মিথ্যা-মানহানিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগে ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের করা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে লিখিত জবাব দাখিলের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
ঢাকার তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ মো. আমিনুল ইসলামের আদালত এ আদেশ দিয়েছেন বলে আজ বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) সংশ্লিষ্ট আদালতের সেরেস্তাদার মতিউর রহমান জানিয়েছেন।
মতিউর রহমান জানান, মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী কোর্ট ফি দাখিল করেন। এরপর আদালত আগামী ২৩ মার্চ হাজির হতে বিবাদী পক্ষের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মানহানির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫০০ কোটি টাকা দাবি করে ব্যারিস্টার সুমনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন আবদুস সোবহান গোলাপ।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ১৭ জানুয়ারি সায়েদুল হক ফেসবুকে তার সম্পর্কে মিথ্যা, মানহানিকর তথ্য প্রচার করেন। সায়েদুল হক প্রচার করেন যে আবদুস সোবহান গোলাপ ২০১৪-২০১৫ সালে সংসদ সদস্য হয়ে অর্থপাচার (মানি লন্ডারিং) করেছেন। সায়েদুল হকের এই বক্তব্য সত্য নয়।
গোলাপ সংসদ সদস্য হয়েছেন ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। সংসদ সদস্য হওয়ার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো বাড়ি কেনেননি। আবদুস সোবহান ১৯৮৫ সালে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ বেতনে চাকরি করেন। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি মার্কিন পাসপোর্ট সমর্পণ (সারেন্ডার) করেন। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার কোনো আর্থিক লেনদেন নেই।
সংসদ সদস্য হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কেনার তথ্য বিবাদীর মনগড়া বক্তব্য। বিবাদী আগেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানহানিকর তথ্য প্রচার করেছেন বলেও মামলার অভিযোগে বলা হয়।
সংসদ সদস্য গোলাপ জানিয়েছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) গিয়ে, বিভিন্ন মিডিয়ায় তার নামে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছেন ব্যারিস্টার সুমন। এসব মিথ্যাচারের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে এক সপ্তাহ আগে তাকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি নোটিশের বিষয়ে কোনো জবাব দেননি।
আওয়ামী লীগের এ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক বলেন, ভিডিওর মাধ্যমে আমাকে নিয়ে দেশে-বিদেশে ও দুদকে মিথ্যা অপপ্রচার করেছেন সুমন। এতে সামাজিকভাবে আমার মানহানি হয়েছে। সে কারণে ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি।
দুদকে ব্যারিস্টার সুমনের লিখিত অভিযোগ
গত ২৬ জানুয়ারি দুদকে একটি লিখিত অভিযোগ দেন ব্যারিস্টার সুমন। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, আবদুস সোবহান গোলাপ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বা অন্য কোনো দেশে একাধিক বাড়ি কেনার বিষয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন। এ জন্য তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে সুমন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সংসদ সদস্য গোলাপ শপথ নেওয়ার সাত মাস পর আমেরিকার নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। অথচ আমাদের সংবিধানে আছে, কারও যদি বিদেশি নাগরিকত্ব থাকে তাহলে কোনোভাবেই তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে পারবেন না।
ব্যারিস্টার সুমন বলেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট বলেছে, বিষয়টি দুদক দেখবে। আমি এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম দুদক এরকম একটি ক্রিস্টাল ক্লিয়ার বিষয়ে কোনো সরাসরি সুয়েমোটো গ্রহণ করে কিনা। যেহেতু এখন পর্যন্ত দুদক গ্রহণ করেনি, তাই আমি দুদক বরাবর অভিযোগ করেছি।
অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে ৯টি বাড়ি কেনার বিষয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এ রিট দায়ের করেন।
রিটে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, এনবিআরের চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে।
রিটে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার বাড়ি কেনার বিষয়ে প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়।
তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপি তাদের ওয়েবসাইটে করা একটি প্রতিবেদন প্রকাশি করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন। বিষয়টি নির্বাচনী হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেননি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন। ওই বছর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি সুউচ্চ ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তিনি। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে মোট ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি (ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ কোটি টাকা)।
ওই রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে এ বিষয়ে নুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত সোমবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
উল্লেখ্য, মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সস্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান। তিনি দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকও ছিলেন।