সাইফুল ইসলাম পলাশ : যৌন অপরাধের একটি মামলায় ভিকটিমের কথা শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। মামলাটিও ছিল বিরলতর বিরল মামলা। অথচ মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামতগুলো ভিকটিম নিজের অজ্ঞতাবশত নষ্ট করে ফেলেছে।
আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগের ঘটনা। আমি তখন রাজশাহীতে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলাম। অষ্টাদশী মেয়েটিকে যখন আমার চেম্বারে আনা হলো তখন তার চোখ-মুখ ভীষণ ফোলা ফোলা লাগছিল। মনে হচ্ছিল কয়েকদিন খুব কান্নাকাটি করেছে। তাকে কিছুক্ষণ আগে পুলিশ হাসপাতাল থেকে মেডিকেল পরীক্ষা করিয়ে এনেছে। আমার কাজ হচ্ছে আইনের বিধান অনুসারে সেই ভিকটিমের জবানবন্দি রেকর্ড করা। সেদিন স্টেশনে কোনো নারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন না। অগত্যা এরূপ পরিস্থিতিতে আমাকেই তার জবানবন্দী রেকর্ড করতে হচ্ছিল।
ভাবলেশহীন মেয়েটি একদম চুপচাপ বসে আছে। জিজ্ঞেস করলেও কথা বলছে না। যেন তার সকল কথা ফুরিয়ে গেছে। তাকে আমার নিজের পরিচয় দিলাম। অভয় দিলাম নিঃসংকোচে সবকিছু খুলে বলার। আমার আশ্বাসে তার মুখে কথা ফুটলো। মেয়েটির কন্ঠ কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে শোনালো। সর্দি লেগে বসে গেলে কন্ঠ যেমন আবেগহীন হয়ে যায় ঠিক তেমন।
বললেন, “আমার বিয়ে হওয়ার এক বছর হলো। আমার স্বামী ও শ্বশুর একসাথে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করে। বিয়ের পর থেকে আমার স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। আমরা গরীব হলেও কোনো কিছুর কমতি ছিল না”।
জিজ্ঞেস করলাম তারপর কি হল?
– আমার শ্বশুর আমাকে মেয়ের মতই ভালবাসতেন। আমিও তাকে বাবার মত শ্রদ্ধা করেছি। কিন্তু..
কি হলো বলুন!
– স্যার, আমি আর বলতে পারব না।
আসলে এমন অনেক বিষয় থাকে যা একজন নারী শুধু একজন নারীকেই বলতে পারে। পুরুষ সে যে পদেরই হোক যত কাছেরই হোক, তাকে বলতে সংকোচ বোধ করে। তাকে আবার বলতে বললে বললেন-
“সেদিন আমার স্বামী ও শাশুড়ি বাড়িতে ছিল না। তারা আমার নানা শ্বশুরের বাড়ীতে গেছেন। আমি টিভিতে নাটক দেখছিলাম। বাবা আমার কাছে পানি খেতে চাইলেন। আমি একটা গ্লাস ভালোভাবে পরিস্কার করে পানি এনে দিলাম। বাবা পানি খেলেন। পানি খাবার পরপরই আমার হাত ধরে জোর করে বিছানায় নিয়ে গেলেন…”
বললাম, আপনি বাধা দেননি? চিৎকার করেননি?
“স্যার, আমার সারা শরীর কাঁপছিল। আমি চিন্তাও করতে পারিনি বাবা এমন কিছু আমার সাথে করতে পারে। পরের দিন আমার স্বামী-শাশুড়ি আসলেন। তাদেরকে ঘটনা খুলে বললাম। আমার স্বামী বাদী হয়ে বাবার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করলেন।”
জিজ্ঞেস করলাম, ইতোমধ্যে গোসল করেছেন কিনা? যে কাপড়গুলো গায়ে ছিল সেটা পুলিশকে দিয়েছেন কিনা?
