ব্যারিস্টার রিয়াদ আহমেদ তুষার : কোনো বিষয়ে লেখা বড়ই কঠিন কাজ, আর যার লেখার অভ্যাস নেই তাকে কিছু লিখতে বললে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা। যারা লেখক, বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস লিখে অভ্যস্ত, তাদের লিখতে বললে সহজেই যেমন মনের মাধুরী মিশিয়ে একটি বিষয় উপস্থাপন করতে পারেন, তার বিপরীতে আমার মতো কারোর লিখার কাজটি খুবই দুরূহ ব্যাপার। একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে দশ মিনিট সময় কাটানো একজন লেখক তাঁর স্মৃতির ঝুলিকে কাজে লাগিয়ে একটি প্রবন্ধ বা বই লিখতে পারেন। কিন্তু যার সাথে জীবনের প্রায় সবটুকু সময় কেটেছে অর্থাৎ নিজ বাবা সম্পর্কে দুই তিন পৃষ্ঠায় কিছু লেখা আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। তবুও বাবার কাছ থেকে শেখা দু’একটি শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে কিছু লিখব বলে ঠিক করেছি।
আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল দেশে পারিবারিক সমস্যাটাকে কোন বড় সমস্যা বলে মনে করা হয় না। পারিবারিক সমস্যা বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি পরিবার-পরিজন ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং সকলের ন্যায্য অধিকার প্রদান করা। বর্তমানে আমাদের দেশে যত দেওয়ানি মামলা আছে তার অধিকাংশই পরিবারের সদস্য অথবা নিকট আত্মীয়ের মাঝে চলমান। পরবর্তীতে এই দেওয়ানি মামলাগুলোর কারণেই ঝগড়া, মারামারি এমনকি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সংঘটিত হয়ে তা ফৌজদারি মামলায় পরিণত হয়। এ ধরণের পরিস্থিতির মূল কারণ হিসেবে আমি পরিবার-পরিজন ও আত্মীয় স্বজনদের মাঝে ন্যায়সঙ্গত অধিকার দান এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সুসম্পর্কের অভাবকেই দায়ী করব।
আমাদের পরিবার অনেক বড় হলেও এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে আমি দেখেনি। এর মূল কারণ হিসেবে আব্বার বিচক্ষণতার প্রশংসা করতেই হয়। কারো অধিকার দানে তিনি যেমন কোন অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ করেননি তেমনি কাউকে করতেও দেননি। পরিবারের সকলকে একীভুক্ত রাখার একটা চেষ্টা সব সময় তাঁকে করতে দেখেছি। তার মানে এই নয় যে পরিবারের কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কোন দিন বলেননি বা কোন ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়নি। সাধারণত মানুষ এই ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে এমন সব কাজ বা কথা বলে যা সম্পর্কের ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তিনি সব সময়ই দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন যেন পরিবারের সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেন। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের পরিবারের মধ্যে একটি সুন্দর সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সবসময়ই বিরাজ করছে।
আর আব্বার প্রতি আল্লাহ্র একটি বিশেষ দান হচ্ছে তাঁর স্মরণশক্তি। এ সম্পর্কে অনেকেই জেনে থাকবেন। নিকট বা দূরের আত্মীয় স্বজনের কোন সমস্যা দেখা দিলে তা নিরসনের জন্য আব্বাকে সাধ্যমত চেষ্টা করতে আমি দেখেছি। এমন অনেক আত্মীয় আছে যাদের নাম ঠিকানা আমরা অনেকেই সঠিক ভাবে বলতে পারবনা। কিন্তু তিনি তাদের সময়ে সময়ে ঠিকই খোঁজ খবর নিয়ে থাকেন। এ মহৎ গুনটি যদি আমরা সকলে অর্জন করতে পারতাম তবে সমাজের বেশির ভাগ সমস্যা এমনিতেই মিটে যেত। মক্কা জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু পর্যন্ত রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ) আত্মীয়ের সাথে সদ্ব্যবহারের যে উপদেশ গুরুত্বের সাথে দিতেন তা অস্বীকার করেনি (বুখারী-৬)।
