মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের ছনখোলার ঘোনার পাড়া তেইল্ল্যাকাটা এলাকায় সংরক্ষিত বনভূমি উজাড় করে পাহাড় কাটার সাথে জড়িতদের সনাক্ত করে বিস্তারিত নাম ঠিকানা সহ তালিকা তৈরি পূর্বক আগামী ২৫ আগস্টের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন কক্সবাজারের পরিবেশ আদালত।
একইসাথে কি পরিমাণ পাহাড় কাটা হয়েছে, ঘটনাস্থলের খসড়া মানচিত্র, পাহাড় ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, সাক্ষীদের জবানবন্দী সহ সবকিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
উল্লেখিত এলাকায় সংরক্ষিত বন উজাড় করে পাহাড় কেটে সাবাড় করা নিয়ে গণমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক নিয়মিত স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম’র নজরে আসে।
ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পরিবেশ অধিদপ্তরকে স্বপ্রণোদিত হয়ে বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) আদেশটি দিয়েছেন বিচারক। যার মিস মামলা নম্বর : ০১/২০২২ (কক্সবাজার)। পরিবেশ আদালত গঠনের প্রথমদিনেই বিজ্ঞ বিচারক এ ব্যতিক্রমী আদেশ দেন।
কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নুরী ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম‘কে এ তথ্য জানিয়েছেন।
আদেশে বিচারক মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, কক্সবাজার সদরের পিএমখালী’তে সংরক্ষিত বনভূমির পাহাড় কাটা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত ৮ আগস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে আমলী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কতিপয় পরিবেশ দস্যু দ্বারা নির্বিচারে সরকারী পাহাড় কেটে কোটি কোটি টাকার মাটি বিক্রয় করে একটি অসাধুচক্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
আদেশে আরো বলা হয়, পাহাড় অমূল্য সম্পদ। প্রাকৃতিক পাহাড়ে প্রচুর ফলজ, বনজ গাছ, তরুলতা প্রকৃতির অকৃপণ আর্শিবাদে বেড়ে উঠে। এসব পাহাড় বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখির অবাধ বিচরণ ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এসব পাহাড় নানাভাবে পরিবেশকে রক্ষা করে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিচারক বিশ্লেষণে আরো বলেন, কক্সবাজার প্রতিবেশগতভাবে একটি সংকটাপন্ন এলাকা। এখানে পরিবেশের যেকোন বিপর্যয় স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে যেকোনভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা একান্ত অপরিহার্য।
এবিষয়ে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের রীট পিটিশন নম্বর-৫৯৫৯/২০১১ মামলায় কক্সবাজারের প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। অবৈধভাবে সরকারি পাহাড়ের বিপুল পরিমাণ মাটি কেটে সাবাড় করার মাধ্যমে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে, যা ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ মর্মে আমলী আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়।
কিন্তু উপযুক্ত অপরাধসমূহ সুনির্দিষ্টভাবে কার দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে, তাদের বিস্তারিত নাম, ঠিকানা গণমাধ্যমের উক্ত প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট নয়। অপরাধটি কাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তা প্রাথমিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিরুপন করা প্রয়োজন। আসামিদের সনাক্ত করাসহ সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণ, ঘটনাস্থলের খসড়া মানচিত্র প্রস্তুত, পাহাড়ের কি পরিমাণ মাটি কাটা হয়েছে, তা নিরুপন করা প্রয়োজন।
এমতবস্থায়, বর্ণিত বিষয়ে যাচাইপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামী ২৫ আগস্টের মধ্যে আদালতকে অবগত করতে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ-পরিচালককে নির্দেশ প্রদান করেছেন-কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক নিয়মিত স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম।
আদালতের আদেশের কপি কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরিবেশের কক্সবাজারস্থ কার্যালয়ের উপ পরিচালকের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক (জ্যষ্ঠ উপসচিব) মুফিদুল আলম জানান, কক্সবাজার পরিবেশ আদালতের বিজ্ঞ বিচারকের গত ১১ আগস্টের আদেশ ইতিমধ্যে তিনি পেয়েছেন।
আদালতের নির্দেশনা মতো বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল সহ এ বিষয়ে সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজারস্থ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম‘কে তিনি জানিয়েছেন।
পরিবেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম আরো জানান, কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের ছনখোলার ঘোনারপাড়ার তেইল্ল্যাকাটা এলাকায় সংরক্ষিত বনভূমি উজাড় করে পাহাড় কাটার বিষয়টি আগে পরিবেশ অধিদপ্তর অবহিত ছিলো না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনার আগেই বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরে আসার পর ঘটনাস্থল সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন বিজ্ঞ আদালত প্রতিবেদন তলব করায় আদালতের নির্দেশনা মতো আরো হালনাগাদ প্রতিবেদন দিতে পরিবেশের স্থানীয় কার্যালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার পরিবেশ আদালতের স্বপ্রণোদিত আদেশ সম্পর্কে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তারেক ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম‘কে বলেন, এ মামলার আদেশে বিজ্ঞ বিচারকের দেশপ্রেম ও দূরদর্শিতা ফুটে উঠেছে এবং উচ্চ আদালতের আদেশের আইনানুগ প্রতিফলন ঘটেছে। আদেশে বিজ্ঞ বিচারক পেশাদারিত্ব এবং দায়িত্বশীলতার অসাধারণ নজীর রেখেছেন। এ আদেশ সমাজ ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তারেক।
কক্সবাজারের পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) এর প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম‘কে বলেন, কক্সবাজারে পরিবেশ আদালত গঠন করার জন্য অনেক আগে থেকে তারা দাবি জানিয়ে আসছিলো। এ দাবি পূরণ হওয়ায় তার সংগঠন এটাকে অন্ত্যন্ত ইতিবাচক হিসাবে দেখছে।
পরিবেশ আদালতকে কক্সবাজারের পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসাবে উল্লেখ করে বিশিষ্ট পরিবেশবাদী ইব্রাহিম খলিল মামুন আরো বলেন, নব গঠিত পরিবেশ আদালত কক্সবাজারের সার্বিক পরিবেশ সুরক্ষায় আইনী ঢাল হিসাবে কাজ করবে।
তিনি পরিবেশ আদালতের আদেশকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, এ ধরনের আদেশ পরিবেশ ধ্বংসকারীদের কিছুটা হলেও আতংকিত করে তুলবে এবং পরিবেশদস্যূরা আইনের আওতায় আসবে।
কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নুরী ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম‘কে জানান, গত ১১ আগস্ট কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মোহাম্মদ ফারুকী ‘জাস্টিস অব দি পিচ’ হিসাবে ৪৩/২০২২ নম্বর অফিস আদেশে কক্সবাজারে ‘পরিবেশ আদালত’ গঠন করেন।
তিনি জানান, ২০০৮ সালের ১৯ মার্চ, ২০১১ সালের ২২ মার্চের বিচার বিভাগের বিচার শাখা-১ এবং ৩ এর জারীকৃত প্রজ্ঞাপনের আলোকে পরিবেশ সংক্রান্ত ন্যায় বিচার (Environmental justice) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিবেশ আইন ২০১০ এর ১২(১১) ধারা মোতাবেক পরিবেশ আদালত গঠন করেন। আদেশ অনুযায়ী কক্সবাজারের বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৬ষ্ঠ আদালত কক্সবাজার পরিবেশ বিষয়ক নিয়মিত “স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত” হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
একইভাবে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন চৌকি আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে পরিবেশ অপরাধ বিষয়ক একই দায়িত্ব পালন করবেন। পরিবেশ আদালতের বিচারকগণ পরিবেশ বিষয়ক অপরাধের জন্য নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করতে পারবেন বলে আদেশে উল্লেখ রয়েছে।
পরিবেশ সংক্রান্ত অপরাধ আমলে নিতে এবং বিচার কার্যক্রম আরো বেগবান করতে কক্সবাজারে ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক, পরিবেশগত অবস্থা বিবেচনা করে পরিবেশ আদালত গঠন করা হয়েছে বলে কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট আলমগীর মোহাম্মদ ফারুকী তাঁর আদেশে উল্লেখ করেছেন।