জানালেন, “ঘটনার পরপরই তাৎক্ষনিক গোসল করেছি। কাপড় চোপড় যা গায়ে ছিল সব সাবান দিয়ে ভালোভাবে পরিস্কার করেছি।”
তার কথা শুনে ভিতরে ভিতরে একটা ধাক্কা খেলাম। খেয়াল করলাম ভিকটিম বিবাহিতা, তার উপর আবার তিনি আসামীকে কোনো বাঁধা দেননি এবং গোসলের ফলে আলামতও ২/৩ দিনে নষ্ট হয়ে গেছে হয়তো। ফলে মেডিকেল সার্টিফিকেট ভিকটিমের অনুকূলে নাও আসতে পারে। তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে যাওয়ার সময় বললাম, আজকের কথাগুলোই আদালতে বলতে হবে। শুধু আপনার কথার উপর ভিত্তি করেই আসামীর সাজা হতে পারে।
ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মামলাগুলোর বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। তবে তদন্তকালীন সময়ে মামলাগুলো মনিটরিং করতে গিয়ে বুঝেছি ঘটনার পর ধর্ষিতার নিজেকে পরিষ্কার বা গোসল করা উচিত নয়। কারণ ধর্ষণকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর শরীরে কিছু প্রমাণ চিহ্ন রেখে যায়। ডাক্তারী পরীক্ষার মাধ্যমে নারীর শরীর থেকে শুক্রাণুর উপস্থিতি, জখমের চিহ্ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা যায় যা ধর্ষণ প্রমাণ ও ধর্ষণকারীকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। ধর্ষণের সময় পরিহিত কাপড় পরীক্ষা করলেও আসামীকে সনাক্ত করা যায়।
এ প্রসঙ্গে বহুল আলোচিত একটি ঘটনার কথা বলি। ১৯৯৮ সালে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার সহকর্মী মনিকা লিউনিস্কির সাথে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ অস্বীকার করলেও তদন্তকালে মনিকার পরিহিত কাপড় পরীক্ষায় তাতে বিল ক্লিনটনের শুক্ররস পাওয়া যায়। তাই ধর্ষিতার পরিহিত কাপড় সংরক্ষণ করা জরুরী।
এই ধরণের মামলায় ফরেনসিক এভিডেন্সটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অপরিহার্য নয়। ভিকটিমের সাক্ষ্য যদি বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য হয় তবে অধিকতর সাক্ষ্য প্রমাণের সমর্থন ছাড়াই কেবল তার সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করেই অপরাধীকে দণ্ডিত করা যাবে (শামসুল হক বনাম রাষ্ট্র, ৫২ ডিএলআর ২৫৫; সাফাজ উদ্দিন বনাম রাষ্ট্র, ১৩ বিএলসি ২৭১)।
ভিকটিমের জবানবন্দী শেষে গ্রেফতারকৃত আসামীকে আমার খাস কামড়ায় আনা হলো। আসামীর বয়স ৪২। সুঠাম দেহের অধিকারী। তবে চেহারায় রুক্ষতা ও ক্লান্তির ছাপ। মাথার চুলগুলো একটু খাড়া খাড়া। ব্যাক ব্রাশ করা চুলগুলো মনে হচ্ছে একেকটি শক্ত গুনা।
জিজ্ঞেস করলাম, গ্রেফতার বিষয়ে বাড়ির লোকজন জানে কিনা?
বললেন, তার বাড়ীর লোকজনই তাকে ধরিয়ে দিয়েছে। উনাকে বসতে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, পানি খাবেন কিনা?
আমার অভিজ্ঞতা বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামান্য পানি খেয়েই দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তি ও ভীতিটা কেটে যায়। আসামীও যথারীতি পানি খেলেন এবং ক্রমশঃ আমার উপর আস্থা রাখতে শুরু করলেন।
এটা কী করেছেন আপনি? মেয়েটি আপনাকে নিজের বাবার মত শ্রদ্ধা করতো, ভালোবাসতো!
