মো. ফিরোজ উদ্দিন: মানবাধিকার হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার যা ছাড়া মানবজীবন অপরিপূর্ণ। মানুষ চাইলেই তার মানবাধিকার ত্যাগ করতে পারেনা। মানবাধিকারের কোন সীমারেখা নেই, মানবাধিকার সবখানে সমান। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ এবং প্রতিবন্ধীতা-অপ্রতিবন্ধীতা ভেদে মানবাধিকার ভোগে কোনরূপ বাধা আরোপ করা হয়না বা স্বীকৃত না।
মানবাধিকার রক্ষার প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের। মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন হল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। মানবাধিকার, সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষায় মানবাধিকার কমিশন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করে।
যেসব কারণে অভিযোগ দায়ের করা যায়
কোন ব্যক্তির মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে অথবা লঙ্ঘনের আশঙ্কা দেখা দিলে প্রতিকারের জন্য মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা যায়। একজন ব্যক্তি তার অধিকার রক্ষায় এবং অধিকার লঙ্ঘিত হলে তার প্রতিকারের জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নিকট নিম্নলিখিত কারনে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন যথাঃ
(ক) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের দ্বিতীয় ও তৃতীয়ভাগে বর্ণিত অধিকারের লঙ্ঘন হলে বা লঙ্ঘনের আশংকা তৈরি হলে;
(খ) স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বর্ণিত অধিকারসমূহ লঙ্ঘিত হলে;
(গ) যদি রাষ্ট্রীয় বাসরকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বা কোন জনসেবক কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে বা লংঙ্ঘনের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে বা এই সব লংঙ্ঘন প্রতিরোধে অবহেলা করা হয়েছে সেক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ব্যক্তি নিজে অথবা ব্যক্তির মা-বাবা, বৈধ বা আইনানুগ অভিভাবক অথবা কোন সংগঠন মানবাধিকার কমিশনের নিকট অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তবে অবস্থা বিবেচনায় কমিশন স্বউদ্যোগেও অভিযোগ গ্রহণ করতে পারেন।
অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি
তবে এক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্ধারিত ফরমে অথবা কম্পিউটার কম্পোজ করে অথবা সাদা কাগজে হাতে লিখে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। অভিযোগপত্রটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অফিসে নিজে অথবা মা-বাবার মাধ্যমে অথবা বৈধ বা আইনানুগ অভিভাবকের মাধ্যমে অথবা ডাক মারফত, ফ্যাক্স অথবা ই-মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ পাঠানো যায়। অভিযোগপত্রের সাথে প্রয়োজনীয়কাগজপত্র, ছবি, অডিও, ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদি সংযুক্ত করা যেতে পারে।
অভিযোগ যাচাই-বাছাই
অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘন্টার মধ্যে কমিশনের বাছাই সেল অভিযোগটির আইনগত দিক পরীক্ষা করে দেখবেন। বাছাই সেল যদি দেখে অভিযোগটি কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে তাহলে অভিযোগকারীর কী উচিৎ, সে বিষয়ে পরামর্শসহ ৭ (সাত) দিনের মধ্যে অভিযোগটি অভিযোগকারীর ঠিকানায় লিখিত উত্তর পাঠাবেন।
তদন্ত বা অনুসন্ধান
অভিযোগটি কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে হলে কমিশন অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক তদন্ত বা অনুসন্ধানকালে কমিশনের দেওয়ানী আদালতের অনুরুপ ক্ষমতা থাকবে। অভিযোগের তদন্তকালে কমিশন সরকারের কাছে বা সরকারে অধীন কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার নিকট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তথ্য চাইতে পারে। সরকারের নিকট থেকে কমিশন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তথ্য না পেলে কমিশন নিজে তদন্ত করতে পারে। আর যদি কমিশন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারের নিকট থেকে তথ্য পেয়ে সন্তুষ্ট হন বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকার বা কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিলে কমিশন তদন্ত বা অনুন্ধান করবেনা।
আবার শৃঙ্খলাবাহিনীর বা তার কোন সদস্যের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের ক্ষেত্রে কমিশন নিজ উদ্যোগে কোন আবেদনের ভিত্তিতে সরকারের কাছে তথ্য চাইতে পারে। তথ্য পাওয়া পর কমিশন সন্তুষ্ট হলে অভিযোগের বিষয়ে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করবে না। কিন্তু যদি কমিশন মনে করে এ বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন তাহলে আদালত সরকারকে পরামর্শ দিবেন। কমিশন থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত হলে সরকার ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখিতভাবে কমিশনকে অভিহিত করবেন। কমিশন সরকারের কাছ থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রতিবেদনের একটি কপি অভিযোগকারীর বা অভিযোগকারীর প্রতিনিধির নিকট প্রেরণ করবেন।
অভিযোগ নিষ্পত্তি
তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে কমিশন অভিযোগটি নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতা বা সমঝোতাকারীর নিকট প্রেরণ করবেন। অভিযোগ পাওয়ার পর কমিশনের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় মধ্যস্থতা বা সমঝোতার মাধ্যমে অভিযোগের নিষ্পত্তি সম্ভব তাহলে মধ্যস্থতাকারী বা সমঝোতাকারী বিষয়টি কমিশনকে অবহিত করবে। কমিশন মধ্যস্থতা বা সমঝোতা কার্যকর করার জন্য জরিমানা আরোপসহ অন্যান্য নির্দেশ দিতে পারে।
সমঝোতার মাধ্যমে অভিযোগের নিষ্পত্তি সম্ভব না হলে কমিশন অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সরকারের নিকট সুপারিশ করতে পারে। সেইসাথে কোন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তা সুপারিশে উল্লেখ করবে। অভিযোগটি সংবিধানের ১০২ অনুসারে রীটযোগ্য হলে কমিশন সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্টে আবেদনের ব্যবস্থা করবেন বা প্রয়োজনে কমিশন নিজে হাইকোর্টে আবেদন করবেন।
যেসব বিষয়ে কমিশনের আইনগত কার্যক্রম প্রয়োগের সুযোগ নেই
তবে নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠানের বিষয়গুলো মানবাধিকার কমিশনের কার্যবলি বা দায়িত্বের বাহিরে থাকবে যেখানে কমিশনের আইনগত কার্যক্রম প্রয়োগের সুযোগ নেই যথাঃ
(ক) আদালতের বিচারাধীন মামলার কোন বিষয়;
(খ) ন্যায়পাল আইন, ১৯৮০ এর অধীন ন্যায়পাল কর্তৃক বিবেচ্য কোন বিষয়;
(গ) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সরকারী কর্মচারী এবং সংবিধিব্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের কর্মে নিযুক্ত কর্মচারী সংক্রান্ত এমন কোন বিষয় যা Administrative Tribunals Act,1980 (XVI of 1981) এর অধীন স্থাপিত ট্রাইব্যুনালে বিচারযোগ্য বিষয়।
লেখক: লেজিসলেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট, আইন শাখা-১, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়। ই-মেইল: firojlawru@gmail.com