সিরাজ প্রামাণিক:
বাংলায় প্রচলিত প্রবাদগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। যে যত দোষ করুক না কেন, সব নন্দ ঘোষের ঘাড়েই যায়! সম্প্রতি জনৈক মোয়াক্কেল ঢাকার একটি আদালতে একজন আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ হচ্ছে আসামীকে খালাস করিয়ে দিতে বিভিন্ন সময় টাকা পয়সা নিলেও ব্যর্থ হয়েছেন। প্রতিদ্বন্ধী বিচারকও অভিযুক্ত আইনজীবীকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ফেসবুক, আদালতপাড়া, সংবাদপত্র, টেলিভিশনের টক’শ থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত চলছে এ আলোচনা। চলাটাই স্বাভাবিক। দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিচার বিভাগের ভূমিকা যেমন বলে শেষ করা যাবে না; ঠিক তেমনি আইন, আদালত, বিচার ব্যবস্থা, বিচার পদ্ধতি ও আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে আইনজীবীদের ভূমিকাও অপরিসীম। বিচার ব্যবস্থা যখন দূর্নীতিতে কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে গ্রীনেস বুকে নাম লেখান, তখন কাউকেই জেলে পাঠানোর আদেশ দেয়া হয় না; বরং দূর্নীবাজদের পুরুস্কৃত করা হয়। ‘কোর্টের ইট-পাথর, ঘাস’ ঘুষ খায়-এ প্রবাদ বাক্যটা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকবে-কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? একজন জারীকারক যখন নোটিশ জারী করতে গিয়ে মোয়াক্কেলের কাছে মোটা অংকের উৎকোচ দাবী করে, উৎকোচ না পেয়ে সমন জারী হতে যখন ৫ বছর লেগে যায়-তখনতো কোন জারীকারকের জেলে পাঠানোর আদেশ দেয়া হয় না কিংবা কোনরুপ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।
কষ্টের কথা এই যে, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বিচারক, বিচারপতি, সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী এমনকি খুনী, দূর্নীতিবাজদের বাঁচাতে আমাদের দেশে নতুন নতুন আইন তৈরী হলেও আইনজীবীদের সুরক্ষায় অদ্যবধি কোন আইন তৈরী হয়নি। কাজেই নিজে নিরাপদ না হয়ে অন্যের ন্যায় বিচার নিয়ে ভাবা হাস্যকরও বটে!
আইনজীবীদের অনুপস্থিত বিচারবিভাগ মৃত সন্তানের ন্যায়। বিচারক ও আইনজীবী বিচার ব্যবস্থায় একে অপরের পরিপূরক। বিচারকদের জন্য রয়েছে সুরক্ষা আইন। বিচারিক সিদ্ধান্তের জন্য কোনো বিচারপতিকে দায়ী করা যায় না। অথচ বিচারিক ও সামাজিক কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আইনজীবীর হাতে পড়ছে হাতকড়া। সম্প্রতি জুরাইনে ট্রাফিক পুলিশের সাথে বিরোধে দুই আইনজীবীকে রিমান্ড, এর আগে মো. ইব্রাহীম খলিলকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে তুলে নিয়ে অজ্ঞাতস্থানে আটকে রেখে তাকে অমানবিক নির্যাতন, তারও আগে টিসিবি’র পণ্য বিক্রিতে অনিয়মের প্রতিবাদ করায় বরিশাল জজ কোর্টের আইনজীবী রবিউল ইসলাম রিপনকে সাজা দিয়েছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাজমূল হুদা। সাজা দেওয়ার সময় ওই ম্যাজিস্ট্রেটের দম্ভোক্তি ছিল ‘আমি আমার ক্ষমতা দেখালাম, পারলে আপনি আপনার ক্ষমতা দেখান’।
বাংলাদেশে বলবৎ ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৯৭ ধারায় জজ, ম্যাজিষ্ট্রেট তথা সরকারি চাকুরীজীবীদের দায়িত্ব পালনের সময় অপরাধ করলে মামলা করার জন্য সরকারের অনুমতি প্রয়োজন হয়। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, অভিযোগ পত্র দাখিলের আগে সরকারের বা নিয়োগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন সরকারি চাকরিজীবীকে গ্রেফতার করা যাবেনা।
