দীপজয় বড়ুয়া : বিশেষজ্ঞ মতামত (Expart Opinion) সাক্ষ্য আইনের (The Evidence Act – 1872) ৪৫ নং ধারায়, তৃতীয় ব্যক্তির মতামত হিসেবে প্রাসঙ্গিক। যখন আদালতে, বিদেশী আইন, বিজ্ঞান, কলার (Art) কোনো বিষয়ের ওপর অথবা হাতের লেখা, আঙুলের ছাপের একক অনন্য পরিচিতি সম্পর্কে অভিমত গঠন করার দরকার পড়ে তখন সেই বিষয় অর্থাৎ উক্ত বিদেশী আইন, বিজ্ঞান, কলা, হাতের লেখা, আঙুলের ছাপ সংক্রান্ত প্রশ্নে বিশেষ ভাবে দক্ষ ব্যক্তিদের মতামত প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হবে।
যদি কোন বিশেষজ্ঞ (Expart) একজন সাক্ষী (Witness) হিসেবে আদালতে তার মতামত দেন। তিনি শুধুমাত্র সেই বিষয়েই আদালতকে অবহিত করবেন যা তার পর্যবেক্ষণ ও বিশেষ দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জেনেছেন। সিদ্ধান্ত বা অভিমত নয়। সিদ্ধান্তে আসার দায়িত্ব আদালতের। অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ মতামত আদালতগ্রাহ্য হওয়ার জন্যে ১) বিষয়টি এমনি হতে হবে যেখানে বিশেষজ্ঞর সাক্ষ্য বা মতামত অবশ্য প্রয়োজন ২) আলোচ্য সাক্ষী প্রকৃতপক্ষে একজন বিশেষজ্ঞ।
5 DLR(FC)280 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “যে সকল বিষয় সর্বতোভাবে শুধু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের জ্ঞানে নিহিত, ঐ সকল বিষয়ে আদালতের মতামত গঠনের জন্য বিশেষজ্ঞের মতামত বা স্বীকৃত গ্রন্থের উপর নির্ভর করাই উপযুক্ত হবে”।
37 DLR 156 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ময়না তদন্তকারী মেডিক্যাল অফিসার মৃত বা সাক্ষ্য দিতে অসমর্থ হইলে অথবা বাংলাদেশের বাহিরে থাকিলে তাহার প্রতিবেদন জবানবন্দি ব্যতীত সাক্ষ্য হিসাবে গণ্য করা যায়”।
43 DLR 18 Sheikh Salimullah Vs. Ataur Rahman মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “চিকিৎসা-সাক্ষ্য শুধু সমর্থন দেওয়ার কাজ করে-নিজ চোখে দেওয়া সাক্ষীর চাক্ষুষ সাক্ষ্য যদি মূলতঃ মৃত লোকের শরীরের বৃহৎ আঘাতগুলো সমর্থন করে,তাহা গ্রহণযোগ্য হইবে”।
44 DLR 556 Abdur Rahman Syed Vs.The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“বিশেষজ্ঞ লোকদের সাক্ষ্য ও মতামত অন্যান্য সাক্ষ্যের মত বিবেচনা পাইতে পারে কিন্তু এই সাক্ষ্য খুবই সাবধানতার সহিত নিতে হইবে”।
53 DLR(HC)439 THE State Vs. Md.Shamim@Shmim Sikder and ors.(criminal) মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “Medical Evidence is only corroborative in nature, the ocular evidence of the eye-witness which substantially corroborates the major injuries on the person of the deceased be accepted”.
বিশেষজ্ঞ/বিশারদ/Expert কে?
একজন বিশেষজ্ঞের সংজ্ঞা সাক্ষ্য আইনের ৪৫ ধারার বিধান থেকে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একজন ‘বিশেষজ্ঞ’ বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝায় যার নিচের যেকোনো একটিতে বিশেষ জ্ঞান, দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা আছে—-
১। বৈদেশিক আইন (Foreign Law)
২। বিজ্ঞান (Science)
৩। চারুকলা বা শিল্প (Art)
৪। হাতের লেখা বা হস্তলিপি শনাক্তকরণ (Identity of handwriting)
৫। আঙুলের ছাপ বা টিপসই শনাক্তকরণ (Identity of finger impression)
সাক্ষ্য আইনের ৪৫ ধারা অনুসারে, একজন বিশেষজ্ঞের সংজ্ঞা শুধুমাত্র উপরে উল্লিখিত পাঁচটি বিষয় বা ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উপরোক্ত বিষয় সমূহ ছাড়াও আরও কিছু বিষয় বা ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলির উপর আদালত বিশেষজ্ঞের মতামত চাইতে পারে। এখন কথা হচ্ছে, উপরিউক্ত ৫ বিষয়ের যেকোনো একটিতে যদি কোন বিষয়ের বিশেষ জ্ঞান থাকে, তাহলে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ বা বিশারদ বা Expert হিসেবে গণ্য হবেন.