সূক্ষভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একটি সমাজের সবচেয়ে ছোট ইউনিট হচ্ছে পরিবার। কাজেই যে পরিবারে যখন শান্তি শৃঙ্খলা বিরাজ করে সে পরিবারের সদস্যগণ সমাজের জন্য উপকার বয়ে আনে। আর যদি পরিবারে শান্তি শৃঙ্খলা না থাকে তবে সে পরিবারের সদস্যরাই সমাজে নানা প্রকারের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। পরিবারের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার, পরস্পরের বিপদে আপদে সহানুভূতি প্রকাশ ছাড়াও সঠিক কাজে সহযোগিতা করার মন মানসিকতা অর্জন করার জন্য আমাদের সকলকে চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে বাস্তব উদাহরণ হিসেবে পরিবারকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য আব্বার প্রচেষ্টা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
এমুন জাগায় বইও না যে লোকে কয় উঠ
এমুন কথা কইও না যে লোকে কয় ঝুট
উপরোক্ত কথাটি আব্বার মুখ থেকেই প্রথম শোনা এবং যতদূর মনেপড়ে বাক্য দু’টি আমি যখন হাই স্কুলে পড়ি তখন কোন এক সময় বলেছিলেন। বাক্য দু’টি আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয়েছে। যার অর্থ – যে জায়গায় যার বসার অধিকার নেই, সেই জায়গায় না বসা এবং কখনও মিথ্যা না বলা, যেন পরবর্তীতে মানুষ একথা বলতে না পারে যে সে অনবরত মিথ্যা বলছে।
বাক্য দু’টি অতি সাধারণ মনে হলেও আমার কাছে এই দু’টি বাক্য প্রতিপালনের মাধ্যমে মানুষ তার নিজের আত্মসম্মান বোধ বজায় রাখার পাশাপাশি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে । বাক্যের প্রথম অংশটি দিয়ে মানুষ তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে যেমন সচেতন করে, তেমনি অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করার জন্য সাবধান করা হচ্ছে। আমি বহুবার ট্রেনে স্ট্যান্ডিং টিকেট কেটে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ গিয়েছি। কিন্তু এই কথাটি শোনার পর কখনও কোন সিটে বসিনি, এই ভয়ে যে হয়ত ঐ সিটের টিকেটধারী ব্যক্তি আমাকে সিট ছেড়ে দিতে বলবে। যেহেতু আমি যেনে বুঝেই স্ট্যান্ডিং টিকেট কেটেছি তাই অপরের সিটে বসে যাবার কোন অধিকার নাই। সেজন্যই ‘আমার সিট ছেড়ে দিন’ এই ধরনের লজ্জাজনক কথা শোনার মত পরিস্থিতির সম্মুখীন আমাকে হতে হয়নি।
বর্তমানে আমাদের সমাজে এই আত্মসম্মান রক্ষার অভাব ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। বরং কিভাবে একজন অপরকে তার অধিকার থেকে বঞ্ছিত করবে তার একটি অশুভ প্রতিযোগিতা সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এটি নিজ সম্মানের জন্যই যে ক্ষতিকর তা বোঝার মত সাধারণ জ্ঞানও আজ আমাদের লোপ পেয়েছে। সুতরাং যে কোন সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য সকলেরই তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সাথে সাথে অপরের অধিকারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করার মত মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে হবে। এই বিষয়টি কত সহজ ভাষায় বলা হয়েছে – ‘এমুন জাগায় বইও না যে লোকে কয় উঠ’।
আমরা এমন এক সময় পার করছি যেখানে কোন কথাটি সত্য আর কোন কথাটি মিথ্যা তা নির্ণয় করা সবচেয়ে কঠিন কাজে পরিণত হয়েছে। এর মূল কারণ সামগ্রিকভাবে সত্যভাষী মানুষের কদর কমে যাওয়া, অন্যদিকে অতি নগণ্য লাভের আশায় বা কাউকে খুশি করার জন্যে মিথ্যা বলার ব্যাপক প্রতিযোগিতা। অথচ এর মাধ্যমে নিজের অজান্তেই নিজের এবং সমাজের মানুষের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারছিনা। এ ধরনের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক সংবাদটিও মিথ্যায় পরিণত হচ্ছে। আবার সঠিক তথ্যের অভাবে যারা সততার সাথে দায়িত্ব পালনে ইচ্ছুক তারা সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এর