– স্যার, আমি কিছু করিনি।
আপনি জানেন, আপনি শুধু আপনার ছেলের বউয়ের সম্ভ্রমহানি ঘটাননি, আপনার প্রতি তার যে অগাধ আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা ছিল সেটা নষ্ট করেছেন। আপনি রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ করেছেন।
– স্যার… আমি কিছু করিনি।
বললাম, আপনি শুধু তার শরীরটাকে নষ্ট করেন নি, তার মন, মর্যাদা ও পবিত্রতাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করেছেন। প্রকারান্তরে আপনি আপনার ছেলেটাকে নষ্ট করেছেন। আপনার ছেলে কী আর কোথাও মুখ দেখাতে পারবে?
এই কথা শোনার সাথে আসামী আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। তিনি চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, “স্যার, আমি একথা কোথাও বলিনি। থানার দারোগা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে, বলিনি। আপনাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ল। আমি পাপ করেছি স্যার… আমাকে ফাঁসি দেন…।”
বললাম, “আপনার মামলার বিচার আমার আদালতে হবে না। বিচার হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। সেখানে আপনার অপরাধ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।”
– আমার যা হয় হোক, তবুও বলব। স্যার, আমি অনেক বড় পাপ করেছি। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না।
আপনার পাপের সীমা আছে, কিন্তু আল্লাহর ক্ষমার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আপনার পাপগুলো আল্লাহর দয়ার চেয়ে বড় নয়।
দেখলাম আসামী সত্যিই অনুতপ্ত হয়েছে। আর এরূপ প্রেক্ষিতে দোষ স্বীকারোক্তি যদি স্বেচ্ছা প্রণোদিত ও সত্য হয় তাহলে উক্ত স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আসামীর সাজা হতে পারে {ইয়াসিন রহমান বনাম রাষ্ট্র, ১৯ বিএলসি (এডি) ৮; রাষ্ট্র বনাম আব্দুল কাদের, ৬৭ ডিএলআর (এডি) ৬, রাষ্ট্র বনাম রফিকুল ইসলাম, ৫৫ ডিএল আর (এডি) ৬১}।
আসামীর এমন ভাবসাব দেখে তার কাছে বিস্তারিত ঘটনা শুনলাম। আনঅফিসিয়ালি তার বক্তব্য রেকর্ড করলাম। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন ছাড়া আসামীর এরূপ জবানবন্দীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাই এমন বিরলতর বিরল চাঞ্চল্যকর মামলায় আইনী কূটতর্ক এড়ানোর জন্য তাৎক্ষনিকভাবে আমি কোর্ট ইন্সপেক্টরকে বিষয়টি জানালাম এবং আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে একটি আবেদন দিতে বললাম।
পরের দিন রবিবার আনুষ্ঠানিক জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি দোষ স্বীকারোক্তি করতে অটুট থাকলেন। সেদিন দুপুর ২:৩০/৩:০০ টার দিকে সবে এজলাস থেকে নেমেছি। সংশ্লিষ্ট থানার আমলী আদালতের বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ফোন করলেন। তিনি তাড়াতাড়ি তার চেম্বারে যেতে বললেন। আরও বললেন, একটি মজার ঘটনা আছে ভাই। ফোনে বলা যাবে না।
বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের চেম্বারে প্রবেশ করতেই দেখি সেই আসামী বসে আছে। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট তার জবানবন্দী লিখার ফর্ম পূরণ করছেন। আমাকে দেখে লোকটি উঠে দাঁড়ালেন।
বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট হাসতে হাসতে বললেন, “এই লোক বলছে আপনি নাকি তার বাবার মত দেখতে। গতকাল আপনাকে দেখেছে। আজ আপনাকে একবার দেখতে চায়।”
সত্যিই হাসির কথা। ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত স্বীকারোক্তির পূর্বে দেখতে চায় আমাকে! আমি নাকি তার বাবার মত দেখতে। অথচ আমি তার চেয়ে দুই বছরের ছোট!
[বি.দ্র. সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। পক্ষগণের সম্মানার্থে নাম-ঠিকানা গোপন করা হয়েছে]
লেখক: মো. সাইফুল ইসলাম, বিচারক (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), প্রাবন্ধিক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা।