হাজতের পরোয়ানায় 'তলবমতে' : সমস্যা ও উত্তরণের উপায়
মো: সাইফুল ইসলাম পলাশ,অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।

হাজতের পরোয়ানায় ‘তলবমতে’ : সমস্যা ও উত্তরণের উপায়

১.

‘সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৫ মাস পরেও কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছে না, দায় কার?’ – একটি অনলাইন পত্রিকায় এমন একটা নিউজ পড়ে প্রথমে ভেবেছিলাম জরিমানার টাকা না দেওয়ায় হয়তো কয়েদি মুক্তি পাচ্ছে না। কিন্তু পড়ার পরে যা জানলাম তাতে রীতিমতো স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ হওয়ার মত অবস্থা। অথচ এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন অঙ্গনের অধিকাংশ মানুষের স্বচ্ছ ধারণা নেই।

নিউজের ঘটনাটা ২০১৯ সালের মার্চ মাসের। দণ্ডিত আসামি ১০ পিস ইয়াবাসহ পুলিশ কর্তৃক হাতে নাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। জামিন নেওয়ার পর আসামি পলাতক হলে তার অনুপস্থিতিতে বিচার সম্পন্ন হয়। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় বিজ্ঞ বিচারক তাকে ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ঘোষণা করেন।

রায়ের তিন বছর পরে পুলিশ আসামিকে ওয়ারেন্ট মূলে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেন। বিজ্ঞ বিচারক বেঞ্চ সহকারীর প্রস্তুতকৃত অন্তর্বর্তী হাজতের পরোয়ানায় (CW) স্বাক্ষর করে তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। তারপর থেকে ১১ মাস যাবৎ কারাগারে। সাজা ভোগ শেষেও কারাগার থেকে বের হতে পারছেন না। নিউজের মত এমন ঘটনা কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়, বরং ঘটছে অহরহ।

অথচ, সবই ঠিক ছিল। পুলিশ সাজাপ্রাপ্ত আসামী গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছে। বিচারকও তাকে সাজা ভোগের জন্য কারাগারে পাঠিয়েছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হয়েছে আসামীর অন্তর্বর্তী হাজতের পরোয়ানায় পরবর্তী তারিখের জায়গায় ‘তলবমতে’ শব্দটি লেখা হয়েছে।

২.

‘তলবমতে’ আসামী কি? সহজ কথায় যে বন্দীর পরোয়ানায় পরবর্তী তারিখের পরিবর্তে ‘তলবমতে’ লেখা হয় তাকে ‘তলবমতে’ (On Call) আসামী বলা হয়। অর্থাৎ উক্ত বন্দিকে শুধু আদালত থেকে পিডব্লিউ (Production Warrant) মূলে তলব করা হলেই তিনি আদালতে উপস্থিত হবেন। আদালত থেকে তলব না করা হলে তিনি কখনোই আদালতে আসবেন না। যে মামলায় পেশকার, জিআরওগণের কাছে নথি নেই বা মামলাটি ভিন্ন আদালতের বা ভিন্ন জেলার, সেই মামলার ধৃত আসামির অন্তর্বর্তী হাজতের পরোয়ানায় তারা ‘তলবমতে’ লিখে থাকেন।

সাধারণত দুই ধরনের গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠানো হয়। যথা- ১. সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং ২. বিচারাধীন আসামি।

সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি গ্রেফতার হলে সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে সাজা পরোয়ানাসহ কারাগারে পাঠানো হয় যেখানে আসামির দন্ড সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাবে লেখা থাকে। এখানে আসামিকে আদালতে উপস্থাপনের পরবর্তী তারিখ থাকে না।

অন্যদিকে, বিচারাধীন বন্দীর অন্তর্বর্তীকালীন হাজতের পরোয়ানায় নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া থাকে। সেই নির্দিষ্ট তারিখে কারা কর্তৃপক্ষ আসামিকে বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠায়। বিপত্তি শুরু হয় যখন এই পরোয়ানায় কোন তারিখ দেওয়া থাকে না, পরবর্তী তারিখের স্থলে ‘তলবমতে’ শব্দটি লেখা হয়।

আদালত খোলা থাকলে সমস্যা নেই। কিন্তু যখন ভিন্ন জেলার আসামী গ্রেফতার হন বা সরকারি ছুটির দিনে আসামি গ্রেফতার হন, তখন আসামিকে আর সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠানো যায় না। তাকে এখতিয়ার সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠানো হয়। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ছুটির দিনে একটি উপনথি বা খন্ড নথি খুলে নথি সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠিয়ে দেন এবং ওয়ারেন্টে মামলার তারিখ না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামির অন্তর্বর্তী হাজতের পরোয়ানায় ‘তলবমতে’ শব্দটি লিখে তাকে কারাগারে পাঠান।