আমরা সবাই জানি, আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা সংক্রান্ত টাকা লেনদেন বিষয়ে অভিযোগ থাকলে, সে বিষয়ে অভিযোগ করার জায়গা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। অভিযোগ গ্রহণ করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করে অসদাচরণ পেলে আইনজীবীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। আইনজীবী ব্যতীত বিচার বিভাগ ও ন্যায়বিচার যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি আইনজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের গুরু দায়িত্বও বটে। আইন করে বিচারের হাত থেকে দায়মুক্তির একটি অপসংস্কৃতি অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশে চলছে।
আইন পেশায় এসে আইনাঙ্গনের নানা জনের নানা বক্তব্য শুনেছি, পড়েছি, জেনেছি, উপলব্ধি করেছি। আরও জেনেছি বার ও বেঞ্চকে তুলনা করা হয় রথের সঙ্গে। রথ চলে দুই চাকায় ভর করে। যেকোনো একটি চাকা না চললে রথ চলতে পারে না। শুরুতেই বলে রাখি বার কাউন্সিলের অন্যতম প্রধান কাজ হলো আইনজীবীদের সুখ, দুঃখ, সুবিধা, অসুবিধা পেশাগত অসদাচরণ ও মান উন্নয়ন করা। কিন্তু দুঃখের সাথে জানাতে হয় আইনজীবীদের দুঃ-কষ্ট লাঘব ও পেশাগত মান উন্নয়নে বার কাউন্সিল গত ৫০ বছরে এমন কি করেছে, যা বুক, মুখ উচিয়ে কেউ বলতে পারেন? বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে বলছি,
১। বিচার বিভাগকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখুন, নতুবা এর খেসারত আমাদেরকেই দিতে হচ্ছে আরও দিতে হবে।
২। আইনজীবীদের সম্মান রক্ষা, আইনজীবীদের পেশাগত মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুন।
৩। আইনজীবী সমিতি এবং আদালতকে দূর্নীতিমুক্ত রাখতে ভূমিকা পালন করুন।
৪। মৃত্যুর পর আপনার টাকা বানরের পিঠা ভাগ হবে। অথচ জীবদ্দশায় বেনাভোলেন্ট ফান্ডের টাকা নিয়ে ভূমিকা পালন করুন
৫। অসুস্থ আইনজীবীকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন
৬। আইনজীবীদের সম্মান রক্ষা করুন।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, আইনজীবীর উপর আক্রমণ, অত্যাচার নির্যাতন বেড়েই চলছে। যেহেতু আদালতে বিচার প্রার্থী বিবাদমান পক্ষদের নিয়ে আইনজীবীদের কাজ করতে হয়, তাই সাধারণভাবে একটা ঝুঁকির বিষয় থেকেই যায়। ইদানিং দেখা যায়, মামলার প্রতিপক্ষ মামলায় হেরে গিয়ে উকিলের উপর প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে। এই প্রতিশোধের মাত্রা হুমকি, অপহরণ, এমনকি হত্যাকা- পর্যন্ত গড়ায়। উকিলের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে, উকিলের পরিবারের উপরও তাঁরা চড়াও হয়। আর এর মূল্য দিতে হয়, উকিলকে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো পাতা আছে কিনা যাহাতে লিখা “খুনিদের বিচার করা যাবে না”! সেটাও আমাদের দেশেই সম্ভব। কাজেই বিজ্ঞ আইনজীবী ভাইদের উদ্দেশ্যে বলছি, আগে নিজেদের নিরাপদ করুন, তারপর অন্যের ন্যায়বিচার নিয়ে ভাবুন। সময় এসেছে আওয়াজ তুলুন। নতুবা এর খেসারত আইনজীবী সমাজকে দিতেই হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইল: seraj.pramanik@gmail.com