চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসন ও আইনজীবীদের মধ্যে যে বিরোধ চলমান আছে, তা খুব শীঘ্রই পক্ষদ্বয়ের সাথে বৈঠকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে বলে আইনজীবী সমিতির অভিষেক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
চট্টগ্রাম কোর্ট হিলস্থ আইনজীবী সমিতির অডিটরিয়ামে গত বৃহস্পতিবার (২৫ মে) সন্ধ্যায় এক জাকজমক পূর্ণ পরিবেশে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের অভিষেক-২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়।
বিপুল সংখ্যক আইনজীবী ও আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতিতে অভিষেক অনুষ্ঠানের সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এ.এস.এম. বজলুর রশিদ মিন্টু, সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নর্বাচিত সভাপতি মোহাম্মদদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইমরান এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন সমিতির সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম বেলাল।
অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ ড. আজিজ আহমদ ভূঞা, মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুননেছা, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল সদস্য এ.এস.এম. বদরুল আনোয়ার, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমী, চীফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. রবিউল আলম প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতেও সরকারেকে অনেকটা বেগ পেতে হয়। নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণ ও মেট্টোরেলসহ অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের কাজ অতিদ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে যার ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী অনেক উপকৃত হবে। শীঘ্রই এই টানেল উদ্বোধন করা হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। সরকারের এই চলমান উন্নয়নে তিনি বিচার বিভাগের পাশাপশি বিজ্ঞ আইনজীবীদের সর্বাত্মক সহযোগীতা কামনা করেন।
মন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামের আদালত প্রতিষ্ঠার পর থেকে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ও আইনের শাসন অক্ষুন্ন রাখতে এ বারের সদস্যরা যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। সকল স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিসহ সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। যেখানে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে সেখানেই চট্টগ্রাম বারের আইনজীবীরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করে অধিকার আদায় করেছেন।
জেলা প্রশাসন ও আইনজীবীদের মধ্যে যে বিরোধ চলমান আছে, তা খুব শীঘ্রই পক্ষদ্বয়ের সাথে বৈঠকের মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিষয়ে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করবেন জানিয়ে বলেন, জেলা প্রশাসনের সাথে সমিতির যে বৈরীতা তা অচিরেই কাটিয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোন কারন নেই। যে কোন সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা সম্ভব।
অভিষেক অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন বিদায়ী সভাপতি আবু মোহাম্মদ হাশেম, বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক এ.এইচ.এম. জিয়াউদ্দিন, উপস্থিত ছিলেন নবনির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ সেকান্দর চৌধুরী, সহসভাপতি আবদুল হক, অর্থ সম্পাদক মোশারফ হোছাইন, পাঠাগার সম্পাদক মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, ক্রীড়া সম্পাদক মো. ওমর ফারুক, তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক অলি আহমদ, নির্বাহী সদস্য যথাক্রমে মোহাম্মদ জাহেদ হোসেন, জামশেদ আলম, মো. ইকবাল হোসাইন, মো. সাদ্দাম হোসেন, মনজুর আলম, সাজেদা বেগম (সাজু), ইসরাত জাহান মুকুল, মিনহাজ উদ্দিন, রানা মিত্র, আবিদা সুলতানা (শারমিন), ফারজানা হাকিম চৌধুরীসহ বিদায়ী পরিষদের কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ এবং সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাধারণসম্পাদকবৃন্দ সহ চট্টগ্রামের আদালতসমূহের বিচারকবৃন্দ, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথি নির্বাচিত পরিষদকে পুস্পস্তবক দিয়ে অভিষিক্ত করেন এবং বিদায়ী পরিষদকে নব-নির্বাচিত পরিষদের পক্ষ থেকে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। প্রধান অতিথিকে সমিতির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা স্বরূপ সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। অভিষেক অনুষ্ঠান শেষে দেশের খ্যাতনামা সংগীত শিল্পীদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং নৈশভোজে আপ্যায়িত করা হয়।
চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসন ও আইনজীবীদের মধ্যে বিরোধ
চট্টগ্রাম আদালতপাড়ায় (কোর্টহিল) ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জেলা আইনজীবী সমিতি ও জেলা প্রশাসনের বিরোধ চলছে বহুদিন ধরে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই দুই সংস্থার বিরোধ মেটেনি। বরং দিনদিন বেড়েই চলেছে।
গত বছর আইনজীবী সমিতি আদালতপাড়ায় দুটি নতুন বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি নিলে বাধা দেয় জেলা প্রশাসন।অনুমোদনহীন ও অবৈধভাবে আইনজীবী সমিতির ভবন নির্মাণ করছে অভিযোগ তুলে জেলা প্রশাসন ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়।
অন্যদিকে আইনজীবী সমিতির নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তারা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ভবন নির্মাণ ছাড়াও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ ও পাহাড়ের ফাটল, গভীর নলকূপ স্থাপন, আদালত ভবনের সামনে অস্থায়ী ফুলের বাগান তৈরি ও ইট-সুড়কি রেখে চলাচলের পথ সংকুচিত করাসহ নানা বিষয় নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে বিরোধ লেগেই আছে।
চট্টগ্রাম আদালতপাড়ায় আইনজীবী সমিতির বিদ্যমান পাঁচটি ভবনের পাশাপাশি নতুন আরও দুটি বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘বঙ্গবন্ধু আইনজীবী ভবন’ ও ‘একুশে আইনজীবী ভবন’ নামে ভবন দুটি নির্মাণে দরপত্র আহ্বানের পাশাপাশি আইনজীবী চেম্বার বরাদ্দে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আইনজীবী সমিতি। এরপরই তৎপর হয় জেলা প্রশাসন।
গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর কয়েকটি গণমাধ্যমে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জেলা প্রশাসন। এতে বলা হয়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী কোনো পাহাড় বা টিলার ওপর কোনোরূপ স্থাপনা সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া করা যাবে না। নতুন কোনো ভবনে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ না দিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক।
১৮৯৩-৯৪ সালে প্রায় ১৩০ বছর আগে নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন পরীর পাহাড়ে চট্টগ্রাম আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, নতুন আদালত ভবন, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন এবং আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনসহ বেশকিছু সরকারি কার্যালয় রয়েছে। নতুন ভবন নির্মাণ নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে জেলা আইনজীবী সমিতি।
তবে সমিতি সূত্র বলছে, জেলা প্রশাসন অহেতুক আইনজীবী সমিতির কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমিতির জমি ও স্থাপনার বিষয়ে জেলা প্রশাসন থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় ও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। সমিতির ৫টি ভবনেরই অনুমোদন আছে। একুশে ভবনের এক্সটেনশনেরও অনুমতি আছে।
নতুন ২ ভবনের কাজ যথাযথ অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুরাতন আদালত ভবনের সামনে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে চলাচলের একমুখী রাস্তা, পূর্বপাশের খোলা স্থানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং বাগান নির্মাণ করে হাজার হাজার আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীকে দুর্ভোগে ফেলা হয়েছে। তারা এজন্য বর্তমান জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমানকে দায়ী করেন।
আর জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্দেশে চট্টগ্রামের পরীর পাহাড়ে আদালত এলাকায় জেলা আইনজীবী সমিতিকে ১২ দশমিক ৯০ শতক জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। লিজপ্রাপ্তির ৪৪ বছর পরও সেই দলিল দেখিয়ে আইনজীবী সমিতি আজ পর্যন্ত তাদের নামে কোনো রেকর্ড বা খতিয়ান সৃষ্টি করেনি এবং ভূমির খাজনাও পরিশোধ করেনি। আইনজীবী সমিতি বরাদ্দের দশগুণ বেশি জমি দখলে নিয়েছে।