির অনুসরণ করা বাধ্য, কোন কোন দেশের বিচার ব্যবস্থায় নজির অনুসরণ করা বাধ্য নয়, কোন কোন অবস্থায় নজির অনুসরণ করা বাধ্য হলেও পরবর্তী মোকদ্দমা বিচারের সময় আদালত তা অগ্রাহ্য করতে পারে, কোন কোন অবস্থায় নজির বাধ্য না হয়ে শুধু প্রত্যয় উৎপাদনকারী হয় তারও ব্যাখ্যা এ গ্রন্থে পাওয়া যায়। এসব বিষয়াবলি বাংলায় অনুবাদ করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া প্রিভি কাউন্সিল, বিভাগ পূর্ব ভারতের ফেডারেল কোর্ট ও স্বাধীনতা পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেল কোর্ট, পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নজিরসহ ২০০৯ পর্যন্ত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নজির তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলা একাডেম থেকে প্রকাশিত বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের আরও একটি গ্রন্থ ‘নজির আইন সংহিতা’ দ্বিতীয় খণ্ড। এ গ্রন্থটি ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়।
এ গ্রন্থটির দ্বিতীয় খণ্ডে কলকাতা হাইকোর্টসহ বিভাগপূর্ব ভারতের অন্যান্য হাইকোর্ট ও বিভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা হাইকোর্ট এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ২০০৯ সাল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেওয়ানি ও ফৌজদারি নজির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ নজিরগুলো বাংলায় অনুবাদ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের বইগুলো আইনের গবেষক, শিক্ষার্থী ও আইনজীবী এবং বিচারকদের নিকট স্বীকৃত ও গ্রহণীয় হবে দীর্ঘ দিন।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ১৯৯৮ উচ্চ আদালতে বাংলা নজির সৃষ্টিকারী রায় প্রদান করে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেন। উচ্চ আদালতে নজির সৃষ্টিকারী যে সকল রায় তিনি প্রদান করেছেন সেগুলোর মধ্যে ‘নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র’ মামলার রায়টি অন্যতম।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত সংবাদপত্র মজুরী বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ১৯৩৬ সালের ১লা জানুয়ারি ফেনী জেলার বালীগাঁও গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রী অধ্যাপক শরিফা খাতুনও ভাষা-সংগ্রামী, যিনি ২০১৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। তাঁদের চার সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠাকন্যা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি কাজী জিনাত হক। বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ২০২২ সালের ১৪ই জুলাই ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তাঁকে ঢাকার নিকুঞ্জ দক্ষিণ আবাসিক এলাকার কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বাংলা ভাষায় আইন বিষয়ে গবেষণা ধর্মী গ্রন্থগুলোর জন্য, বাংলায় নজির সৃষ্টিকারী রায় প্রদানের জন্য, সর্বোপুরি একজন নীতিবান প্রাজ্ঞ বিচারক হিসেবে বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের অবদান বাঙালি জাতি চিরকাল স্মরণ করবে।
লেখক : গবেষক