(১)
আদনান রায়হান মোহাম্মদ আমীম সংক্ষেপে এ আর মোঃ আমীম। এটা বিচারকের নাম। মফিজ মিয়া ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। তাই নামটা ঠিক ঠাক পড়ার পরে সে ভাবতে বসে এত বড় নাম রাখার কি হইলো? বাপ-মা ছোট নাম রাখতে পারে নাই? কোর্টের সামনে ইয়া বড় সাইনবোর্ডে নাম লেখা। ঢুকতেই চোখে পড়ে। উনার হাতে বিচারের ভার এই আদালতের মামলার। কিন্তু নাম পড়েই বুকটা ধক করে উঠে। নাম যদি এত বড় হয় তাহলে মানুষ কেমন? নিশ্চয়ই বড় সড় ধরণের মানুষ। নাম পড়েই মনে হবে এজলাসে খুব গম্ভীর এবং বিরক্ত একজন মানুষ বসে আছে। আর সবাইকে ধরে ধরে ফাঁসি দিচ্ছে। ফাঁসি দেওয়ার কথা মাথায় আসতেই মফিজ মিয়ার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সে ভাবে এই বার যদি ফাঁসিটা হয়! আস্তে আস্তে সে এজলাসে ঢুকে পড়ে।
(২)
এই এজলাসে ঢুকতে মফিজ মিয়ার বড় বিরক্ত লাগে। গত পনেরটা বছর ধরে সে ন্যায়বিচারের আশায় এই আদালত সে আদালতে ঘুরছে। কয়েক বছর পর পর খালি বিচারক পাল্টায়। বাহারী নামের ধামের বিচারক আদালতে আসে। আবার চলে যায়। এত এত মামলার বিচার করে। কিন্তু, তার মামলার বিচারটা হয় না। বিচারক পালটে গেলে সে আবার অপেক্ষা করে কখন নতুন বিচারক আসবে। আর ওর মামলাটার বিচার করবে। কিন্তু অপেক্ষাই সার হয় মফিজ মিয়ার। বিচার আর হয়না। পনেরটা বছর ধরে আদালতে আসতে আসতে মফিজ মিয়া ক্লান্ত। তারা যেখানে থাকে সেখান থেকে আসাটা খুব কষ্ট।
এজলাসের একদম পেছনে ফ্লোরে বসতে বসতে মফিজ মিয়ার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কিন্তু বুক থাকলে তো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবে? মফিজ বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে বুকটা চিরে আছে। ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে। একদম তাজা তাজা রক্ত। মফিজ মিয়ার পাশে বসে আছে জরিনা খাতুন। ইয়া লম্বা ঘোমটা দিয়ে আছে। মফিজের ভাবনা এবং অস্বস্তি টের পেয়ে সে বলে- মিনসের মরণ হয় না কেন? কোর্টে এসেও হাপিত্যেশ করার অভ্যাস গেলো না! খালি বাজে কথা কও? আর রক্ত পড়বে কেন? বুকে গামছা দাও। বলে সে মফিজ মিয়ার গামছা বুকের দিকে ঠেলে দিতে যায়। দুজনেই বিষ্ময়ের সাথে চেয়ে দেখে গামছা থেকেও ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। একদম তাজা রক্ত।
(৩)
খাস কামরায় বিচারক আমীম বসে আছেন। তিনি এই জেলায় নতুন এসেছেন। পদবীতে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ। আজকেই জয়েন করেছেন। সকালেই জেলার জেলা ও দায়রা জজের সাথে দেখা করে যোগদান করেছেন। মাত্রই চেম্বারে এসে বসলেন। এর আগে আরো দুইটি জেলায় একই পদে কাজ করেছেন। নতুন জেলা তার ভালো লাগে। এই বাংলাদেশ কত সুন্দর তা দেশের মাটি এবং মানুষ না দেখলে বোঝা যাবে না। প্রত্যেকটি জেলার মানুষের এবং মাটির আলাদা সৌন্দর্য, গন্ধ আছে। নতুন জেলায় গিয়ে তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরতে বের হন। একসাথে দুটো কাজ হয়। মানুষ দেখা হয় এবং জায়গাগুলোর নামের সাথে পরিচয় হয়ে যায়। মামলার বিচার করতে গেলে বা সাক্ষী নিতে গেলে এটা কাজে লাগে। সদাশয় কর্তৃপক্ষের দয়ায় তিনি ২০ বছরের চাকুরি জীবনে ১৪টা জেলা দেখার সুযোগ পেয়েছেন।
চা খেতে খেতে তিনি পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নেন। এটা তার অনেক পুরোন অভ্যাস। একটা স্থানীয় পত্রিকা পড়ছেন। সেটার ভেতরের পাতায় একটা খবর। হেডলাইন- “১৫ বছরেও বিচার হয়নি সুন্দরপুরের ট্রিপল মার্ডার কেসের”। পড়তে পড়তে তাঁর মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ধুর! আবার একই ঝামেলা! এসব পড়ে কি হবে? তার বিরক্ত এবং ক্লান্ত লাগে। এখনো পরিবার তার পরিবার আসেনি। উঠেছেন রেস্ট হাউজে। বাচ্চাদের জন্য খুব খারাপ লাগে। বাচ্চারা এমন ন্যাওটা হয়েছে! দুপাশ থেকে বাপকে জড়িয়ে না ধরলে নাকি ঘুম আসে না! অবশ্য তারও কি ঘুম আসে? গাউন পরতে পরতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদনান এজলাসের দিকে পা বাড়ান। আদালতের অফিস সহকারী উচ্চ স্বরে ডাক দেন,“ আদালত আসছেন”।
