প্রবেশন আইনের ৫ ধারা অনুসারে উপযুক্ত অধস্তন আদালতগুলোকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার চর্চা করতে বিচারকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের দেওয়া এই নির্দেশনা যেন বিচারকরা প্রতিপালন করেন সেজন্য সার্কুলার জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. গোলাম রব্বানী স্বাক্ষরিত গত বৃহস্পতিবার (১১ মে) জারি করা ঐ সার্কুলারে বলা হয়েছে, ‘দ্যা প্রবেশন অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স’-এর বিধান প্রতিপালনের জন্য হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন তা প্রতিপালন করতে অধস্তন সব আদালতের বিচারকদের নির্দেশ দেওয়া হলো।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ‘মো. আসাদ উদ্দিন বনাম বাংলাদেশ’ মামলায় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারকদের প্রতি এ আদেশ দেন।
দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে বলা হয়, প্রবেশন অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-এর ৫ ধারায় উপযুক্ত অধস্তন আদালতগুলোকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার চর্চা করতে বিচারকদের নির্দেশ দেওয়া গেল।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. আসাদ উদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মিসবাহ উদ্দিন ও মো. আশরাফুল ইসলাম।
প্রবেশন আইনের প্রয়োগ কম থাকায় অল্প দণ্ডের মামলাও ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে দায়রা আদালত, হাইকোর্ট বিভাগ ঘুরে আপিল বিভাগ পর্যন্ত চলে আসে। ফলে মামলাজট তৈরি হয়। এ বিষয়গুলো তুলে ধরে হাইকোর্টে ওই রিট আবেদন দায়ের করেন ১১ জন আইনজীবী।
প্রবেশন আইন কার্যকরে সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগ
‘দ্যা প্রবেশন অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স’ ৬৩ বছরের পুরানো আইন। এই আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কতিপয় মামলায় দণ্ডিতদের শর্তাধীনে মুক্তিদান করা। যাতে তারা কারাগারে না গিয়ে শর্তসাপেক্ষে বাড়িতে থেকে আদালতের শর্ত মোতাবেক নিজেদের সংশোধনের সুযোগ পান। অচল এই আইনটিকে কার্যকর করতে চার বছর আগে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের নির্দেশনা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।
ঐ নির্দেশনায় বলা হয়েছিল ইচ্ছাকৃতভাবে এই আইনের বিধানাবলি প্রয়োগ না করলে তা অসদাচরণের শামিল হবে। বিচারকদের এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হতে সার্কুলার জারি করলেও তা প্রতিপালনে সচেষ্ট নন অধিকাংশ বিচারক।
তবে অধস্তন আদালতের অনেক বিচারক পুরানো এই আইনের বিধানাবলি প্রয়োগ করে বিচার ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। এতে বিচারপ্রার্থীরা যেমন উপকৃত হচ্ছেন, তেমনি কারাগারে বন্দির চাপ কমছে।
এখন দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকরা যেন তাদের এখতিয়ার অনুযায়ী উপযুক্ত মামলায় ৬৩ বছরের পুরোনো এই আইনের আরও কার্যকর প্রয়োগ ঘটান সেজন্য তাদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। আর উচ্চ আদালতের দেওয়া এই নির্দেশনা যেন বিচারকরা প্রতিপালন করেন সেজন্য বৃহস্পতিবার পুনরায় আরেকটি সার্কুলার জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
চার বছর আগে দেওয়া নির্দেশনায় যা বলেছিল সুপ্রিম কোর্ট
সার্কুলারে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দণ্ডিতদের সাজা ভোগের নিমিত্তে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এতে কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়াসহ দেশের প্রচলিত আইনের বিধানকে সরাসরি অবজ্ঞা করা হচ্ছে। ফলে কারাগারের পরিবেশসহ সমাজে এক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে চলেছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স আইনটির বিধানাবলির যথাযথ প্রয়োগ দরকার। তাই অপরাধীর বয়স, পূর্বাপর আচরণ, দৈহিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত আইনের বিধানাবলির যথাযথ প্রয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
বিচারপ্রার্থীদের মনে আশার সঞ্চার
সুপ্রিম কোর্টের এই সার্কুলার অনুযায়ী অধস্তন আদালতের অনেক বিচারক এই আইনের বিধানাবলির প্রয়োগ করে নানা মানবিক আদেশ দিতে থাকেন। যা বিচারাঙ্গনসহ বিচারপ্রার্থীদের মনে আশার সঞ্চার জোগায়।
অধস্তন আদালতে মো. জাকির হোসেন, মো. সাইফুল ইসলাম, কাজী শরিফুল ইসলাম, রাজীব কুমার দেব, মো. জাকির হোসাইন, মো. জিয়াউর রহমান, আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী প্রমুখ বিচারক বিভিন্ন মামলায় অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণের পর সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর পরিবর্তে নানা শর্তে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আদালতের নির্দেশে বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৫ হাজার আসামি প্রবেশনে রয়েছে।
লঘু অপরাধে দণ্ডিতদের সংশোধনের সুযোগ
প্রবেশন আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, পুরুষ আসামির ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দণ্ডবিধির নির্দিষ্ট কয়েকটি ধারায় অপরাধের দণ্ড ব্যতিত যেকোনো দণ্ডের ক্ষেত্রে প্রবেশন পেতে পারেন। আর নারী আসামিরা মৃত্যুদণ্ড বাদে যেকোনো দণ্ডের ক্ষেত্রে প্রবেশন পেতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, অল্প দণ্ডের মামলাও ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে দায়রা আদালত, হাইকোর্ট বিভাগ ঘুরে আপিল বিভাগ পর্যন্ত চলে আসছে। অথচ এমন অসংখ্য মামলা আছে, যেগুলোতে প্রবেশনের আদেশ হলে প্রথম কোর্টেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। এসব কারণে মামলাজট তৈরি হয়।
বিচারাঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফৌজদারি আদালতের বিচারকরা যদি পুরোনো এই আইনের বিধানাবলি প্রয়োগে আরো আন্তরিক হন তাহলে প্রথমবার যারা লঘু অপরাধ করে দণ্ডিত হয়েছেন তারা নিজেদের নানা শর্তে কারাগারের বাইরে সংশোধনের সুযোগ পাবেন। কারণ সাজা প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য সংশোধনমূলক, প্রতিহিংসামূলক নয়।