অভিজিৎ কর্মকার : বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দায়ভাগা বা বেঙ্গল মতবাদের অনুসারী। দায়ভাগা বা বেঙ্গল মতবাদ বিশ্লেষণ করলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কারো মৃত্যু হলে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে মৃত ব্যক্তির সম্পদের উত্তরাধিকার কে বা কারা হবেন সেটা সহজেই পাওয়া যায়।
দায়ভাগা বা বেঙ্গল মতবাদের সারসংক্ষেপ নিন্মরূপ
একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির মৃত্যুর পর মৃত ওই ব্যক্তির সম্পত্তির ওপর তার জীবিত আত্মীয়স্বজনদের অধিকার জন্মায়। যাদের অধিকার জন্মায় তাদেরকে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার বলে। আর যারা আইনানুসারে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির ওপর অধিকার লাভ করেন তারাই মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী।
বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রচলিত দায়ভাগা বা বেঙ্গল মতবাদ অনুযায়ী উত্তরাধিকারের সাধারণ বা মৌলিক নীতিগুলো পিন্ড বা আধ্যাত্মিক কল্যাণবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দায়ভাগা বা বেঙ্গল মতবাদ অনুযায়ী হিন্দু ধর্মাবলম্বী মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়ে থাকে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোন মানুষ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির আত্মার সদগতির জন্য শ্রদ্ধাক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। শ্রদ্ধা ক্রিয়ার তিনটি ধাপ আছে। ১. পিন্ড দান, ২. পিন্ডলেপ এবং ৩. জলদান।
পিন্ড কি এবং কে দান করতে পারেন
উত্তরাধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পিন্ড কি? সপিন্ড কারা এবং কে পিন্ড দান করতে পারেন? এই প্রশ্নগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যব, মধু, আতপ চাল, তিল, কলা, ঘি, মধু মিশিয়ে যে মিশ্রণ তৈরি করা হয় তাকে পিন্ড বলে। আর মৃত ব্যক্তির পিন্ডদানের অধিকারী ব্যক্তিকে বলা হয় সপিন্ড। ক্রমানুসারে ৫৩ জন সপিন্ড রয়েছেন।
সহজভাবে সপিন্ড হল, যাঁরা পিন্ডদান করতে পারেন এবং যাঁরা পিন্ড গ্রহণ করতে পারেন তাঁরাই পরস্পরের সপিন্ড। যাঁরা কোন মৃত ব্যক্তির সপিন্ড তাঁরাই ওই মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন। তবে সপিন্ডদের মধ্যেও ক্রমানুসারে উত্তরাধিকার হওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে।
স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার ও জীবনস্বত্ব
১৯৩৭ সালের হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী স্ত্রীরা স্বামীর সম্পত্তির মধ্যে শুধুমাত্র বসতভিটার জীবনস্বত্বে ভোগ দখল বা ভোগ করতে পারতেন। কৃষি জমিতে সেই অধিকার পেতেন না। বর্তমানে কৃষি জমিতেও জীবনস্বত্বে ভোগ দখলের অধিকার পান। এখন আমাদের বুঝতে হবে জীবনস্বত্ব কী? জীবনস্বত্ব হচ্ছে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী তার জীবদ্দশায় স্বামীর সম্পত্তি (বসতভিটা) ভোগ করতে পারবেন। তবে সেই সম্পত্তি তিনি কোনভাবেই বিক্রয় করতে পারবেন না, অন্যের কাছে হস্তান্তর করতে পারবেন না, এমনকি নিজের সন্তানকেও দান করতে পারবেন না। তার মৃত্যুর পর হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী নামেমাত্র বিধবার সম্পত্তি বা উইডোজ এস্টেট হিসেবে পূর্বের মৃত স্বামীর পুরুষ উত্তরাধিকারের দখলে চলে যাবে। মৃত ব্যক্তির ছেলে সন্তান থাকলে মেয়ে সন্তানরা সম্পত্তির ভাগ পান না। আর যদি ছেলে সন্তান না থাকে সেক্ষেত্রে অবিবাহিত ও ছেলে সন্তান জন্মদানকারী মেয়েরা জীবনস্বত্ব শর্ত মেনে সম্পত্তি ভোগের অধিকার পান।
উত্তরাধিকার ক্রম
উদাহরণস্বরূপ- ধরা যাক, “কেদারনাথ” এর এক ছেলে, দুই কন্যা একজন বিবাহিত ও অপরজন অবিবাহিত ও স্ত্রী জীবিত আছেন। কেদারনাথের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার কি করে নির্ণয় হবে এবং কে সম্পত্তির মালিক হবেন?
হিন্দু দায়ভাগা উত্তরাধিকার নীতি ও হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে পিতার মৃত্যুর পর ছেলে জীবিত থাকলে সপিন্ড হিসাবে বাবার সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন জীবিত ছেলে। যেহেতু পু্ত্র জীবিত থাকলে হিন্দু আইনে কন্যা সন্তান কোন সম্পত্তি পান না সেহেতু কেদারনাথ এর বিবাহিত ও অবিবাহিত কন্যাদ্বয় কেউই সম্পত্তির কোন উত্তরাধিকার হবেন না।
হিন্দু উইমেনস রাইট টু প্রপার্টি অ্যাক্ট, ১৯৩৭ এর ৩ ধারা অনুসারে বিধবা স্ত্রী তার জীবদ্দশায় মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে পুত্রের সমান অংশ সীমিত মালিকানায় যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন জীবনস্বত্বে উত্তরাধিকার হিসাবে ভোগদখল করতে পারবেন। বিধবা স্ত্রী জীবদ্দশায় (জীবনস্বত্বে) সীমিত মালিকানা পেলেও তিনি তার মৃত স্বামীর সম্পত্তি বেচা বিক্রি বা উইল কিছুই করতে পারবেন না। বিধবা স্ত্রী মারা গেলে জীবিত ছেলে সন্তানের নিকট উত্তরাধিকার হিসাবে কেদারনাথের সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার ফিরে যাবে। অবিবাহিত মেয়ে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হলেও ভরণপোষণ পাওয়ার হকদার হবেন। এক্ষেত্রে কেদারনাথের নিকট উত্তরাধিকার হিসাবে ছেলে সম্পূর্ণ উত্তরাধিকার/মালিকানা পাওয়ার দরুণ কেদারনাথের অবিবাহিত মেয়ের ভরণপোষণ ও বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তার ওপর বর্তাইবে।
যদি এমন হয়, কেদারনাথের মৃত্যুর পর তার কোন ছেলে সন্তান জীবিত নেই। কেদারনাথের এর কণ্যাদ্বয়, বিধবা স্ত্রী ও ছেলের ঘরে ছেলে সন্তান অর্থাৎ কেদারনাথের পৌত্র জীবিত আছেন তাহলে কেদারনাথের নিকট সপিন্ড হিসাবে মৃত পুত্রের পুত্র (নাতি) কেদারনাথের সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন।
যদি এমন হয়, কেদারনাথের ছেলে বা ছেলের ঘরের ছেলে কেউ জীবীত নেই কিন্তু ছেলের ছেলের ঘরের ছেলে প্রপৌত্র জীবীত আছেন তাহলে কেদারনাথের মৃত পুত্রের পুত্রের পুত্র কেদারনাথের নিকট সিপন্ড হিসাবে সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন।
উপর্যুক্ত আলোচনা হতে এটা পরিষ্কার যে, হিন্দুধর্মের কেউ মৃত্যুবরণ করলে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে নিয়ম অনুযায়ী সর্বাগ্রে বা সর্ব প্রথমে একইসাথে প্রথমে মৃত ব্যক্তির (পুত্র), দ্বিতীয় পৌত্র অর্থাৎ (মৃত পুত্রের পুত্র), তৃতীয় প্রপ্রৌত্র অর্থাৎ (মৃত পুত্রের পুত্রের পুত্র) সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্বের দাবিদার হন। কারণ পুত্র তার পিতার, পৌত্র তার পিতার ও প্রপৌত্র তার পিতা এবং পিতামহের প্রতিনিধিত্ব করেন।
পিন্ড দানের পর অবশিষ্ট যা থাকে তাকে বলে পিন্ডলেপ। পিন্ডলেপ যাঁদের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয় তাদের বলে সকুল্য। যাঁদের পিন্ড দেওয়া হয় তাদের পূর্ববর্তী তিন পুরুষকে পিন্ডলেপ দেওয়া হয়। আর যাঁদের উদ্দেশ্যে জল দান করা হয় তাদেরকে বলে সমানোদক। যাঁদের পিন্ডলেপ দেয়া হয় তাঁদের সাত পুরুষকে জল দান করা হয়।
দায়ভাগা মতবাদ অনুযায়ী হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে সপিন্ড কেউ জীবিত থাকলে সেক্ষেত্রে সকুল্য ও সমানোদকরা কেউ সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন না। সপিন্ড যারা তাদের অধিকার আগে।
বাংলাদেশে প্রচলিত দায়ভাগা বা বেঙ্গল মতবাদ অনুযায়ী সপিন্ড দুই রকমের। ১. পিতৃকুলের সপিন্ড ২. মাতৃকুলের সপিন্ড। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে তাহলে একজন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার কে বা কারা হবেন? সহজ কথা হল, পিতৃকুলের সপিন্ডরা জীবিত থাকলে মাতৃকুলের সপিন্ডরা সম্পত্তি পান না। হিন্দুধর্মের কেউ মৃত্যুবরণ করিলে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে নিয়ম অনুযায়ী সর্বাগ্রে বা সর্ব প্রথমে একসাথে প্রথমে, মৃত ব্যক্তির (পুত্র); দ্বিতীয়, পৌত্র অর্থাৎ (মৃত পুত্রের পুত্র); তৃতীয়, প্রপ্রৌত্র অর্থাৎ (মৃত পুত্রের পুত্রের পুত্র) উত্তরাধিকারের দাবিদার।
এরপরের অবস্থান অর্থাৎ চার নম্বরে (বিধাবা স্ত্রী)। হিন্দু উইমেনস রাইট টু প্রপার্টি অ্যাক্ট, ১৯৩৭ অনুসারে বিধবা স্ত্রী তার জীবদ্দশায় মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে পুত্রের সমান অংশ সীমিত মালিকানায় যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন জীবনস্বত্বে উত্তরাধিকার হিসাবে ভোগদখল করিতে পারবেন।
এই আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর মৃতের বিধাবা, পুত্রের বিধাবা, পৌত্রের বিবাধা স্ত্রীও উত্তরাধিকার পান। এভাবে প্রথম ছয়জন মৃতের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পান। ১. পুত্র, ২. পৌত্র, ৩. প্রপৌত্র, ৪. মৃতের বিধাবা স্ত্রী, ৫. মৃতের পূর্বে মৃত তার পুত্রের বিধাবা স্ত্রী, ৬. মৃতের পূর্বে মৃত তার পুত্রের পূর্বে মৃত পুত্রের বিধাবা স্ত্রী।
পাঁচ নম্বরে কন্যা- যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র ও বিধাবা স্ত্রী না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির কণ্যাদের মধ্যে অবিবাহিত কণ্যা ও পরে পুত্রবতী ও পুত্র সম্ভবনা কণ্যা সম্পত্তি পান। তবে কণ্যারা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে সীমিত মালিকানায় উত্তরাধিকারী হবেন।
ছয় নম্বরে কন্যার পুত্র/ দৌহিত্র – যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র, বিধাবা স্ত্রী কণ্যা কেউ জীবিত না থাকে তাহলে কণ্যার পুত্র/দৌহিত্র সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়।
সাত নম্বরে পিতা- যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র, বিধাবা স্ত্রী, কণ্যা ও দৌহিত্র ৬ জনের কেউ জীবিত না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির পিতা সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন।
আট নম্বরে মাতা- যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র, বিধাবা স্ত্রী, কণ্যা, দৌহিত্র ও পিতা এই ৭ জনের কেউ জীবিত না থাকেন তাহলে মৃত ব্যক্তির ৮ নং ক্রমিকে মাতা সীমিত মালিকানায় (জীবনস্বত্বে) সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন।
যদি এই ৮ জনের কেউ জীবিত না থাকেন তাহলে ক্রমানুসারে সহোদর (ভাই), (ক) সহদোর ভাই, (খ) বৈমাত্রেয় ভাই; ভাইয়ের পুত্র; ভাইয়ের পুত্রের পুত্র; বোনের পুত্র; পিতামহ (পিতার পুত্র); পিতামহী (পিতার মাতা); পিতার ভাই মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হন। এভাবে সপিন্ডের ৫৩ জন রয়েছেন।
সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার বা অধিকার বলতে বোঝায়- পিতার সম্পত্তিতে উক্ত পিতার পুত্র সন্তান যেরূপ অধিকার, মালিকানা লাভ করেন কন্যা সন্তানও সেইরূপ অধিকার বা মালিকানা লাভ করাকে। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু আইন অনুযায়ী ১৪৭ জন বা তারও বেশী সকুল্য, সমানোদক ও সপিণ্ডকে ডিঙিয়ে পিতার সম্পত্তিতে নারী বা কন্যা সন্তানেরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাননা, এমনকি সম্পত্তি দাবী করার সুযোগও পান না। অন্যদিকে স্বামীর সম্পত্তিতে জীবনস্বত্ব নামান্তরে আশ্রিত হয়ে বেঁচেবর্তে থাকার একটি সুযোগ পান মাত্র।
লেখক : অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, ঢাকা।