কালাম অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কালাম সরকারি চাকুরীর সুবাদে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ১০ শতক জায়গা খরিদ করে দুই তলা ভবন নির্মাণ করে পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসতি শুরু করেন। কালাম ১০ শতক জায়গাটি খরিদ করেছেন তার বন্ধু জামালের নিকট হতে। জামাল তার মেয়ের বিয়ের জন্য ১০ শতক জায়গা কালামের নিকট বিক্রয় করেন। জামাল ১০ শতক জায়গা টি খরিদ করেছিল তার নিকটতম আত্মীয় রহিম হতে। রহিম অর্থ সংকটে পড়ে ১০ শতক জায়গাটি খরিদ করেছিলেন মোমিনের নিকট হতে। ১০ শতক জায়গা মোমিনের নামে মূল বি এস খতিয়ান (লেটেস্ট রেকর্ড) প্রস্তুত ও চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত ছিল। তদপরবর্তীতে রহিম পরে জামাল পরে কালামের নামে নামজারি খতিয়ান সৃজিত হয়।
কালাম চাকুরী জীবনে সৎভাবে আয় উপাজর্ন করে সব সম্বল দিয়ে ১০ শতক জায়গাটি খরিদ করেন এবং নিজ নামে নামজারি ক্রমে ২০২১ সন পর্যন্ত খাজনাদি পরিশোধ করেন। ২০২২ সনের কোন এক সময় কালাম খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে দেখেন ভূমি অফিস তার নিকট হতে খাজনা নিচ্ছে না কারণ তার নামীয় নামজারী খতিয়ান বাতিল করা হয়েছে। খোজ নিয়ে দেখে তার খরিদা ১০ শতক ভূমি সহ অপরাপর ভূমি নিয়ে একটি বন্টন মামলার রায় ডিক্রি প্রচারিত হয়েছে। কালাম বন্টন মামলার রায় ডিক্রির নকল কপি সংগ্রহ করে দেখেন তার খরিদা ১০ শতক ভূমি বাদীর নামে ছাহাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং বাদী উক্ত ১০ শতক ভূমির ছাহাম প্রাপ্ত হয়েছেন।
এটি আমাদের দেশের দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থার সাধারণ চিত্র। অনেক বন্টন মামলার আরজির তফসিলে লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান ও দাগ নম্বর অন্তর্ভক্ত করা হয় না কিংবা কেন অন্তর্ভক্ত করা হয় নাই তদ বিষয়ে আরজিতে বা মৌখিক সাক্ষ্যে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। এমন কি লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান ভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড হলেও তদ বিষয়ে আরজির গর্ভে ও তফসিলে তথ্য সরবরাহ করা হয় না। এতদ্ববিষয়ে একটি অপ্রত্যাশিত ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে যে, বন্টন মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান প্রয়োজন হয় না; এবং লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান ব্যতিত বন্টন মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করা যায়।
আমাদের দেশের স্থাবর সম্পত্তির ক্রম জরিপ (সি এস, আর এস/ এস এ ও বি এস জরিপ) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট স্থাবর সম্পত্তির সর্বপ্রথম জরিপ ছিল ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে (সি এস আর জরিপ)। বংগীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫ এর দশম অধ্যায়ের বিধান অনুসারে, স্থাবর সম্পত্তির এলাকায় ক্রম জড়িপ সংক্রান্তে প্রচলিত রেওয়াজ অনুসারে সি.আর. জড়িপ মূলে প্রস্তুতকৃত ও প্রচারিত খতিয়ান সি এস খতিয়ানকে স্বত্বলিপি (Records of Rights) এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, এবং এটিই হবে Title Chronology এর Foundation of Title; এবং Contrary Evidence দিয়ে যদি এই খতিয়ান Challenge করা না হয় কিংবা উপযুক্ত আদালত কর্তৃক এই খতিয়ান জরিপ মূলে সৃজিত খতিয়ান (সি আর খতিয়ান) বাতিল করা না হয়; সংশ্লিষ্ট সি আর খতিয়ান হবে মালিকানা নির্ধারণের মূল দলিল; এবং এটি আইন আদালত সহ সর্বত্র বলবৎ ও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। আবার স্থাপর সম্পত্তির এলাকায় রিভিশনাল জড়িপ (আর এস জড়িপ) এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশ জরিপ (বি এস জড়িপ) চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
