ব্যারিস্টার পল্লব আচার্য : বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, বাংলাদেশের সংবিধানে আমাদের দেশের সকল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি, এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আমাদের যেমন প্রয়োজন অর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঠিক তেমনভাবে আমি মনে করি অপরাধ হ্রাস করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
কোনো দেশ একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে উন্নতি করলে আমরা তাকে সামগ্রিক ভাবে উন্নত দেশ বলতে পারিনা, সার্বিকভাবে উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের নাগরিক অধিকার এবং তার প্রয়োগ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকতে হবে এবং তা একমাত্র সম্ভব সঠিক আইন শিক্ষার মাধ্যমে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি অধিকাংশ অপরাধ হওয়ার পিছনে মূল কারণ হচ্ছে আমরা সঠিকভাবে আইন-কানুন জানিনা এবং মানি না। যে কোন দেশে অপরাধ হ্রাস করতে গেলে নাগরিকদের সচেতনতা এবং ওই দেশের আইনের উপর জ্ঞান থাকা আবশ্যক এবং বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়।
“আইন” শব্দটা শুনলে মনে হয় অনেক ধারা, উপধারা, অধ্যাদেশ, আদেশ ইত্যাদি মনে রাখতে হয়। তা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। বিখ্যাত আইনবিদ জন অস্টিনের মতে “সার্বভৌমের আদেশই আইন।” সহজ ভাষায় বলা যায়, মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যা প্রয়োগ করা হয় তাই আইন। জন অস্টিন আরো বলেন “Law is a command which obliges a person or persons to a course of conduct।” অর্থাৎ আইন হল আদেশ যা একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিকে আচরণের জন্য বাধ্য করে।
আইন হল কাঠামোগত বিধিবিধান। কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে নিয়ম নীতিমালা যখন সকলের জন্য মেনে চলার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে তখন তাকে আইন বলা হয়। অন্য কথায় একজন নাগরিক এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কি করতে পারবে এবং কি করতে পারবে না তার একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালাই হচ্ছে আইন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোন প্রথা বা রীতিকে আইন বলা হয়।
একজন বাঙালি এবং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি যখন নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং অপরাধ হ্রাস পাবে তখনই যখন বাংলাদেশের পাঠ্য পুস্তকে প্রাথমিক থেকেই আইন বিষয়ক একটি বই থাকবে।
আমাদের কোমলমতি শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকেই তাদের নাগরিক অধিকার এবং কোন অপরাধ সংগঠিত হলে তাদের পদক্ষেপ কি হবে সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে, তাহলে একদিকে তারা যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধ রোধে সহায়তা করতে পারবে অন্যদিকে তারা নিজে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং, শিশু ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের আকার ধারণ করেছে এই ক্যান্সারকে গোড়া থেকে নির্মূল করা সম্ভব একমাত্র আইন শিক্ষার মাধ্যমে। একজন শিশু বা কিশোর যদি জানতে পারে অপরাধের ভয়াবহতা, পরিনতি এবং তার শাস্তি কি তাহলে সে অপরাধ করার আগে অবশ্যই একবার হলেও ভাববে। একজন নিষ্পাপ শিশুকে খেলনা বা উপহারের প্রলোভন দেখিয়ে যখন ধর্ষণ করা হয় বা স্কুল কলেজে পড়ুয়া কোন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় ইভটিজিং করা হয় সেই শিশু/ শিক্ষার্থী পিতা-মাতাকে বলতে ভয় পায়, সে ভয় একমাত্র আইন শিক্ষার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব।
আমার মনে আছে আমি যখন প্রাথমিক স্কুলে পড়তাম তখন প্রাথমিক চিকিৎসা নামে একটি অধ্যায় ছিল, আমাদেরকে শিখানো হতো কাটা-ছেঁড়া বা ব্যথা পেলে কি করতে হবে এবং তা এখনো আমার মনে আছে। যদি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা থাকতে পারে তাহলে প্রাথমিক আইন শিক্ষা কেন নয়?
আমরা যদি আমাদের সন্তানদেরকে ছোটবেলা থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ম রীতি এবং শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারি তাহলে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের অপরাধ অনেকাংশেই কমে আসবে। বাংলাদেশ একটি রোল মডেল হয়ে বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। অপরাধ নামক ক্যান্সারকে আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে নিবারণ করা সম্ভব।
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।