কিন্তু কথা হচ্ছে তিনি এই ধরনের জ্ঞান কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে বা অর্জন করেছেন, এই বিষয়ে যদি কোন প্রশ্ন উঠে বা কেউ আপত্তি তুলে তবে সেক্ষেত্রে আবার ৩ টি উপায়ের কথা বলা আছে, যার মাধ্যমে একজন বিশেষজ্ঞ বা বিশারদ বা Expert, নিজেকে বিশেষজ্ঞ মতামত/বিশারদের অভিমত/Expert Opinion দেওয়ার জন্য যোগ্য দাবীদার হয়ে উঠতে পারেন।
যদি একজন ব্যক্তি বিশেষজ্ঞ বা বিশারদ বা Expert তার জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকেন ক) অনুশীলন দ্বারা, খ) পর্যবেক্ষণ বা গ) সঠিক অধ্যয়নের মাধ্যমে। উদাহরণ স্বরূপ, একজন মেডিকেল অফিসার, ব্যালিস্টিক বিশেষজ্ঞ, রাসায়নিক বিশ্লেষক, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ, আঙুলের ছাপ বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি।
সাধারণ অর্থ বলা যায় যে, যে ব্যক্তি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার আলোকে কোন বিশেষ বিষয় সম্পর্কে মতামত প্রণয়ণ বা প্রদানে সক্ষম তিনিই বিশারদ। সাধারণ সাক্ষীরা যা বলতে সক্ষম নয়, তিনি একজন বিশেষজ্ঞ বা অধিকর্তা হবেন বা ঐ বিষয়ক পেশায় নিয়োজিত থাকবেন এমন নহে। যাকে ডাকা হয়েছে তিনি ঐ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি হলেই যথেষ্ট, যা তিনি পেশায় না থেকেও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
PLD 1978(Karachi) 270 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“একজন ব্যক্তি লেখাপড়া না জেনেও ব্যবসায় রীতিনীতি, প্রথা, পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়ে মতামত দিতে সক্ষম হবেন যদি তার ব্যবহারিক জ্ঞান থাকে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ না থাকলে বিশারদ হিসাবে গ্রহণ করা যায় না”।
PLD 1978(Lah)81 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“ বিজ্ঞান বা কলা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে হলে বিশেষভাবে পড়াশোনা, অভিজ্ঞতা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। যেমন একজন মোটরগাড়ী মেরামতকারী এবং মোটর ওয়ার্কশপের মালিক একটি ক্ষতিগ্রস্থ গাড়ীর ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হতে পারেন”।
বিশেষজ্ঞ মতামত/বিশারদের অভিমত/Expert Opinion কেন প্রয়োজন?
সাধারণত, আদালত কোন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জনকারী ব্যক্তিদের সহায়তা ছাড়া প্রযুক্তিগত ভাবে জটিলতা এবং পেশাগতভাবে পরিশীলিত বিষয়গুলির উপর সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। কেননা, আজকের দিনের সাইবার মামলা সংক্রান্ত মামলা গুলোর টেকনিক্যাল বিষয়গুলো বুঝার জন্য আইটি’তে যে পর্যায়ের অভিজ্ঞ বা এক্সপার্ট হওয়া প্রয়োজন, সেটি অন্যান্য বিষয়ে বেশ অভিজ্ঞ বিচারকদের পক্ষেও প্রায় সম্ভব না।
কেননা, সাইবার বিষয়টি খুবই সাম্প্রতিক সময়ের উদ্ভাবন এবং এর সাথে সম্পৃক্ত অপরাধ গুলোও অনেক অভিনব, যেটি কিনা আইটি’তে এক্সপার্ট না হলেও মোটামুটি ভালো ভাবে না বুঝলে সেই বিষয়ে শুনানি করা খুবই রিস্কি। তাই, সাইবার মামলায় খুবই টেকনিক্যাল বিষয়ে কোন একটি বিষয় বুঝার জন্য বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আইটি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বা বিশারদ বা Expert এর অভিমত বেশ উপযোগী।
21 DLR(WP)4 Sabir Hossain Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ যিনি ময়নাতদন্ত করিয়াছেন, ফৌজদারী মোকদ্দমায় তাহার সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ।যে সকল চিকিৎসক ময়নাতদন্ত করেন আদালতে তাহাদের সাক্ষ্য প্রদান শুধু রীতিগত কর্তব্যই নহে বরং মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশুদ্ধ মতামত প্রদানে আদালতকে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাইতে সক্ষম করা”।
হস্তলিপি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাক্ষীর মূল্য
বিদেশি আইন, বিজ্ঞান, চারুকলা, হস্তলিপি টিপসহি সনাক্তকরণ বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী ব্যক্তিদেরকে বিশেষজ্ঞ বা এক্সপার্ট বা বিশারদ বলে। একজন বিশেষজ্ঞ কে উপযুক্ত সাক্ষী হওয়ার জন্য পেশাগত জ্ঞান না থাকলেও চলবে, তবে তাকে বিচার্য বিষয় সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে হবে, তাহলেই তার সাক্ষ্য গ্রহণীয় হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য খণ্ডন যোগ্য সাক্ষ্য।
বিশেষজ্ঞকে আদালতে উপস্থিত হয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করতে হবে। তিনি ডাকযোগে তার অভিমত প্রেরণ করলে আদালতে তা গ্রহণীয় হবে না কারণ বিশেষজ্ঞদের অভিমত যেহেতু খন্ডন যোগ্য সেহেতু প্রতিপক্ষ তাকে জেরা করতে পারেন কিন্তু ডাকযোগে অভিমত প্রেরণ করলেন জেরা করার সুযোগ থাকে না।
আঙ্গুলের ছাপ পরিবর্তন হয় না কাজেই এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হস্তলিপি বা হাতের লেখা বা স্বাক্ষর পরিবর্তন হয়, এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের অধিক সর্তকতা অবলম্বন করা হয়। সুতরাং বলা যায় হস্তলিপি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্যের মূল্য অনেক।
14 DLR 364 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“কোন বিশারদের অভিমত বা অনুবাদ সন্তোষজনক না হইলে দ্বিতীয় কোন বিশারদের দ্বারা উহা করানো যায়। নিম্নাদতে সংস্কৃত লেখা দলিলটির অনুবাদ সঠিক না হওয়ায় উচ্চ আদালত দ্বিতীয় আপীল অন্য একজন বিশারদ দ্বারা সঠিক অনুবাদ করান”।
আদালত কি একজন বিশেষজ্ঞের মতামত মানতে বাধ্য কিনা
বিদেশী আইন, বিজ্ঞান, চারুকলা, হস্তলিপি, টিপসহি সনাক্তকরণ বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী ব্যক্তিগণ হলেন বিশেষজ্ঞ। যখন এই বিষয়ে আদালতকে কোন সিদ্ধান্তে আসতে হয়, তখন বিশেষজ্ঞের অভিমত একান্ত প্রয়োজন কারণ কোন ব্যক্তি জ্ঞানের আওতার বাইরে নয়। তবে বিশেষজ্ঞের মতামত আদালতকে মানতেই হবে বিষয়টি এমন নয়।
কারণ বিশেষজ্ঞদের ভুল হতে পারে বা বিশেষজ্ঞের মতামত পক্ষপাতিত্বমূলক হতে পারে। বিশেষজ্ঞের মতামত আদালতের বিচার কার্য সহায়ক হিসেবে কাজ করে। সুতরাং বলা যায় বিশেষজ্ঞের মতামত আদালত ইচ্ছা করলে গ্রহণ করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন।
সুতরাং বলা যায় যে, যে ব্যক্তি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার আলোকে কোন বিশেষ বিষয় সম্পর্কে মতামত প্রণয়ণ বা প্রদানে সক্ষম তিনিই বিশারদ। সাধারণ সাক্ষীরা যা বলতে সক্ষম নয়, তিনি একজন বিশেষজ্ঞ বা অধিকর্তা হবেন বা ঐ বিষয়ক পেশায় নিয়োজিত থাকবেন এমন নহে। যাকে ডাকা হয়েছে তিনি ঐ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি হলেই যথেষ্ট, যা তিনি পেশায় না থেকেও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্য কণিকা: সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য- গাজী শামসুর রহমান, এডভোকেট নাসির উদ্দিন – আইন শব্দসমূহ, সাক্ষ্য আইন- বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২, এডভোকেট মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম-এ বুক অব ক্রস এক্সজামিনেশন সিভিল-ক্রিমিনাল উইথ রেফারেন্স, উইকিপিডিয়া, সাক্ষ্য আইন- বাসুদেব গাংগুলি।