সুতরাং ১৯৫০ সনের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫৫ সনের প্রজাস্বত্ব বিধিমালা, ১৯৫৭ সনের ট্যাকনিকেল রুলস এন্ড ইন্সট্রাকশনস অব দি সেটেলমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ও ১৯৯০ সনের ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুসারে বাংলাদেশ জরিপ পরিচালিত হয়ে চূড়ান্তভাবে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
অনেক বন্টন মোকদ্দমায় নালিশী সি আর ও আর এস/এস আর খতিয়ান উল্লেখে ছাহাম দাবি করলেও বাদী পক্ষকে নালিশী সি এস খতিয়ানের সামিল বি এস খতিয়ান বিষয়ে আরজিতে বা মৌখিক জবানবন্দিতে বক্তব্য দিতে দেখা যায় না কিংবা বাদীপক্ষকে তাদের আরজি বা জবানবন্দিতে বা যুক্তিতর্ক পর্বে নালিশা সি আর খতিয়ান ও দাগের সামিল নালিশী বি এস খতিয়ান ও দাগ কত কিংবা বাদীপক্ষ নালিশী সি আর খতিয়ানের সামিল কোন কোন বি এস খতিয়ান ও দাগ হতে ছাহাম দাবি করেছেন এতদ্ববিষয়ে সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে দেখা যায় না। এমনকি বাদীপক্ষকে তাদের আরজি বা জবানবন্দিতে তাদের নামে বি এস খতিয়ান হয় নাই এই মর্মে ল্যান্ড সার্ভে ট্র্যাইব্যুনাল কিংবা কোন আইনি আদালতে আইনি পদপেক্ষ নিয়েছেন বা স্বত্ব ঘোষণা মামলা করেছেন এমন কোন সাক্ষ্য প্রমাণও উপস্থাপন করতে দেখা যায় না।
এখন দেখা যাক বন্টনের মামলায় নালিশী সি আর খতিয়ানের সামিল বি এস জরিপের অধীনে চূড়ান্তভাবে লিপিকৃত ও প্রচারিত বি এস খতিয়ান সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন না করলে বন্টনের মোকদ্দমার আইনি অবস্থান ও ফলাফল কি হতে পারে এবং উ্ক্তক্ষেত্রে বাদীপক্ষ ছাহাম পেতে পারে কিনা।
আমরা জানি যে, ১৯৫০ সনের প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫৫ সনের প্রজাস্বত্ব বিধিমালা, ১৯৫৭ সনের ট্যাকনিকেল রুলস এন্ড ইন্সট্রাকশনস অব দি সেটেলমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ও ১৯৯০ সনের ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুসারে বাংলাদেশ জরিপ পরিচালিত হয়ে চূড়ান্তভাবে বি এস খতিয়ান লিপি, প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৫০ সনের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন এর ১৭ ও ১৪৪ ধারা মোতাবেক সরকারকে স্বত্বলিপি সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং উক্ত ক্ষমতা বলে সরকার নালিশী এলাকা সহ দেশের অন্যান্য এলাকায় গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভূমির স্বত্বের রেকর্ড সংশোধন কার্যক্রম গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন।
এই আইনের বিধান মতে জরিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে রেকর্ড প্রণয়নের অন্তর্ভূক্ত রয়েছে দু’টি কাজ-
প্রথমত: জমির অবস্থান, আয়তন ও শ্রেণী পরিবর্তন হেতু নকশা সংশোধন করে মৌজাভিত্তিক নকসা প্রণয়ন করা এবং
দ্বিতীয়ত: জমির মালিকানা, পরিমাণ ও শ্রেণী সম্বলিত খতিয়ান প্রণয়ন করা।
১৯৫৫ সনের প্রজাস্বত্ব বিধিমালা এর ২৭ বিধি মোতাবেক এবং ১৯৫৭ সনের ট্যাকনিকেল রুলস এন্ড ইন্সট্রাকশনস অব দি সেটেলমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এর বিধান মোতাবেক জরিপ কার্যক্রম ও রেকর্প প্রণয়নে মোট দশটি স্তর অনুসরণ করতে হয় এবং প্রতিটি স্তরের জন্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে সতর্কতার সাথে জরিপ সম্পন্ন করতে হয়।
