আমেনা হুদা : আমি এক পাহাড়িকন্যা, পাহাড়ে ঘেরা পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলায় আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা।তাই অনেক কাছ থেকে পাহাড়ের কন্যাশিশুদের জীবনযাত্রা আমি দেখেছি।তাই আজকে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বিষয় সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।
আমি যখন প্রাইমারিতে পড়াশোনা করি তখনকার সময়ে আমার এলাকার অনেকে আমার সাথে পড়াশোনা করত।যখন আমি প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিককে ভর্তি হয়েছি তখন আমি আমার প্রাথমিকের অনেক বন্ধুকে আর সাথে পাইনি।প্রাইমারির গন্ডি না পেরোতেই দুই তিন বছরের মধ্যেই আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যায়।ফলে আমরা মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির ও পড়াশোনা করার সুযোগ পাই, বাকিরা সবাই ঝরে পড়ে নানা সামাজিক ও আর্থিক সীমাবদ্ধতায়।
আমি যখন মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলাম তখন আমার ক্লাসে দুই শাখায় মিলে প্রায় ১৩০ জন ছাত্রী ছিলাম।মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার আগেই তাদের মধ্য থেকে অনেকেরই বিয়ে হয়ে যায়। আমি যখন মাধ্যমিক পাশ করি ইতোমধ্যে আমার অনেক বান্ধবী পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়েছে। বিয়ে করে সংসার শুরু করেছে কেউ, কারো আবার পারিবারিক টানাপোড়ানে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
আমাদের মধ্যে থেকে আমরা হাতেগোনা ২০-৩০ জন কলেজে ভর্তি হই। কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর কয়েকজনের সুযোগ হয়েছিল উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের এমনকি আমার অনেক মেধাবী বান্ধবীরাও এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
এবার আসি বর্তমান পরিস্থিতির কথায়, কিছুদিন আগে আমি ঈদুল আজহা উদযাপন করতে আমার গ্রামের বাড়িতে যাই।আমার ছোটবোনও এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী, সে আমাকে জানায় আপু তুমি কি জানো করোনাকালে স্কুল ছুটির সময় আমার ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে এবং অনেকের এখন বাচ্চাও আছে, আমি একথা শুনে হতবম্ব হই, শিহরিত হই।কেননা সময় বদলেছে অনেক কিন্তু পরিস্থিতি তো ততোটা বদলায়নি! এখনও সেই আগের মতোই সমাজে প্রচলিত আছে বাল্যবিবাহ!এই বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করে। আমার মনে হয়েছে এই জায়গাটাতে আমার কিছু করা প্রয়োজন! সব অঞ্চলে না হোক অন্তত আমার পাহাড়ী এলাকার কন্যাশিশুদের পাশে তো আমি দাঁড়াতে পারি।
কর্মক্ষেত্রে যখন আমি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বগুড়ার শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে আইন কর্মকর্তা পদে কর্মরত ছিলাম তখন নারী শিক্ষা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করেছি।প্রয়োজনে কথা বলেছি এসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে, সরকারি বেসরকারি এনজিও কর্মকর্তাদের সাথে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমে যোগদান করেছি। কাজের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে নারী শিক্ষার বিষয়ে পরিস্থিতি কি পাহাড় কি সমতল সব জায়গায় মোটামুটি একই রকম রয়ে গেছে। মেয়েদেরকে বাবা-মা’রা যেন বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই চিন্তা মুক্ত হন। এই চিন্তা মুক্তির বিষয়টিই আসলেই চিন্তা তৈরির বড় কারণ।কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে শুধুমাত্র পাহাড়ি মেয়েরা নয় সারা বাংলাদেশের অবস্থা মোটামুটি একই অধিকাংশ মেয়েদের এই সুযোগ হয়না উচ্চশিক্ষা গ্রহণের, তার অন্যতম বাধা হল বাল্যবিবাহ।
বাল্যবিবাহ বন্ধে বর্তমান সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কন্যা শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ এসব পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম। তাছাড়াও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইনে বিবাহের জন্য মেয়েদের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ এবং ছেলেদের ২১ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়নি।বিয়ে রেজিস্ট্রেশনে শর্ত থাকে যে মেয়েদের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছর পূর্ণ হলে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হবে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন দায়গ্রস্ত অভিভাবকরা।
ঠিক যেই সময়ে আমি লিখতে বসেছি তার আগ মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কতিপয় আলেমকে বলতে শুনেছি মেয়েদের এত পড়াশোনা করার দরকার নেই। শুধুমাত্র কোন ভাবে সংসারের হিসাব রাখতে পারে এমন একটু আধটু পড়তে ও শিখতে পারলেই হল।যেই সকল আলেম এই ধরনের কথা বলেন আপনাদেরকে বিনয়ের সাথে বলতে চাই ঠিক আপনারাই যখন পরিবারবা মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান তখন আবার নারী ডাক্তার খুঁজেন। নারী শিক্ষার জন্য শিক্ষক, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নারী পুলিশ, বিমানে নারী বিমানবালা, নারী আইনজীবি, সরকারের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে নারীদের খুঁজতে থাকেন কিন্তু আপনারাই আবার নারী শিক্ষার বিরোধীতা করেন!
তবে সারাবিশ্বের নাম করা ইসলামিক কোন চিন্তাবিদকে আমি কোন দিন নারী শিক্ষার বিরোধীতা করতে শুনিনি, তাদের সকলের একটি বিষয়ে উদ্বেগ হলো নারী শিক্ষার জন্য শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ। এই বিষয়ে আমিও একমত। যেই দেশে মেয়েরা চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয়, রাস্তায় ইভটিজিং এর শিকার হয়, কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় সেই জায়গায় নিজের স্ত্রী, বোন অথবা মেয়েকে বাড়ির বাহিরে শিক্ষা গ্রহণ বা যেকোন কাজে পাঠাতে চিন্তিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। আমি মনে করি যেদেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী সেই দেশে মেয়েদের জন্য নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা খুব বেশি কষ্ট সাধ্য হবার কথা নয়, প্রয়োজন শুধুমাত্র কিছু সুনিদির্ষ্ট পদক্ষেপ।
পরিশেষে বলতে চাই, শুধুমাত্র পাহাড়ের কন্যা শিশু নয়, এই দেশের সকল বাবা-মা এবং তাদের পরিবারকে তাদের পুত্রশিশুর ন্যায় কন্যাশিশুটিকেও শিক্ষার আলোয় বিকশিত হবার সুযোগ দিতে হবে। আপনার কন্যাশিশুটিকে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করুন, বাল্যবিবাহ এর হাত থেকে মুক্তি দিন, দেখবেন একদিন আপনার কন্যাসন্তানরাও পুরুষের পাশে এই সমাজে, দেশে আলোকবর্তিকা হয়ে আলো ছড়াবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন আপনার সোনার বাংলার অর্ধেকর বেশি জনসংখ্যাকে বাদ দিয়ে সোনার বাংলার স্বপ্নপূরণ অসম্ভব, তাই আমি উপরোক্ত বিষয়ে আপনার এবং সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।যাতে করে সোনার বাংলার কন্যাশিশুরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় এবং নারীরা পায় তার যথোপযুক্ত নিরাপদ কর্মপরিবেশ।
লেখক : আইনজীবী ও সাবেক আইন কর্মকর্তা, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।