সমাধানে ঐ সহজ কথাটি গ্রহণ করে নেয়া ‘এমুন কথা কইও না যে লোকে কয় ঝুট’। আমি সবসময় এর অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। বাস্তব ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ যথেষ্ট কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আমরা যারা দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসি বলে দাবি করি, তারা সবাই এই গুনটির অধিকারী হলে এদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আরেকটি কথা না বলে পারছিনা সেটা হচ্ছে কখনও কখনও মিথ্যাও সত্য বলে প্রমাণিত হয়ে যায়। যার কারণ সম্পর্কে রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, “কোন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হবার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই (সত্যতা যাচাই না করে) বলে বেড়াবে।” (মুসলিম, রিয়াদুস সালেহিন-১৫৪৭)। যাই হোক, আমি আব্বার ঐ কথাটি পালনের মাধ্যমে সবসময় একটা মানসিক তৃপ্তি পাই এবং নিজের কোন কথার কারণে আমাকে চিন্তিত অবস্থায় বিছানায় সময় কাটাতে হয়নি।
সার্থক রাজনীতিবিদ তারাই যাদেরকে সাধারণ মানুষ মন থেকে ভালবাসে। আর এ ধরণের রাজনীতিবিদ হতে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা ছাড়া কখনই সম্ভব নয়। আব্বার এই সফলতার পিছনে ছাত্রজীবন থেকে দাদার অবদান অপরিসীম। কলেজ জীবনে জিএস এবং ভিপি নির্বাচন করার সময় তিনি টাকা পয়সা দিয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন। আবার ৭০ এর নির্বাচনে এমএনএ নির্বাচিত হতে দাদা এক লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। অথচ আমাদের খরমপট্টির নিজ বাসাটি ১৯৬৯ সালে মাত্র ১৪ হাজার টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল, যার বর্তমান বাজার মূল্য ৪ কোটি টাকার কম হবে না। দাদার মৃত্যু কিভাবে হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। ১৯৭১ সালে নিজ বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার খবর শোনার পর দাদা হঠাৎ আব্বাকে না জানিয়েই শিলং থেকে মিঠামইনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে তিনি রাজাকার-আলবদরদের দ্বারা শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। রাজাকারেরা শীতের মধ্যে এই বৃদ্ধ লোকটির কাপড় চোপড় পর্যন্ত রেখে দেয়। নৌকায় আসার সময় বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডার মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নভেম্বরে তিনি মারা যান।
আবার প্রকৃত পলিটিসিয়ানদের সহধর্মিণীদের যে কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা অধিকাংশেরই অজানা। এতসব বিস্তারিত বলা সম্ভব নয় তা প্রথমেই বলেছি। শুধু ১৯৭৬-৭৭ এ আব্বা যখন জেলে ছিলেন সে সময়ের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাচ্ছি। যেমনঃ আমাদের ছোট দুই ভাইবোনকে পর্যাপ্ত দুধ কিনে খাওয়ানোর মত টাকা না থাকা, পরিমানে বাড়ানোর জন্য দুধের সাথে সাগু মিশিয়ে খাওয়ানো; তৌফিক ভাইয়ের হাফপ্যান্ট ছোট হয়ে যাবার কারণে প্যান্টের সেলাই খুলে নীচের দিকে কিছুটা বাড়ানো; বড় দুই ভাইয়ের পড়া শোনার ব্যাঘাত ঘটা; মাত্র ২০০ টাকা ধার চেয়ে নিকট একজনের কাছে আম্মার লিখা চিঠি; তবে বিভিন্ন সময়ে আব্বার শুভাকাঙ্ক্ষীরা খরচের জন্য ১০০-২০০ টাকা দিয়েছিলেন। তাদের সকলের নাম আম্মা এখনও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে থাকেন। এ ধরনের পরিস্থিতি দাদা বেঁচে থাকলে ঘটার সম্ভাবনা ছিলনা। আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, বর্তমানে অধিকাংশ পলিটিসিয়ানদের পরিবারকে অন্তত এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়না।
লেখক : রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ -এর কনিষ্ঠ পুত্র