দশটি স্তর হচ্ছে: ট্রভাস সার্ভে, ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে, মৌজা সীমানা চিহ্ন নির্মাণ, খানাপুরী, বুঝারত, তসদিক, যাচ, খসড়া খতিয়ান প্রকাশনা, আপত্তি দাখিল ও নিষ্পত্তি, আপীল দায়ের ও নিষ্পত্তি, চূড়ান্ত যাচ ও খতিয়ান চূড়ান্তকরণ ও প্রকাশনা।
এভাবে সকল স্তর অনুসরণ করে প্রজাস্বত্ব বিধিমালার ৩৪ বিধি মোতাবেক ৬০ দিন অতিক্রান্তের পর সেটেলমেন্ট অফিসার ৩৩ বিধি অনুসারে প্রকাশিত খতিয়ান চূড়ান্ত প্রকাশিত হয়েছে মর্মে প্রত্যায়ন করবেন এবং নকশা ও খতিয়ান পূর্ণাঙ্গ নকশা ও খতিয়ানের মর্যাদা লাভ করে। ১৯৫০ সনের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন এর ১৪৪ এ ধারা মোতাবেক উক্ত চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত খতিয়ানের বিষয়ে ”Presumption as to correctness of record of rights” বিধান আছে।
অন্যদিকে ১৮৭২ সনের সাক্ষ্য আইনের ৭৬ ও ৭৯ ধারার বিধান মতে চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত বি এস খতিয়ানের সহিমুহুরী কপি সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহারক্রমে এর Genuineness বিষয়ে অনুমান গ্রহণ করার বিধান আছে। ১৯৫০ সনের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন এর ১৪৪ এ ধারা ও ১৮৭২ সনের সাক্ষ্য আইনের ৭৬ ও ৭৯ ধারার বিধানাবলী বি এস জরিপ কার্যক্রম ও রেকর্ড প্রণয়ন এবং চূড়ান্তভাবে প্রচারিত ও প্রকাশিত বি এস খতিয়ানের সাক্ষ্যগত মূল্যকে ইংগিত করে। বিচারিক কার্যক্রমে যে দালিলিক কার্যক্রম ও সাক্ষ্যের সাক্ষ্যগত মূল্য আছে বিচার নিষ্পত্তিতে সেই দালিলিক কার্যক্রম ও সাক্ষ্যগত মূল্য কে এড়িয়ে চলা যাবে না কিংবা নিরব থাকা যাবে না।
সুতরাং ক্রম জরিপ পর্যায়ে বি এস জরিপের কার্যক্রম ও রেকর্ড প্রণয়ন এবং চূড়ান্তভাবে প্রচারিত ও প্রকাশিত বি এস খতিয়ান একটি লেটেস্ট কার্যক্রম ও রেকর্ড প্রণয়ন এবং চূড়ান্তভাবে প্রচারিত ও প্রকাশিত বি এস খতিয়ান সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ৫ ধারা মোতাবেক একটি লেটেস্ট খতিয়ান যা বন্টনের মামলা নিষ্পত্তিতে প্রাসঙ্গিক ঘটনা।
অন্যদিকে ক্রম জরিপের লেটেস্ট কার্যক্রম ও রেকর্ড প্রণয়ন এবং লেটেস্ট খতিয়ান ব্যতিত দেওয়ানী বিরোধ নিষ্পত্তি করা হবে একটি অদ্ভূত কল্পনাপ্রসূত গল্পের মধ্যে বিচারিক সিদ্ধান্ত ছুড়ে মারার সামিল। এতে মামলার সঠিক Form and Character, Forum নির্ধারণে ব্যাঘাত ঘটবে, যেমন; লেটেস্ট খতিয়ান বাদীর নামে না থাকলে স্বত্ব ঘোষণা সহ বন্টন চায়তে হবে, বাদী যদি দখলে না থাকে খাস দখল পুন:রুদ্ধার সহ বন্টন চায়তে হবে, Multiplicity of Suits এর কারণ হবে, বৈধ আগন্তুুক কে হটিয়ে অবৈধ মালিকানাবিহীন বাদীকে অবৈধ দখলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার সামিল হবে কিংবা বাদী যদি ইতমধ্যে নালিশী ভূমি আংশিক বা সম্পূর্ণ অংশ হস্তান্তর করে থাকে তাহলে মালিকানাবিহীন ও দখলবিহীন বাদীকে আইনি আদালতের রায় ডিক্রি মূলে বৈধভাবে হস্তান্তরিত ভূমি অবৈধপ্রকিয়ায় রাষ্ট্রীয়যন্ত্র ব্যবহার জরে জোরপূর্বক ফিরিয়ে দেওয়ার সামিল হবে, পক্ষভূক্ত নয় এমন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের বক্তব্য না শুনে বা তাদের আইনি অবস্থান নিষ্পত্তি না করে কিংবা তাদের সাক্ষ্য প্রমাণ যাচাই না করে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভ্রমাত্মক আদেশ প্রচারের সামিল হবে।
১৮৮৫ সনের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন এর দশম অধ্যায়ের বিধান ও ১৯৫০ সনের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন এর ১৪৪ ধারার বিধানাবলী যেহেতু সি আর খতিয়ান কে স্বত্বলিপির মর্যাদা দিয়েছে এবং নালিশী ভূমির Foundation of Title হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এবং যেহেতু বন্টনের মামলায় পক্ষদ্বয়ের মালিকানা স্বত্ব প্রমাণ করতে হয়, সেহেতু বাদীপক্ষের উচিত ছিল যথাযথভাবে ক্রম জরিপ উল্লেখে নালিশী ভূমি সি আর খতিয়ান ও দাগ নম্বর এর সামিল লেটেস্ট রেকর্ড তথা বি এস খতিয়ান ও দাগ উল্লেখে ছাহাম প্রার্থণা করা এবং বাদীপক্ষ বা তার পূর্বসূরীর নামে লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান রেকর্ড না হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট বি এস খতিয়ান উল্লেখে কার নামে রেকর্ড হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা এবং বর্ণিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের কে বন্টন মোকদ্দমায় পক্ষ করা।
অনেক সময় একটি বন্টন মোকদ্দমা নিষ্টপত্তির প্রাক্কালে ছাহামপ্রার্থী বিবাদীপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী কে যুক্ততর্ক পর্যায়ে নিবেদন করতে দেখা যায় যে, বাদীপক্ষের উচিত ছিল নালিশী বি এস খতিয়ান ও দাগ নম্বর উল্লেখ করা, এবং বিবাদীপক্ষের মোকদ্দমা খারিজ হলে ছাহাম প্রার্থী বিবাদীগণের আইনি অবস্থান খর্ব হবে না মর্মে উল্লেখ করে থাকেন।
এমতাবস্থায় বিচারিক মনে প্রশ্ন আসতে পারে লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান তো দখলের সাক্ষ্য বহন করে এটি মালিকানা নির্ধারণের মাপকাঠি হতে পারে কিনা। এটি আইনগতভাবে সঠিক যে, বি এস খতিয়ান শুধুমাত্র দখলের সাক্ষ্য বহন করে এটি মালিকানা নির্ধারণের জন্য উপযুক্ত সাক্ষ্য হতে পারে না। বর্ণিত বিশ্লেষণ বন্টনের মোকদ্দমার আলোকে গড়া; এবং প্রচলিত ১৯৫০ সনের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫৫ সনের প্রজাস্বত্ব বিধিমালা, ১৯৫৭ সনের ট্যাকনিকেল রুলস এন্ড ইন্সট্রাকশনস অব দি সেটেলমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ও ১৯৯০ সনের ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুসারে বাংলাদেশ জরিপ কার্যক্রম ও রেকর্ড প্রণয়ন পরিচালিত হয়ে চূড়ান্তভাবে বি এস খতিয়ান লিপি, প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
বর্ণিত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান ব্যতিত বন্টনের মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করতে গেলে রায় বাস্তবায়নে আইনি জটিলতা সৃজিত হওয়ার পাশাপাশি নালিশী ভূমিতে বাদীপক্ষের দখল প্রমাণে ব্যাঘাত ঘটবে।
আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতি যে, স্থাবর সম্পত্তিতে স্বত্ব ও দখল পরিপূরক; দখলবিহীন মালিকানার সাক্ষ্যগত মূল্য নেই। এমতাবস্থায় বন্টনের মোকদ্দমায় নালিশী ভূমিতে বাদীর স্বত্ব ও দখল প্রমাণের জন্য বাদীকে অবশ্যই লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান বিষয়ে তার আইনি অবস্থান সুনির্দিষ্ট করতে হবে এবং মোকদ্দমার আরজির তফসিলে বি এস খতিয়ান সন্নিবেশ করত: ছাহাম চায়তে হবে; লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান যদি তার বা তার পূর্বসূরীর নামে রের্কর্ড হয়ে ভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়ে থাকে তাহলে ভিন্ন ব্যক্তিকে মোকদ্দমায় পক্ষ করত: বন্টন মোকদ্দমায় স্বত্ত্ব ঘোষণা চায় তে হবে।
আর সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এ ১০১ ধারার বিধান মোতাবেক এ দায় দায়িত্ব বাদীপক্ষের উপর অর্পিত। সুতরাং বর্ণিত বিশ্লেষণের আলোকে বিচারিক আদালত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন যে, যেহেতু বাদী পক্ষ বি এস খতিয়ানের উপর ছাহাম দাবি করেন নাই কিংবা বি এস খতিয়ান বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই সেহেতু বাদীর প্রার্থণা ত্রুটিপূর্ণ মর্মে প্রতীয়মান হবে।
