মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : জাল মার্কশিট দিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার অপরাধে অধস্তন আদালত ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছিলেন। আপীল আদালত সে রায় রদ, রহিত করে অপরাধীকে এক বছরের প্রবেশন দিয়েছেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুল্লাহ আল মামুন গত ২৮ জুলাই প্রবেশনের এ রায় ঘোষণা করেন।
১৯৯৯ সালের ঘটনা। কক্সবাজারের তৎকালীন চকরিয়া উপজেলার পেকুয়া উপকূলীয় শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজে ১৯৯৮-১৯৯৯ শিক্ষা বর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শেখেরখীল গ্রামের পেছু মিয়ার পুত্র মোস্তাফিজুর রহমান।
ভর্তির সাথে এসএসসি পাশের যে মার্কশিট কলেজে জমা দেওয়া হয়। সেই মার্কশিট চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে জাল মার্কশিট বলে রিপোর্ট আসে। এপ্রেক্ষিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করার জন্য ১৯৯৯ সালের ১১ জুলাই শিক্ষা বোর্ড থেকে অধ্যক্ষের কাছে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী পেকুয়া উপকূলীয় শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মুছা সিকদার বাদী হয়ে ১৯৯৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাল জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ফৌজদারী দন্ডবিধির ৪৬৮/৪২০ ধারায় চকরিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার চকরিয়া থানা মামলা নম্বর : ০২/১৯৯৯ ইংরেজি এবং জিআর মামলা নম্বর : ২১৪/১৯৯৯ ইংরেজি (চকরিয়া)।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০০৯ সালের ২১ অক্টোবর মামলাটি বিচারের জন্য চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয়। মামলায় ৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ, জব্দকৃত আলামত প্রদর্শন ও যাচাই, যুক্তিতর্ক সহ বিচারের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কক্সবাজারের তৎকালীন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিশাদুজ্জামান আসামী মোস্তাফিজুর রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারী ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড, ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেন।
এ দন্ডের বিরুদ্ধে মোস্তাফিজুর রহমান কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপীল দায়ের করেন। যার ফৌজদারী আপীল মামলা নম্বর : ২৩৫/২০১৬ ইংরেজি। আপীল মামলাটি বিচারের জন্য কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করা হয়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আপীল মামলাটির সকল কাগজপত্র, অধস্তন আদালতের রায়, আলামত সহ সবকিছু পূঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচলোচনা করে বিচারক অপরাধের মাত্রা অপেক্ষাকৃত লঘু বিবেচনায় এনে বাঁশখালী উপজেলা প্রবেশন অফিসারের কাছে আসামীর জীবনযাত্রাসহ সার্বিক বিষয়ে প্রতিবেদন তলব করেন।
প্রবেশন অফিসার আদালতে তার প্রেরিত প্রতিবেদনে আসামী মোস্তাফিজুর রহমানের সামাজিক, পারিবারিক, পেশাগত আচরণ ভালো বলে জানান। আসামীর স্বভাব চরিত্র ভালো। প্রবেশন অফিসার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, গন্যমান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ তথ্য পান।
এছাড়া আসামীর সন্তানেরা এখন কলেজে পড়ে। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জক্ষম ব্যক্তি। আদালত সাজা দিলে তার পরিবারের সদস্যরা আর্থিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মর্মে প্রবেশন অফিসার তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। আসামীর শাস্তি বহাল রাখার পরিবর্তে প্রবেশনে মুক্তি দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দিতে আদালতে প্রাবেশন অফিসার মতামত দেন।
বিচারক প্রাবেশন অফিসারের মতামত পর্যালোচনা করে আসামীকে শাস্তির পরিবর্তে প্রবেশন দেওয়া অধিকতর বিবেচনাযোগ্য মনে করেন। এরপর গত ২৮ জুলাই অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আসামীকে অধস্তন আদালতের দেওয়া ৫ বছর কারাদন্ড এবং ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের রায় রদ ও রহিত করেন। একইসাথে আসামীকে ১৯৬০ সালের প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স এর ৫ ধারা অনুযায়ী আসামীকে পরবর্তী এক বছরের জন্য প্রবেশন দেন।
প্রবেশনের শর্ত অনুযায়ী আসামীকে ২০ হাজার টাকা বন্ডে ২ জন জাতীয় পরিচয়পত্রধারীর জিম্মায় দেওয়া হয়। আসামী নতুন কোন অপরাধে জড়াতে পারবেন না। শান্তি ভঙ্গ হওয়ার মতো কোন কাজ করতে পারবেন না। আসামী প্রতিমাসের প্রথম ও তৃতীয় সপ্তাহে প্রবেশন অফিসারের কাছে হাজিরা দেবেন। প্রবেশন অফিসার ও সংশ্লিষ্ট থানার ওসি তিন মাস অন্তর অন্তর আসামীর জীবনযাত্রা সম্পর্কে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
প্রবেশনের এক বছর পর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২৭ জুলাই আসামীর প্রবেশন শেষ হবে। এরমধ্যে, আসামীর বিরুদ্ধে প্রবেশন এর শর্ত ভঙ্গ করার কোন অভিযোগ পেলে ১৯৬০ সালের প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স এর ১১ ধারা অনুযায়ী প্রবেশন বাতিল করে আসামীকে ফৌজদারী দন্ড বিধির ৪৬৮/৪২০ ধারার বিধান মতে শাস্তি প্রদান করা হবে। পরে প্রবেশন আদেশের শর্ত অনুযায়ী আসামী ও তার জিম্মাদারগণ আদালতে লিখিত অঙ্গীকারনামা দেন।
প্রবেশনের বিষয়ে আসামী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ অধস্তন আদালতের দেওয়া শাস্তি রদ ও রহিত করে তাকে প্রবেশন দেওয়ায় তিনি খুব খুশী। আপীল আদালত অধস্তন আদালতের শাস্তি বহাল রাখলে এ বয়সে এটা তার জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক ও অসম্মানজনক হতো বলে জানান। প্রবেশন মোস্তাফিজুর রহমান ও তার পরিবারের জন্য অসাধারণ প্রাপ্তি বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
শাস্তি দিলে তার পুরো পরিবার তছনছ হয়ে যেত উল্লেখ করে আসামী মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী ও জিম্মাদার মোরশেদা বেগম বলেন, কারাদন্ড না দিয়ে প্রবেশন দেওয়ায় তার স্বামী নিয়মিত পেশার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে সংসার চালিয়ে যেতে পারবে। কলেজ পড়ুয়া সাবালক সন্তানদের নিয়ে সমাজে মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবো।
আদালতে রাষ্ট্র পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট সুলতানুল আলম বলেন, দীর্ঘ ২৩ বছর মামলা চালাতে গিয়ে আসামী মোস্তাফিজুর রহমান যে কষ্ট পেয়েছেন, তাতে আসামীর অনেকটা শাস্তি হয়ে গেছে। প্রবেশনের কারণে আসামী নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ পেয়েছে। এ মামলায় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শাস্তির বদলে প্রবেশন দিয়ে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারকে নির্ভয়ে ও সাবলীলভাবে চলতে অনেকটা পথ খুলে দিয়েছেন।