রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন।
আজ সোমবার (১৫ মে) রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নিজাম উদ্দিন গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে আবেদনের পর আরও কিছু আইনি প্রক্রিয়া বাকি থাকায় এই ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
গত ২ মার্চ এই দুজনের ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করেন সর্বোচ্চ আদালত। তবে তার সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এখনও কারাগারে পৌঁছায়নি।
কাগজপত্র পৌঁছানোর পর নিম্ন আদালত থেকেও একটি নির্দেশনা আসবে। এরপর প্রাণ ভিক্ষার আবেদনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ।
নিম্ন আদালতে দুজনের মৃত্যুদণ্ডের যে রায় এসেছিল তাই বহাল থাকে আপিলে, খারিজ হয় রিভিউ আবেদনও। তাই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা ছিল না তাদের।
তবে এরপরও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় দণ্ডিত এই দুজনের ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে গত ৭ মে ফের রিট আবেদন করেন তাদের স্বজনরা। যদিও উত্থাপিত হয়নি মর্মে পরবর্তীতে সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন বিচারপতি মো. জাফর আহমেদ ও মো. বশির উল্ল্যার হাইকোর্ট বেঞ্চ।
হাইকোর্ট রিট আবেদনটি করেছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের স্ত্রী ইসরাত রহমান এবং ফাঁসির দণ্ড পাওয়া জাহাঙ্গীর আলমের ভাই মিজানুর রহমান। আবেদনে বলা হয়, এ মামলায় আসামিদের গ্রেফতার ও জবানবন্দি গ্রহণে সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার ব্যত্যয় হয়েছে।
তবে আপিল বিভাগ ফাঁসি বহাল রাখার পরও রাবি ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুই আসামির হাইকোর্টে রিট আদালত অবমাননার সমান বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
এই রিট সম্পর্কে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগ ফাঁসি বহাল রাখার পরও তাদের হাইকোর্টে রিট আদালতকে একরকম অসম্মান করার সামিল। কারণ এখন আর তাদের কিছুই করণীয় নেই। শুধু তারা এতটুকু করতে পারেন যে, মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাওয়া।
প্রাণভিক্ষার আবেদনের ব্যাপারে নিজাম উদ্দিন বলেন, শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে ফাঁসির আদেশ বহাল থাকার পরপরই কারাবিধি অনুযায়ী এই আসামির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে চান কিনা। এরপর তারা এই ঘটনায় নিজেদের দোষ স্বীকার প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। পরে তা নিয়ম মেনে পাঠিয়েও দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, তবে উচ্চ আদালতে বহাল থাকা ফাঁসির আদেশের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ডাকযোগে কারাগারে পাঠানো হয়। সেই কাগজপত্র পাওয়ার পর নিম্ন আদালত (যেই আদালতে প্রথম রায় হয়েছিল) থেকেও এই ব্যাপারে পরবর্তী করণীয়র কথা উল্লেখ করে একটি নির্দেশনা কারাগারে আসে। সেটি দেখে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে আবারও বিষয়টি জানাতে হয় যে, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন এবং তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়া ফাঁসি কার্যকরের আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
এ বিষয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল বলেন, সাধারণত কোনো মামলায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখার পরপরই প্রাণভিক্ষার আবেদনটি আসামিদের সম্মতিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ড. এস তাহের হত্যা মামলায়ও তার ব্যত্যয় হয়নি।
তিনি বলেন, কারাবিধি অনুযায়ী আবেদন ওই সময়ই (লিভ টু আপিল খারিজের পর) চলে গেছে। এরপর তারা (দুই আসামি) আবারও উচ্চ আদালতে রিট করেছেন বলে জানতে পেরেছি। আর আবেদনের পর পরবর্তী এই প্রক্রিয়াগুলোও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে সরকারকে জানাতে হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সমস্ত প্রক্রিয়া শেষে যখন নিম্ন আদালত থেকে নির্দেশনা আসে যে, আর কোনো আইনি প্রক্রিয়া অবশিষ্ট নেই। তখন তা আবারও রাষ্ট্রপতি বরাবর জানাতে হয়। এরপর প্রাণভিক্ষার আবেদনের ব্যাপারে সদয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়। আর পুরো বিষয়টিই একটি প্রক্রিয়া। এখন আদালত থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এলে সেই প্রক্রিয়াগুলো কারাবিধি অনুযায়ী প্রতিপালন করা হবে বলেও উল্লেখ করেন রাজশাহী কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার।
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাবির কোয়ার্টারের ম্যানহোল থেকে অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ মহানগরীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত ২০০৮ সালের ২২ মে আলোচিত এই মামলায় চারজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুজনকে খালাস দিয়ে রায় দেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের সম্বন্ধী আব্দুস সালাম।
খালাস পাওয়া দুই আসামি হলেন- বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সী।
রায় ঘোষণার পর ওই বছরই বিচারিক আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয় হাইকোর্টে। একইসঙ্গে আসামিরাও আপিল করেন। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে অন্য দুইজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট।
যাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে তারা হলেন- রাবির সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া দুই আসামি হলেন- জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের সম্বন্ধী আব্দুস সালাম।
এরপর আসামিরা আপিল বিভাগে আপিল করেন। একইসঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া দুই আসামির দণ্ড বৃদ্ধি চেয়ে পৃথক আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত বছরের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রেখে রায় দেন। ১৫ সেপ্টেম্বর আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর আসামিরা রিভিউ আবেদন করেন।