রাজধানীর পল্লবীর শহীদ জিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী চাঞ্চল্যকর আঁখি ধর্ষণ ও খুনের মামলায় আসামী তরিকুল ইসলাম রায়হানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে আসামিকে ২ লাখ টাকা অর্থদন্ড দেওয়া হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (৯মার্চ) ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল- ৫ এর বিচারক শামসুন নাহার এ আদেশ দেন।
পাশাপাশি আসামিকে আলামত গোপন করার দায়ে ৫ বছরে কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া মৃত আখির মূল্যবান জিনিসপত্র আত্মসাৎ করার দায়ে আরো একবছরের কারাদন্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
রায় ঘোষণার আসামি রায়হান আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় শেষে সাজা পরোয়ানা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
রায় ঘোষণার সময় বিচারক শামসুন নাহার বলেন, আসামি তার আপন ফুফাতো বোনকে জোর পূর্বক ধর্ষণ করে দুই হাত দিয়ে গলা টিপে হত্যা করে। এ অপরাধে যতক্ষণ পর্যন্ত আসামির মৃত্যু নিশ্চিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন পাবলিক প্রসিকিউটার আলী আসগর স্বপন। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট মো: রিয়াজ মোর্শেদ নাঈম ও অ্যাডভোকেট শরীফুল হক প্রিনন। আর আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো: দেলোয়ার হোসেন।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার আন্ডারচর গ্রামের বাসিন্দা আঁখি আক্তারের বাবা মোঃ আরিফ হোসেন ও মা হাসনা হেনা দুজনেই মরিশাসের গার্মেন্টসের কারখানায় কাজ করতেন। আর আঁখি ছিলেন পল্লবীর শহীদ জিয়া ডিগ্রি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাবা-মা বিদেশে থাকায় ঢাকায় মামার বাড়িতে থাকতেন আঁখি। স্ত্রী–সন্তানসহ মামাতো ভাই তরিকুল ইসলাম রায়হান একই বাসায় থাকতেন।
২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে বাসায় কেউ না থাকার সুযোগে মামাতো ভাই তরিকুল ইসলাম রায়হান আঁখিকে জোর করে ধর্ষণ করে। আঁখি ক্ষিপ্ত হয়ে এই ঘটনার কথা সে সবাইকে বলে দিবে বললে তরিকুল ইসলাম রায়হান গলাটিপে শ্বাসরোধ করে আঁখিকে হত্যা করে।
ঘটনার দিন সকালে রায়হানের স্ত্রী, সন্তান,মা-বাবাসহ পরিবারের অন্যরা বাসার বাইরে ছিলেন। রায়হান বাসার ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিল। আঁখি ছিল নিজ রুমে। একপর্যায়ে আঁখির রুমে গিয়ে তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয় রায়হান। এতে আঁখি চরমভাবে ক্ষিপ্ত হলে জোরপূর্বক আঁখিকে ধর্ষণ করে।
আঁখি তখন ধর্ষণের কথা পরিবারের সবাইকে বলে দেওয়ার হুমকি দিলে গলাটিপে হত্যা করে তাকে। গলা থেকে সোনার চেইন ও কানের দুল খুলে নেন। আঁখির ফোনও বন্ধ করে পকেটে রাখে। এরপর লাশ গুম করার চেষ্টায় পাতলা কাঁথা দিয়ে লাশ মুড়িয়ে ফেলেন।
এরপর মিরপুর ১১ নম্বর সোসাইটি মার্কেটে গিয়ে একটি কালো ব্যাগ ও তালা কেনেন। আঁখিকে কাঁথা দিয়ে জড়িয়ে ব্যাগে ভরেন। সেটা একটি সিএনজিতে করে নিয়ে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে চলে যান। কিন্তু নামার সময় দেখা যায়, ব্যাগের চেইন ছিঁড়ে গেছে। ধরা পড়ার ভয়ে ফুটপাতের এক ফলের দোকানিকে ব্যাগটা দেখে রাখার কথা বলে সটকে পড়েন।
তদন্তে বেরিয়ে আসে রহস্য
আখিঁর মোবাইল ফোনটা সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর পকেটে রাখেন। কিন্তু বন্ধ ফোনটা চালু করতেই ফোন আসতে শুরু করে। এরপর ফোনটা বন্ধ করে বিক্রি করে দেন। তারপর আসামী তরিকুল তার বাবার সঙ্গে মিলে নিজেই আখিঁর দাফন–কাফন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
এত কিছুর মধ্যেও পরিবারের কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পাঁচ দিন স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে খুনি তরিকুল ইসলাম রায়হান। লাশ উদ্ধারের পর খুনীও সবার সঙ্গে কান্নাকাটি করেছে। কারোরই সন্দেহ হয়নি খুনী রায়হানকে।
মেয়ে হত্যার খবর পেয়ে বিদেশ (মরিশাস) থেকে আঁখির বাবা বেলায়েত হোসেন আরিফ দেশে ফিরে আসেন। তারও সন্দেহ হয়নি রায়হানকে। আঁখির বাবার সঙ্গে কবর জিয়ারত করতে মাদারীপুরের কালকিনির গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছিলো খুনী তরিকুল ইসলাম রায়হান।
লাশভর্তি ব্যাগ ফেলে যাওয়ার পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের এলাকা থেকে কালো ব্যাগ থেকে আঁখির লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। পরে রায়হানের মা-বাবা ও খুনী তরিকুলের স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের থানায় ডেকে নেয় রেলওয়ে থানা পুলিশ।
আলামত হিসেবে সংগ্রহ করা আঁখির লাশের সঙ্গে থাকা একটি কাঁথা রায়হানের মা-বাবা ও খুনী রায়হানের স্ত্রীকেও দেখানো হয়। তারা পুলিশকে জানান, এটি আঁখির কাঁথা। ওই কাঁথা গায়ে দিয়ে আঁখি ঘুমাত।
এরপরই পুলিশ অনেকটা নিশ্চিত হয় যে তরিকুল ইসলাম রায়হানই প্রকৃত খুনি। তদন্তে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তরিকুলের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ। আখির কবরের সামনে থেকে পুলিশ খুনি রায়হানকে গ্রেফতার করে।
পরে খুনী তরিকুল নিজেই অপরাধের দায় স্বীকার করে আদালতে দেয়া তরিকুলের স্বীকারোক্তি জবানবন্দিতেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে তরিকুল।
ছেলেকে বাঁচাতে বাবার কৌশল
মামলার ঘটনাটি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে আসামীর পিতা নুরুল ইসলাম একটি বানোয়াট ও মিথ্যা ঘটনায় নিজেই তার পুত্রকে বাঁচানোর জন্য একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।
রেলওয়ে থানার সাব ইন্সপেক্টর মো: আনিছুর রহমান ও রকিবুল হক মামলাটি তদন্ত করে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে নজরুল ইসলামের এজাহারকে ভুয়া উল্লেখ করে তার পুত্র খুনি তরিকুল ইসলাম রায়হানকে আসামী করে ৩৪ জনকে সাক্ষী করে ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটার আলী আসগর স্বপন ২৪ জন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করে আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন।