প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান তালুকদারের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আগামী রোববার (১৬ জুলাই)। ২০০৮ সালের ১৬ জুলাই এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান তালুকদার স্মৃতি সংসদ -এর উদ্যোগে এদিন তাঁর নিজ গ্রামের বাড়িতে মরহুমের কবরে শ্রদ্ধা, কবর জিয়ারত, কুরআন খতম, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং এতিম শিশু ও অসহায় দুঃস্থ মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণ করা হবে।
মরহুমের জ্যেষ্ঠপুত্র সেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদার এবং কনিষ্ঠপুত্র সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান (এমপি) বিভিন্ন কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকবেন।
মতিয়ার রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী
জামালপুরের এই কীর্তিমান পুরুষ, ব্রিটিশ-ভারতের পূর্ববঙ্গ প্রদেশের ময়মনসিংহ জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৪ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। আওনা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী তালুকদার পরিবারের সন্তান মতিয়র রহমান শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। যে গ্রামের আলো-বাতাসে ছোট্ট মতিয়র রহমান বেড়ে উঠেছিলেন সেই গ্রামেই ঘুমিয়ে আছেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান।
বর্তমান জামালপুর জেলার দক্ষিণে সরিষাবাড়ী উপজেলার যমুনা নদীর কুল ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছায়াঘেরা দৌলতপুর গ্রাম আজ গর্বিত এই ক্ষণজন্মা মনীষীকে ধারণ করে আছে বলে। শিশু মতিয়র রহমান প্রাইমারি স্কুলের বারান্দা থেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দেখে দেখে বিপ্লবী সত্তায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর অভিঘাত এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগ আন্দোলন দ্বারা মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র মতিয়র রহমান প্রভাবিত হয়েছিলেন।
বাড়ির পাশে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর উত্তাল রূপ, গ্রামের চিরায়ত সবুজের উদারতা আর প্রকৃতির বৈরী পরিবেশ থেকে সাহস আর শক্তি নিয়ে মতিয়র রহমান কলেজ জীবনে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নানা বাঁক প্রত্যক্ষ করেন। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ‘যুক্তফ্রন্ট’ নির্বাচন এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অসহযোগিতা মতিয়র রহমানকে আন্দোলিত করেছিল।
কলেজ জীবনে মেধাবী ছাত্র মতিয়র রহমান ১৯৫৬ থেকে ’৫৯ সাল পর্যন্ত সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে থাকে।
সামরিক শাসনের সেই উত্তাল সময়ে মতিয়র রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই মতিয়র রহমান বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন এবং এ বছরই কৃতিত্বের সঙ্গে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
অর্থ ও বিত্ত-বৈভবের মধ্যে বেড়ে ওঠা মতিয়র রহমান তালুকদার জামালপুরের দরিদ্র, অসহায় মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়ার ইচ্ছা নিয়ে আইনজীবীকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করার পর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে।
১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রহসনের বিচার শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ফুঁসে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ১৯৬৯ সালে দেশব্যাপী গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে জামালপুরের সাধারণ মানুষও সে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে।
এ সময় অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার আইন পেশা স্থগিত রেখে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’-এর আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার পরও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার জামালপুরে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পুর্নগঠনে তিনি জামালপুরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।
দেশব্যাপী রাজনৈতিক দমন-পীড়ন শুরু হলে অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদারকে কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁর ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে সরে যেতে নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অজেয় শক্তি ধারণ করেছিলেন বলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। দুর্বার সাহস আর আওয়ামী লীগের দীক্ষা নিয়ে এগিয়ে যান অবিচল।
অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সততা আর অটল নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের আদর্শ বহন করে গেছেন আজীবন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্ণাঢ্য জীবনে জামালপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন ছয়বার এবং জাতীয় আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জামালপুর ল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। দুস্থ অসহায় মানুষকে সেবা দিতে জামালপুর অন্ধকল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠা এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি জামালপুরের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।