রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় দুই শিশু সন্তানসহ স্ত্রীকে লোমহর্ষকভাবে হত্যার অভিযোগে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেডের (বিটিসিএল) সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন আদালত।
ঢাকা মহানগর ৭ম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক তেহসিন ইফতেখার মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেল পৌনে পাঁচটায় রায় ঘোষণা শেষ করেন। রায় পড়ার সময় বিচারকের চোখও হয় অশ্রুসজল।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও মামলার বাদি মুন্না রহমান উপস্থিত ছিলেন। আসামি রাকিব উদ্দিন কাঠগড়ায় ছিলেন। আদালতের বাম পাশে কাঠগড়ায় আসামি রাকিব উদ্দিন, সামনের বেঞ্চে আইনজীবী, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। পিনপতন নীরবতার মাধ্যমে বিচারক বিকেল ৪টা ২০মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন। রায় শেষ করেন ৫টা ৫০মিনিটে। রায়ে সাক্ষীদের বিবরণও পড়ার পর আসামির দোষ স্বীকারোক্তি পড়েন বিচারক।
আসামির ছেলে ফারহান উদ্দিনকে জুতার ফিতা দিয়ে গলায় পেঁচিয়ে হত্যার সময় ফারহান বলে ওঠে, ‘বাবা তুমি কী আমাকে মেরে ফেলবে’? এ বর্ণনা পড়ার সময় কেঁদে ফেলেন বিচারক। রায় পড়তে পড়তে বিচারকের চোখ দিয়েও পানি পড়তে থাকে। দীর্ঘ ৩০ মিনিট ধরে রায় ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে ঘটনার বিবরণ শুনতে থাকা আইনজীবী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অনেককে আবেগাপ্লুত হতে দেখা যায়।
‘আদালতে এই হত্যার বিবরণ দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আসামি রাকিব উদ্দিন। হত্যার বিবরণে বলা হয়, প্রথমে স্ত্রী মুন্নীর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এবং পরে গলা টিপে হত্যা করে। টিভি দেখার সময় রশি দিয়ে তিন বছরের মেয়ে লাইবার গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করে। বারো বছরের ছেলে ফারহান উদ্দিন বিপ্লব অন্যরুমে ঘুমাচ্ছিল। রাকিব জুতার ফিতা দিয়ে ছেলের গলা পেঁচানোর সময় ছেলে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। অনেক হাউমাউ করে কাঁদে। ছেলেটি বলে, ‘বাবা, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে?’ তারপর জোর করে ছেলেটির গলায় রশি পেঁচিয়ে ধরে। ক্রমেই ছেলেটি নিস্তেজ হয়ে যায়।
মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার সাথে সাথে আসামি রাকিব উদ্দিন কাঠগড়ায় সিজদা আদায় করেন। পরে আদালত থেকে বের হয়ে বলেন, ‘আমি রায়ে খুশি। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার স্ত্রী সন্তান যেখানে আমি সেখানে চলে যেতে চাই। আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব না। আমি চাই দ্রুত রায় কার্যকর হোক।’
রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় ছটফট করতে থাকে আসামি রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটন। রায়ের পর মামলার বাদি নিহত মুন্নির ভাই মুন্না রহমান বলেন, ‘আমার দুইবোনকে একই পরিবারে বিয়ে দিয়েছিলাম। ছোট বোন রাকিবকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। সংসারে সুখের অভাব ছিল না। কিন্তু রাকিব এক সময় মাদক ও জুয়া খেলায় জড়িত হয়ে যায়। যার পরিণতি পুরো পরিবার তছনছ হয়ে গেছে। দুটি ফুটফুটে সন্তানকে কীভাবে সে হত্যা করেছিল। আমি চাই আর কোনো পরিবার এভাবে যেন ধ্বংস না হয়।’
রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত পিপি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এটি একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা। জুয়ার ছোবলে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপক্ষ আসামির অপরাধ প্রমাণ করতে পারায় আদালত সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন। রায়ে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি।’
এর আগে গত নভেম্বরে এ চাঞ্চল্যকর মামলায় শুনানি শেষে আদালত রায়ের জন্য ২২ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন। ওইদিন বিশ্ব ইজতেমার কারণে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালতে আসামি হাজির করা সম্ভব হয়নি। তাই পুনরায় ৩১ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন আদালত।
সূত্র : এনটিভি