আবদুল্লাহ আল আশিক : একজন বিজ্ঞ আইনজীবী একদিন আক্ষেপ করে বললেন, ‘নিম্ন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট তার চাকরির দায়িত্ব পালন করতে আদালতে আসেন। তারা এখনো নিজেদের ঠিকঠাক বিচারক হিসেবে মেনে নিতে পারেন নাই।’
কথাটি বেশিরভাগ অর্থেই সত্য। তবে সকল ম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অনেক মেট্রোপলিটন বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আছেন যারা বিচার প্রক্রিয়া তার নিজ দায়িত্ব, কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা হিসেবে মেনে নেন। বিচার কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে তিনি ধৈর্য্য, প্রজ্ঞা ও ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় দেন।
ঘটনার সত্যতা, আইনের প্রয়োগ, প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তা করেন। পড়াশোনা করেন। যে সমস্ত বিষয় বুঝতে সমস্যা হয় সেসকল বিষয় নিয়ে সিনিয়রদের সাথে আলোচনা করেন। রাষ্ট্র, জাতি, সমাজ ও ধর্মের প্রতি তার দায়বদ্ধতা নিয়ে চিন্তা করেন।
শুধুমাত্র সরকারি চাকরি করি এই ভেবে একজন বিচারক যখন আদালত প্রাঙ্গণে আসেন তখনই মনে করতে হবে আরো একটি দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। যেখানে হয়তো একজন ভিকটিম ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন অথবা একজন নিরপরাধ ব্যক্তি অহেতুক দণ্ড প্রাপ্ত হবেন।
আমি নিজেও এমন কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। গত সপ্তাহে আমি একটি মামলায় দুইজন সাক্ষীকে জেরা করতে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে যাই। জেরা করার মতো যথেষ্ট প্রিপারেশন আমি নিয়েছি। আসামীর পক্ষে ডিফেন্স নেয়ার মতো যথেষ্ট ইনগ্রিডিয়েন্টস (উপাদান) আমার কাছে আছে। আমি জেরা শুরু করি। এক পর্যায়ে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘লার্নেড শেষ করেন, হইছে তো’।
তার কথার যথার্থ গুরুত্ব না দিয়ে আমি আমার জেরা চালিয়ে যাই। তিনি লিখতে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং সাক্ষীকে করা আমার একটি প্রশ্নের মধ্যে তিনি আবার বলে উঠেন, ‘এই প্রশ্নের কি কোনো প্রয়োজন আছে লার্নেড? আপনি কি এখনই আর্গুমেন্ট করে ফেলবেন?’ আমি প্রতিত্তরে বলি, ‘অবশ্যই আছে ইয়োর অনার, আমার ডিফেন্স আছে বলেই আমি প্রশ্ন গুলো করছি’।
সাক্ষীকে জেরা করার মাত্র দশ মিনিটের মাথায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিচারক অধৈর্য্য হয়ে পড়লেন দেখে আমার অত্যন্ত আফসোস হলো। অথচ আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো অতিঃ মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি গোল্ডের মামলায় চারজন সাক্ষীকে জেরা করার। যদিও আমি এখনো এত বড় গুরু দায়িত্ব নেয়ার মতো আইনজীবী হয়ে উঠিনি। আর আমি আমার প্র্যাকটিস জীবনের এই ক্ষুদ্র সময়ে কখনোই বলবো না আমি জেরা করতে পারদর্শী।
শুধুমাত্র কাকতালীয় ভাবে আমি গোল্ডের মামলাটি জেরা করতে সুযোগ পেয়েছিলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে ঐদিন আমি পুরো দেড় ঘন্টা জেরা করি। জেরা শেষে মামলার আসামী খুশি হয়ে আমাকে দুই হাজার টাকা পারিশ্রমিক দিয়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত আনন্দের বিষয় ছিলো এটা যে, একবারের জন্যেও অতিঃ দায়রা জজ সাহেব অধৈর্য্য হয়ে উঠেন নি। আর এখানেই একজন সত্যিকারের বিচারকের সার্থকতা।
ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আমি এমন আরো একটি ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম। একটি ওয়াইফ কিলিং (স্ত্রী হত্যা) মামলায় দুইজন সাক্ষীকে জেরা করতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিলেন। তিনি এমন একটি মনোভাব প্রকাশ করতে ছিলেন যেনো মামলার জেরা করার কোনো প্রয়োজন নাই। আসামী এজাহারে বর্ণিত কথিত অপরাধটি করেছেন এবং তিনি অপরাধী।
তবে আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখেছি তিনি চেষ্টা করেন তার জ্ঞান ও ধৈর্য্য কাজে লাগাতে। একটি যৌতুকের মামলা তিনি যেভাবে সমাধান করেছিলেন তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তিনি দীর্ঘদিন কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে প্র্যাকটিস করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার বিচারিক ক্ষমতা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার স্পৃহা দেখে আমি গর্বিত হয়েছিলাম। আর এমন ম্যাজিস্ট্রেট হয়তো অসংখ্য রয়েছে যারা শুধুমাত্র সরকারি দায়িত্ব পালন করতে আদালতে আসেন না, বরং ন্যাচারাল জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করতে আদালতে আসেন।
হয়তো আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ উপরে উল্লেখিত এমন অসংখ্য ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। নিরবে নিভৃতে নাইটমেয়ার (দুঃস্বপ্ন) হিসেবে ভুলে গিয়েছেন। সাবেক বিচারপতি হামিদুর হক তাঁর ‘বিচার বিভাগ এর ৪৫ বছর’ নামক বইয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। যেখানে একজন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট বারের একজন সিনিয়র আইনজীবীকে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা কালে বলেছিলেন, ‘আমি যদি বিষয়টি না বুঝতাম তাহলে আমি আপনার ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম, আর আপনি আমার এইখানে বসে থাকতেন’।
অল্পতেই একজন বিচারক অধৈর্য্য হয়ে উঠলে ও নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে ন্যায় বিচার প্রার্থীরা আরো একটি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হবে।
লেখক : আবদুল্লাহ আল আশিক; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।