চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন নামঞ্জুর হওয়া আসামিদের আইন ভঙ্গ করে আদেশে মিথ্যা তথ্য লিখে একই দিনে জামিন দেওয়ার ঘটনায় কক্সবাজারের জেলা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈলকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেছেন, আপনার সেরেস্তা থেকে দুই নম্বরি নকল বের হয়, এর দায় আপনাকেই নিতে হবে। আপনি যা করছেন তাতে মনে হয় বদনাম নিয়েই আপনাকে বিদায় নিতে হবে।
আজ বুধবার (১৯ জুলাই) বিচারপতি মো. হাবিবুল গনি ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
আদালতে জেলা জজের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা, অ্যাডভোকেট আব্দুন নূর দুলাল। অপরপক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন, অ্যাডভোকেট এস এম আমজাদুল হক, অ্যাডভোকেট সাকিল আহমাদ।
শুনানিতে যা হল
শুনানির শুরুতে কক্সবাজারের জেলা জজের উদ্দেশে আদালত বলেন, মিস্টার ইসমাঈল আপনি ডায়াসের সামনে এসে দাঁড়ান। এসময় কক্সবাজারের জেলা জজের পক্ষে আদালত কক্ষে দাঁড়ান ৩০ জনের মতো আইনজীবী।
তখন কেবল একজন আইনজীবীকে শুনানি করতে বলেন হাইকোর্ট। সেসময় অন্য সব আইনজীবীকে বসিয়ে দেওয়া হয়। কক্সবাজারের জেলা জজের পক্ষে শুনানি করতে থাকেন অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা।
এরপর লিখিত ব্যাখ্যা পড়তে থাকেন জেলা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল। লিখিত ব্যাখ্যায় তিনি নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন।
এসময় হাইকোর্ট বলেন, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, আপনি যা করেছেন সঠিক করেছেন? আপনি তো নিজেকে ডিফেন্ড করছেন।
আরও পড়ুন : হাইকোর্টে কক্সবাজার জেলা জজের ক্ষমা প্রার্থনা
আদালত বলেন, আপনি জুডিশিয়াল আদালতের আদেশের প্রতি সম্মান দেখাননি। কোনো প্রসিডিং ফলো করেননি। নিজের ইচ্ছেমতো জামিন দিয়েছেন। আপনি তো নিজেও একসময় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। আপনি এখন জেলার সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিচারক। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আদেশের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। তা না হলে বিচার বিভাগে অব্যবস্থাপনা শুরু হবে।
আদালত আরও বলেন, আপনি এর আগেও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কয়েকজনকে জামিন দিয়েছেন। সেই খবর আমাদের কানে এসেছে।
তখন জেলা জজ বলেন, তিন বছরে মাত্র চারজনকে এভাবে জামিন দিয়েছি। অনেক সময় আইনজীবী নেতারা এসে চাপ সৃষ্টি করেন। তখন শুনতে হয়।
এসময় আদালত বলেন, আপনি কি তাদের চাকরি করেন, নাকি সরকারের চাকরি করেন? তখন জেলা জজ নিশ্চুপ থাকেন।
আদালত বলেন, কে চেয়ারম্যান, কে আইনজীবী নেতা তাদের দিকে তাকিয়ে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাউকে জামিন দিতে পারেন না। এভাবে বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করবেন না। আপনি এ ধরনের কাজ করতে থাকলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা তো কাজ করতে পারবে না। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে জুডিশিয়ারিকে ভয় পেয়ে চলতে হবে।
তখন জেলা জজ বলেন, নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছি। কিছুদিন পরেই অবসরে যাব, সম্মানজনকভাবে বিদায় নিতে চাই।
তখন আদালত বলেন, আপনি তো সম্মানজনক বিদায় চান না। আপনার কাজ কর্মে তা মনে হয় না। বিদায় নেওয়ার সময় কী বার্তা দিয়ে যাবেন? মনে হচ্ছে আপনাকে বদনাম নিয়েই বিদায় নিতে হবে।
তখন জেলা জজ বলেন, ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কাজ করব না।
আদালত বলেন, আপনি যা করছেন তাতে বদনাম নিয়েই আপনাকে বিদায় নিতে হবে।
এসময় জেলা জজের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, আমাদের কোনো জবাব নেই। আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছি।
আদালত জেলা জজের উদ্দেশে বলেন, আপনার সেরেস্তা থেকে নকল বের হয়। এটা কি আপনার ব্যর্থতা নয়? আপনার সেরেস্তা থেকে এ আদেশ সরবরাহ করা হয়েছে। দুর্নীতি-অরাজকতা কোথাও বাসা বাধলে সেখানে কোনো ব্যবস্থাপনা থাকে না। এটা সবাই জানে।
এরপর আদালত তার ব্যাখ্যা গ্রহণ না করে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামীকাল দিন ধার্য করেন।
হাজতে না গেলেও হাজতবাসের বিবরণ উল্লেখ করে এক মামলায় নয় আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হাইকোর্টে হাজির হয়েছিলেন কক্সবাজারের জেলা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল।
এর আগে গত ২১ জুন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন নামঞ্জুর হওয়া আসামিদের আইন ভঙ্গ করে আদেশে মিথ্যা তথ্য লিখে একই দিনে জামিন দেওয়ার ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজকে তলব করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. হাবিবুল গনি ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
জমি দখল নিয়ে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভয়ভীতি প্রদর্শন ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগে মিঠাছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ ভুট্টোসহ নয়জনের বিরুদ্ধে একই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান খোদেস্তা বেগম রিনা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত–১ ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী দ্রুত বিচার আদালতে নালিশি মামলা করেন।
এ মামলায় আসামিরা হাইকোর্টে আগাম জামিন চাইলে হাইকোর্ট ১১ এপ্রিল তাদের ছয় সপ্তাহের জামিন দিয়ে কক্সবাজারের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের সেই আদেশ মোতাবেক গত ২১ মে আসামিরা আত্মসমর্পণ করে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে জামিন চান।
আদালত ৯ আসামির জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু একই দিন আসামিরা কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। তখন জেলা ও দায়রা জজ তাদেরকে জামিন দেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন রিনা।
জানা গেছে, ২১ মে দুপুর ১২টার দিকে ৯ আসামি চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করেন। এর আগেই চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আদেশের কপি পাননি উল্লেখ করে সকাল ১০টার দিকে আদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা জামিনের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হলফনামাসহ আবেদন করেন।
এ ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জামিন নামঞ্জুরের আদেশসহ অন্য কাগজপত্রের প্রত্যায়িত অনুলিপি বা প্রত্যায়িত অনুলিপির ফটোকপি দাখিল করা হয়নি। আসামির হাজতবাসের মেয়াদসহ সার্বিক বিবেচনায় তাদের জামিন মঞ্জুর করা হয়—আদেশে উল্লেখ করেছেন জেলা জজ।
অথচ ৯ আসামি একমুহূর্তও হাজতে ছিলেন না। শুনানিতে বিষয়গুলো তুলে ধরা হলে জেলা ও দায়রা জজ আসামিদের কীভাবে জামিন দিলেন—এ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানাতে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। মামলার যাবতীয় নথি নিয়ে আসতে বলেন আদালত।