এমতাবস্থায় পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে বাদীপক্ষ তাদের পূর্ববর্তীর নামে নালিশী এলাকায় বি এস খতিয়ান চূড়ান্তভাবে প্রচার ও প্রকাশিত হওয়ার সময় পর্যন্ত তাদের স্বত্ব মালিকানা দখল প্রমাণ করতে পারে নাই মর্মে বিচারিক আদালত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এমতাবস্থায় বর্ণিত বিশ্লেষণের আলোকে বিচারিক আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, বাদী নালিশা ভূমিতে তার স্বত্ব স্বার্থ দখল প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অনেক সময় বিভিন্ন বন্টন মোকদ্দমার বিচার নিষ্পত্তির প্রাক্কালে এর আরজি, জবাব/ছাহাম দরখাস্ত, দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্য পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বাদীপক্ষ আরজিতে শুধুমাত্র সি এস ও আর এস খতিয়ান ও দাগ উল্লেখে বন্টন সূত্রে ছাহাম দাবি করলেও সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকারী/ছাহামপ্রার্থী বিবাদীপক্ষ তৎসামিল বি এস খতিয়ান দাখিল করেন। দাখিলীয় বি এস খতিয়ানাদির অস্তিত্ব এবং সি এস খতিয়ানের সাথে এর সামিলতাকে অস্বীকার করে বাদীপক্ষকে প্রতিদ্বন্দ্বীকারী ছাহামপ্রার্থী বিবাদীর সাক্ষীকে জেরা করতে দেখা যায় না এমনকি বৈসাদৃশ্য সাক্ষ্য উপস্থাপন করে উক্তরূপ খতিয়ানের অস্তিত্ব ও এর সামিলতাকে অস্বীকার করতে দেখা যায় না।
তাছাড়া এই ধরণের মোকদ্দমার যুক্তিতর্ক পর্যায়ে বাদীপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী কে উক্ত খতিয়ানাদির অস্তিত্ব সামিলতা বিষয়ে ইতিবাচক বক্তব্য দিতে দেখা যায়।
এমতাবস্থায় এস্টেট একুইজিশন এন্ড টিনান্সি এ্যাক্ট, ১৯৫০ এর ১৪৪এ ধারার বিধান মতে উভয় খতিয়ান বিষয়ে Presumption as to Correctness of right of records এ উপনীত এবং সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ৭৬ ও ৭৯ ধারা মোতাবেক দাখিলীয় বি এস খতিয়ান এর সহিমুহুরী এর Genuineness বিষয়ে অত্র আদালত অনুমান করে নেওয়া যায় এবং বিচারিক আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন যে, পক্ষদ্বয়ের উক্তরূপ স্বীকৃতি ও একই আইনের ৫ ও ২২ ধারা মোতাবেক প্রতিদ্বন্দিকারী ছাহাম প্রার্থণাকারী বিবাদীপক্ষের ক্রম জড়িপ /রেকর্ড ও এর সামিলতা সংক্রান্তে বর্ণিত ঘটনা প্রাসঙ্গিক ও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় হবে।
বর্ণিত বিশ্লেষণ আমার নিজস্ব চিন্তা ধারা থেকে অদ্ভূত। এই বিশ্লেষণের সমর্থনে মাননীয় উচ্চাদালতের নজির আছে কিনা জানি। এই বিশ্লেষণের আলোক আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান ব্যতিত বন্টন মোকদ্দমা সরাসরি খারিজ হবে।
সুতরাং বর্ণিত বিশ্লেষণের আলোকে দেখা যায় কালাম একটি ঝুকিপূর্ণ রায় ডিক্রি প্রাপ্ত হয়েছেন এবং এই রায় ডিক্রি কপি তার সৎ কর্ম জীবনে অর্জিত সবে ধন নীল মণির অস্তিত্ব কে হুমকির মুখে ফেলেছে। বন্টনের মূল মোকদ্দমায় লেটেস্ট রেকর্ড বা বি এস খতিয়ান বিষয়ে দাবি বা আরজির গর্ভে বা তফসিলে বি এস খতিয়ান বিষয়ে তথ্য বা সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকার কারণে কালামের আইনি অবস্থান বিজ্ঞ আদালতের রায় ডিক্রি তে প্রতিফলিত হয় নাই।
মাননীয় বিচারিক আদালতের এই রায় তার সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার কে ক্ষুন্ন করেছে এবং তার শান্তিপূর্ণ ধারাবিহিক মালিকানা ও দখল কে হস্তক্ষেপ করেছে। যদিও তার আপীল করার সুযোগ রয়েছে; কিন্তু আইন আদালতের একটি রায় কেন তার সৎ জীবন যাপনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে?
লেখক : রাজিব কুমার দেব; সিনিয়র সহকারী জজ, কুমিল্লা।