আদালতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, আইন-আদালতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন এবং বিচারকের সঙ্গে অপেশাদারিত্বমূলক ও আক্রমণাত্মক আচরণের অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট প্রশ্নে রেখে বলেছেন- আইন ব্যবসা আর চকবাজারের ব্যবসা কি এক? জবাবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি না সূচক জবাব দেন।
আজ বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ প্রশ্ন রাখেন। পরে আদালত এ বিষয়ে শুনানি ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করেন। ওইদিন এই তিন আইনজীবীকে ফের হাইকোর্টে হাজির হতে হবে।
আদালতে তিন আইনজীবীর পক্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির, বার কাউন্সিলের সদস্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
শুনানির শুরুতে হাইকোর্ট বলেন, ‘সভাপতি, সেক্রেটারি ও সাঈদ আহমেদ রাজা ব্রান্ড হয়ে গেছেন। জেলা বারে আদালত অবমাননা হলেই আপনারা আসবেন।’ এ সময় সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, ‘সরি।’ সুপ্রিম কোর্ট বারের সেক্রেটারি আব্দুন নূর দুলাল বলেন, ‘আমরা ডিসকারেজ করি।’
আদালত বলেন, ‘পিরোজপুর, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নীলফামারী – একের পর এক হচ্ছে। আপনারা তো চেম্বারে গিয়ে নো বলেন না’ মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, ‘নো বলেছি। আমার ফ্রেন্ডদের বলেছি, আমি যাব না। জুডিসিয়ারির সম্মান নষ্ট হলে আমাদের সম্মান নষ্ট হবে।’
হাইকোর্ট বলেন, ‘এসব তো বাইরে বলেন না। সবাই তো বারের সিনিয়র মেম্বার। এখানে পারসোনালি কিছু না। আইনজীবীরা কোর্টকে সহযোগিতা করেন। সিনিয়ররা না বুঝলে জুনিয়ররা কি শিখবে? বার কাউন্সিলে ট্রেনিং করান। চক বাজারের ব্যবসা আর আইন ব্যবসা এক?’ মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, ‘নো নো, এটা ব্যবসা না।’
আাদালত বলেন,‘আপনাদের মিটিং-এর কি হলো?’ বার কাউন্সিলের সদস্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘মিটিং-এ আমরা বার নেতাদের বক্তব্য শুনেছি। ওনারা ওনাদের বিভিন্ন বিষয়ে বলেছেন। তারপর আমাদের ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যান বলেছেন, কোনো সমস্যা হলে বার কাউন্সিলের একটি কমিটি আছে সেখানে জানাতে। আর বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধান বিচারপতি, আইনমন্ত্রীর কাছে যাবে। নিজস্ব বারে যেন রেজ্যুলেশন না নেওয়া হয়। আমাদের এখানে রায়ের মাধ্যমে উভয় পক্ষের (বার-বেঞ্চ) জন্য একটি গাইডলাইন আসলে ভালো হবে।’
সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘আমরাতো আগে এ রকম দেখিনি। আগে কিছু হলে হাইকোর্ট পর্যন্ত আসত না। ঘটনা হলে বারের সিনিয়র মেম্বার দুই মিনিটের মধ্যে হাতজোড় করে ফেলছে। তখন সব ঠান্ডা হয়ে যেত।’
এর আগে সকালে এসব অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে নীলফামারী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজুল হক, আইনজীবী মো. আজহারুল ইসলাম, আইনজীবী ফেরদৌস আলম হাইকোর্টে হাজির হন। তারা ওই ঘটনার জন্য হাইকোর্টে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
গত ২৫ জানুয়ারি আদালতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, আইন-আদালতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন এবং বিচারকের সঙ্গে অপেশাদারিত্বমূলক, আক্রমণাত্মক ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগে ব্যাখ্যা দিতে নীলফামারী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজুল হক, আইনজীবী মো. আজহারুল ইসলাম, আইনজীবী ফেরদৌস আলমকে তলব করেন হাইকোর্ট।
নীলফামারীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক (জেলা ও দায়রাজজ) গোলাম সারোয়ারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার (২৫ জানুয়ারি) বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
একই সঙ্গে আদালত অবমাননার দায়ে নীলফামারী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজুল হকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
গত ২৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর নীলফামারীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) গোলাম সারোয়ারের পাঠানো পত্রে বলা হয়, গত ২৮/১১/২০২২ খ্রি. তারিখে আদালতে আত্মসমর্পণকারী আসামি হাছিনা বেগমের আত্মসমর্পণপূর্বক জামিন শুনানি, আসামি আইনুল হকের জামিনের মেয়াদ বর্ধিতকরণ এবং হাজতি আসামি হাছানের জামিন শুনানির জন্য ছিল।
আমি পুলিশ রিপোর্ট, চিকিৎসা সনদ পর্যবেক্ষণ করে এবং আদালতে উপস্থিত ভিকটিম মোছা. মারুফা-কে পরীক্ষা অঙ্কে হাজতি আসামির জামিন নামঞ্জুর করি। এবং অপরাপর আসামিদের জামিন আবেদন এবং মেয়াদ বর্ধিতকরণ আবেদন না-মঞ্জুর পূর্বক জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান করি।
এই আদেশ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই অত্র মামলার নিয়োজিত আইনজীবী মমতাজুল হক, আইনজীবী মো. আজাহারুল ইসলাম, আইনজীবী ফেরদৌস আলমসহ তাদের অপরাপর সহযোগী আইনজীবীগণ অত্যন্ত মারমুখী হয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এজলাসের টেবিল চাপড়িয়ে বিকট শব্দে আমার প্রতি বিরূপ উক্তি উচ্চারণ পূর্বক হামলা করার প্রয়াস চালায়।
তারা হুমকি দিয়ে বলে, ‘জামিন দিয়ে নেমে যা, স্যরি বল, চাকরি করার দরকার নাই, বাড়ি গিয়ে বসে থাক, কোথা থেকে পড়াশোনা করেছো, আইন-কানুন জানো না, নীলফামারীর বার খুবই ভয়ঙ্কর, এর আগে অনেক বিচারককে পিটিয়ে এখান থেকে তাড়িয়েছি, কোথা থেকে এসেছো, এসেই উল্টা পাল্টা আদেশ দাও।’
এই পরিস্থিতিতে এজলাসের অবস্থা বেগতিক দেখে আমি তাদের সঙ্গে কোনোরূপ তর্কে না জড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এজলাসের কার্যক্রম মুলতবি রেখে আমার খাস কামরায় চলে যাই। খাস কামরায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করাকালীন সময়েও ওই আইনজীবীরা আমাকে জঘন্য ভাষায় বার সভাপতি আইনজীবী মমতাজুল হক, সহ-সভাপতি আইনজীবী মো. আজাহারুল ইসলাম এবং আইনজীবী ফেরদৌস আলম আমাকে গালিগালাজ করতে থাকে।
উক্ত সময়ে উপস্থিত অপরাপর আইনজীবীদের নিয়ে যে আচরণ করেছেন তাতে আমি বাংলাদেশ বিচার বিভাগের অধস্তন আদালতের সর্বোচ্চ পদে আসীন হিসাবে হতাশ, বাকরুদ্ধ, মর্মাহত, লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছি এবং উক্ত ঘটনার কারণে আমি সহ এই জেলার অপরাপর বিজ্ঞ বিচারকগণ নিরাপত্তাহীনতাসহ লাঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কাবোধ করছি। এমতবস্থায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহোদয়ের সদয় মর্জি হয়।
গত ২৯ ডিসেম্বর নীলফামারীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক (জেলা ও দায়রাজজ) গোলাম সারোয়ারের পাঠানো অভিযোগপত্রটি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপন করেন। গত ৩ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি অভিযোগপত্রটি বিচারের জন্য হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন। তার ধারাবাহিকতায় বিষয়টি আদেশের জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় উঠে।