এতে সংশ্লিষ্ট আদালতে খন্ড নথি পৌঁছালেও নির্দিষ্ট তারিখ না থাকায় আসামিকে আর বিচারিক আদালতে উপস্থাপন করা হয় না। যার তদবিরকারক আছে সেই আসামি আইনজীবীর মাধ্যমে তাকে তলব করে জামিন শুনানি করতে পারেন। কিন্তু যার তদবির কারক নেই তিনি পড়ে থাকেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।এমনকি বছরও অতিক্রান্ত হয়ে যায় এমন নজির আছে। সাজাপ্রাপ্ত আসামি সাজার সময় অতিক্রান্ত হলেও কারাগার থেকে বের হতে পারছে না। কারণ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সেই আসামির দণ্ডের কোন তথ্য নেই।

আবার, বিচারাধীন বন্দীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, আসামি কারাগারে ‘তলবমতে’ অবস্থায় আটক থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত হয়েছে হয়েছে, বিচারও শেষ হয়েছে। অথচ নথিতে সে পলাতক হয়ে আছে এবং কারাগারেই আটক আছেন।

আমরা জানি, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫৩ ধারানুসারে সমস্ত সাক্ষ্য আসামির উপস্থিতিতে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আসামি কারাগারে থাকাবস্থায় এভাবে তার অনুপস্থিতিতে বিচার করার মতো ন্যায়বিরুদ্ধতা আর কিছু নেই।

দ্যা নেলসন ম্যান্ডেলা রুলস এর রুল -৭ অনুসারে বৈধ হাজতের পরোয়ানা ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে কারাগার রিসিভ করবেন না। উক্ত রুলে প্রিজনার ফাইল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে বন্দির আগমন ও নির্গমনের দিন ও সময় এবং মুক্তি ও বদলির তারিখ সন্নিবেশ করতে বলা হয়েছে। সুতরাং তারিখবিহীন হাজতের পরোয়ানা বৈধ নয়।

৩.

অবলা কন্ঠ কড়া নাড়ে
তলবমতের পরোয়ানা
শুরু হলো বন্দীর
অনির্দিষ্টকালের ঠিকানা।

তাহলে একজন বন্দীকে এভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য কেন থাকতে হচ্ছে? বেঞ্চ সহকারী ও জিআরও দের ভুল ধারণা ও উদাসীনতার কারণে এমন হচ্ছে। অন্যদিকে, কারা কর্তৃপক্ষেরও দায় কম নয়। তারা এমন আসামীদের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আদালতে কোন তথ্য দেয় না। ফলে এই ‘তলবমতে’ পরোয়ানার দরুণ আসামীদের অচিন্তনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

আপনি ভাবছেন, এমন সংখ্যা তো কালে-ভদ্রে দু-একটা আসে। বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধির জন্য আমি একাধিক জেল সুপারের সাথে কথা বলেছি। তাদের দু’জন জানালেন তাদের কারাগারে ‘তলবমতে’ আসামি রয়েছে। সংখ্যাটা যথাক্রমে ৪২ ও ৪৪ জন। সত্যিই উদ্বেগের বিষয়।

এ বিষয় নিয়ে কোনো রায় ও আদেশ আছে কি না তা জানার চেষ্টা করলাম। যতদূর জানলাম, মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র এমন একটা বিষয়ে ২০০৫ সালে রিট পিটিশন করেছিলেন। সেই মামলায় দেখা যায়, আদালত কর্মচারী ও কারা কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে সাজা পরোয়ানা কারাগারে না পৌঁছানোয় অনেক বন্দী সাজা ভোগের পরেও কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। তখন মাননীয় হাইকোর্ট ASK Vs. Bangladesh and Others (Unreported Writ Petition no. 1987/2005) মামলায় Rule Nisi ইস্যু করেন। পাশাপাশি রেসপনডেন্ট পক্ষকে এ ধরনের বন্দির তালিকা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সেই মামলায় অনুরূপ বন্দীর তালিকা কর্তৃপক্ষ দিয়েছিলেন কি না জানা নেই। তবে বেসরকারি দাতা সংস্থা জিআইজেড এর তথ্যানুসারে ২০১০ সালে (মে-অক্টোবর,২০১০) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এমন বিচারাধীন তলব মতে আসামি ছিল ৫৬৫ জন, ২০০৯ সালে (১ জুলাই-৩ সেপ্টেম্বর) কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ২ ও ৩ এ ৪১২ জন এবং একই বছর (২৫ জানুয়ারি-১৭ ফেব্রুয়ারি) বগুড়ায় ৮৩ জন।

আরও জানলাম, জিআইজেড ও বাংলাদেশ সরকারের একটি যৌথ প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্ত প্যারালিগ্যালরা কারা অভ্যন্তরে ‘তলবমতে’ আসামি খুঁজে খুঁজে বের করে তলবমুক্ত করেন। কাউকে মামলার পরবর্তী তারিখ সংগ্রহ করে দেন এবং কাউকে আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি বা তাদের সংস্থার প্যানেল আইনজীবীদের মাধ্যমে আইনি সহায়তা প্রদান করেন। সংস্থাটির মাসিক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, গত ২০১৩ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ থেকে পর্যন্ত তারা মোট ৮১২০ জন ‘তলবমতে’ আসামী খুঁজে পেয়েছেন। এদের মধ্যে ৫৩২৪ জনের পরবর্তী তারিখের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

একবার এক স্টেশনে ৪৪ জন ‘তলবমতে’ আসামি পেলাম। বিষয়টি নিয়ে কাজ করার একমাস পর দেখা গেল এই সংখ্যাটা ১২ জনে নেমেছে। আদালত ভিত্তিক তালিকা নিলাম জেল সুপারের কাছে। প্রত্যেক আসামিকে তলব মুক্ত করার জন্য প্রত্যেক আদালতের সাথে যোগাযোগ করা হলো। কাজ করার পর বুঝলাম, এটি শুধু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নয়, অন্য আদালত বা ট্রাইব্যুনালের মামলার ক্ষেত্রেও আসামি/দেনদার/অভিভাবকহীন ভিকটিম এমন ‘তলবমতে’র শিকার হন। তবে এই অমানবিক বিপর্যয় রোধের জন্য শুধু বন্দীদের মাঝে খুঁজে খুঁজে তলব মুক্ত করাই যথেষ্ট নয়।

৪.

তাহলে সমাধানের পথ কি? ‘তলবমতে’ লেখনীর উৎস মুখ বন্ধ না করলে এটা প্রতিরোধ সম্ভব নয়। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে এই সংকট উত্তরণ করা যায় –

ক. কোনো অবস্থাতেই একজন বিচারক তারিখবিহীন অন্তর্বর্তীকালীন হাজতের পরোয়ানায় স্বাক্ষর করবেন না। যদি কখনো তলবমতের আসামি পাওয়া যায় তবে তাকে পিডব্লিউ মূলে তলব করে এনে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিচারাধীন মামলার আসামিকে নির্দিষ্ট তারিখ এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করে তলবমুক্ত করতে হবে।

খ. ছুটির দিনে ভিন্ন আদালতের বা ভিন্ন জেলার আসামি গ্রেফতার হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট একটি যৌক্তিক তারিখ নির্ধারণ করে (দূরবর্তী জেলার ক্ষেত্রে অনধিক ১৫ দিন) আসামিকে কারাগারে পাঠাবেন এবং সংশ্লিষ্ট আদালতে আসামি উপস্থাপিত হলে মূল নথির সাথে খন্ড নথি সামিল করে পরবর্তী ধার্য তারিখ উক্ত পরোয়ানায় উল্লেখ করবেন।

গ. প্রতিটি পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্সে জেল সুপারের কাছে আদালত ভিত্তিক তলবমতে আসামীর তথ্য নিতে হবে। সেই তথ্য মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে কপি পাঠাতে হবে। কেননা জেলকোডের ২৫১ বিধি অনুসারে বন্দীদের আটক রাখার ওয়ারেন্ট সংরক্ষণের জন্য জেলার দায়ী থাকেন। সাজাপ্রাপ্ত বন্দীর মুক্তির তারিখ সঠিকভাবে রিলিজ ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা হয় কি না তা তিনি পরীক্ষা করে দেখেন। উক্ত বিধিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি বন্দিদের মুক্তির বিষয়টি এমন নিখুঁতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন যেন কোন বন্দী অতিরিক্ত সময়ের জন্য আটক না থাকে। ফলে কোনো বন্দি নির্ধারিত সাজার অতিরিক্ত সময় হাজতে থাকলে তার দায়ভার জেলারকেও বহন করতে হবে।

ঘ. সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামির ওয়ারেন্টে আবশ্যিকভাবে লাল কালিতে সাজার পরিমাণ লিখতে হবে যেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট এর বেঞ্চ সহকারী/ জিআরও এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং দ্রুততার সাথে খন্ড নথি সংশ্লিষ্ট আদালতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠাতে পারেন।

ঙ. গ্রেফতারি পরোয়ানার মতো অন্তর্বর্তী হাজতের পরোয়ানায় বিচারকের স্বাক্ষরের পাশাপাশি প্রস্তুতকারী জিআরও/বেঞ্চ সহকারীর স্বাক্ষর থাকতে হবে। এতে প্রস্তুতকারীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি এক আসামির পরিবর্তে আরেক আসামির হাজতবাসের মতো আয়নাবাজিগুলো কমে আসবে।

চ. কারাবন্দিদের তথ্যাবলী ডিজিটালাইজড করতে হবে। কারাগারে থাকা বন্দির মামলার নম্বর, অপরাধের ধরন, দণ্ডের বিবরণ, কারাগারে আগমন ও নির্গমনের তারিখ, মামলার সংখ্যা, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, একজন নিকটাত্মীয়ের মোবাইল নম্বরসহ নাম-ঠিকানা ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্যাদি এতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কোনো আসামি একদিনের জন্য কারাগারে গেলে বা জামিনপ্রাপ্ত হলে সেটি ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হবে। এই ডাটাবেজে আবশ্যিকভাবে আদালতের অ্যাক্সেস থাকতে হবে। বিচারক যেন এক ক্লিকেই বুঝতে পারেন তার আদালতের কতজন বন্দী কি অবস্থায় আছে।

ছ. কারাগারে প্রাথমিক ভর্তির সময় বন্দীর বিস্তারিত তথ্যসহ সাক্ষাৎকারের নিয়মাবলী সম্বলিত চিঠি/এসএমএস বন্দীদের পরিবারের কাছে পাঠাতে হবে। অল ইন্ডিয়া কমিটি অন জেল রিফর্ম (১৯৮০-৮৩) কারা সংস্কারের ব্যাপারে কিছু সুপারিশ করেছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কারাগারে প্রাথমিক ভর্তির সময় বা অন্য কারাগারে স্থানান্তর করার সময় সেই বন্দীর পরিচয়, সাক্ষাৎকারের নিয়ম, ডাক/মেইল সুবিধা ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত একটি প্রিন্ট করা কার্ড বন্দীদের পরিবারের কাছে পাঠাতে হবে। একই রকম অধিকার ম্যান্ডেলা রুলসেও স্বীকৃত হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এটা অনুসরণ করা হয়। আমাদের দেশেও এটি চালু করতে হবে যেন বন্দীর পরিবার এ বিষয়ে অবগত হওয়ার পর আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

জ. বাংলাদেশ কারা সংস্কার কমিশন, ১৯৮০ এর চেয়ারম্যান মাননীয় বিচারপতি এফ. কে. এম. এ মুনিম মহোদয়ের একটি সুপারিশ আজও প্রাসঙ্গিক মনে হলো। তিনি লিখেছিলেন, কোন ব্যক্তিকে বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখা উচিৎ নয়। বিচার শুরু হোক বা না হোক, প্রত্যেক প্রি-ট্রায়াল বন্দীকে অবশ্যই ১৫ দিনের ব্যবধানে আইনের প্রয়োজন অনুসারে আদালতে হাজির করতে হবে।

ঝ. আদালতের প্রত্যেক বেঞ্চ সহকারী, জিআরও এবং কারা কর্মচারীদের এরূপ বাস্তব সমস্যার আলোকে মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

ঞ. আমাদের বিচার ব্যবস্থায় প্যারালিগ্যাল সার্ভিসকে স্থায়ী রূপ দিতে হবে। পাশাপাশি প্রত্যেক কারাগারে সমাজকল্যাণ অফিসার নিয়োগ দিতে হবে।

ট. কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ‘তলবমতে’ শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে একটি সার্কুলার ইস্যু করতে পারেন।

৫.

একজন বন্দি যত বড় অপরাধী হোক না কেন তার সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একদিনও অতিরিক্ত সময় কারাবন্দি করে রাখা বা বিচারাধীন বন্দিকে তারিখবিহীন করে রাখার সুযোগ নেই। এটি আমাদের পবিত্র সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। পরোয়ানায় ‘তলবমতে’ লেখা একজন বন্দির Double Victimization এর নামান্তর। অথচ সংশ্লিষ্টদের একটু আন্তরিকতা ও সচেতনতা হাজারো বন্দীকে এরূপ ন্যায়বিরুদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। স্বস্তির খবর হচ্ছে, লেখার শুরুতে দণ্ডিত আসামি পরবর্তীতে বিচারকের আদেশমূলে অনির্ধারিত বন্দীত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ০৫ মাস ফিরিয়ে দেওয়া যাবে কী?

লেখক -মো: সাইফুল ইসলাম পলাশ, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।