(৪)
যে কোন জেলায় প্রথম কোর্ট করার সময় আমীমের পেটে সুড়সুড়ির অনুভূতি হয়। প্রজাপতির নাচন অনুভব করেন। এত বছরের বিচারিক ক্যারিয়ার! তবুও যে কোন জেলায় প্রথম কোর্ট করার সময় মনে হয় আজকেই প্রথম আদালতে বিচারিক কাজ শুরু করছেন। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলেও আমীম এটা উপভোগ করেন। অনুভূতি হারিয়ে যেতে যেতে অন্ততঃ একটা অনুভূতি জেগে আছে। এই বা খারাপ কিসে? পিয়নের হাঁকের সাথে সাথে এজলাসে উঠেন আমীম। আদালতের সকলে দাঁড়িয়ে আদালতকে সম্মান দেখায়। সবার চোখে মুখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। নতুন জজ সাহেবকে যেন একপলকেই পড়ে নিতে চাইছেন। হাজার হলেও আগামী কয়েক বছর উনার কাছেই বিচার চাইতে হবে। সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির মধ্যেই তিনি কথা বলতে শুরু করেন। চাকুরি জীবনের শুরু থেকেই তিনি প্রথমেই এজলাসে তার কাজ করার ধরণ সম্পর্কে সবাইকে ধারণা দেন যাতে কোন ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে।
তিনি কথা বলা শেষ করার পরে আদালতের বেঞ্চ সহকারী মামলা ডাকতে থাকেন। সব মামলা ডেকে ফেলার পরও আমীমের মনে হয় একটা মামলা ডাকা হয়নি। তিনি পেশকারকে ডেকে বলেন- আর মামলা নাই? পেশকার উত্তর দেয়- না স্যার। আমীম জিজ্ঞাসা করে, “ট্রিপল মার্ডার কেসটা কই?” পেশকার শামসুদ্দীন শক খাওয়ার মতো আমীমের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভাবেন স্যারে জানলো কেমনে? আমীম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন- আজকে পেপারে পড়লাম, এই কোর্টে আজকে একটা ট্রিপল মার্ডার কেস আছে। নথি বের করেন। আমি আসছি। দশ মিনিটের একটা ব্রেক দিয়ে আদালত থেকে আমীম নেমে পড়েন।
(৫)
মফিজ মিয়া খালি উসখুশ করে। তার বিড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, জরিনার জন্য যাওয়ার উপায় নাই। যে দিন কোর্টে আসতে হয় সেদিন জরিনা যেন কেমন হয়ে যায়। উদভ্রান্ত, পাগলের মতো। চোখগুলো লাল হয়ে যায়। মনে হয় যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। মফিজ মিয়ার বড় ভয় লাগে। এই জরিনাকে সে চেনে না। কি আত্মবিশ্বাস মেয়েটার! বলে- সে একদিন বিচার পাবে। মফিজ মিয়া বুঝতে পারে না, যে বিচার ১৫ বছরে হয়নি, সে বিচার কখন হবে? তার আদালতে আসতে ইচ্ছে হয়না। কিন্তু জরিনার মুখের দিকে চেয়ে সে ভয়ে কিছু বলতে পারে না। সে-ই সকাল থেকে বসে আছে। কিন্তু, ওর মামলা আর ডাকেনা।
মফিজ মিয়া জানে- কেন ওর মামলা ডাকেনা। গত দশ বছর ধরে সে এটাই দেখে আসছে। আজকেও আদালতে জরিনার বাপ, ভাই, চাচাকে দেখেছে। আদালতের পিপি হাশিম মিয়ার জুনিয়রের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। পেশকারের সাথেও ওদের দহরম মহরম সম্পর্ক। মফিজ মিয়া জানে টাকার অনেক জোর। টাকা দিয়ে সব কেনা যায়। ওদেরকে দেখলেই মফিজ মিয়া ভয় করে। বুক চিরে রক্ত বেরিয়ে আসে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। এই রক্ত বন্ধ করার উপায় মফিজ মিয়ার জানা নেই।
বিকালের দিকে জজ সাব নেমে যায়। কিন্তু, ওদের মামলা ডাকেনি। জরিনার উত্তেজিত চোখ আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসে। মফিজকে বলে-চলো। আজকেও মনে হয় মামলা ডাকবেনা। জরিনার কথা শুনে মফিজ মিয়ার চোখ জ্বালা করে উঠে। বুকের মধ্যে মোচড় দেয়। এইতো তার জরিনা। তার বাচ্চার মা জরিনা। তার ভালোবাসার জরিনা। কিন্তু, জরিনার পেট ছেঁড়া,কাটা কেন? পেটের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট কচি কচি হাত দেখা যায় মনে হয়! মফিজ চোখ বন্ধ করে ফেলে। বলে- বউ, আরেকটু বস। জজ সাব মনে হয় চা খাইতে নামছে। আবার উঠবে বলছে। আমাদের মামলা ডাকতেও পারে। জরিনা বিচারক বিহীন আদালতের চেয়ারের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে। এই চেয়ার কত কিছুর সাক্ষী! এই চেয়ারের মানুষ কি ন্যায় বিচার করবে?
(৬)
এডভোকেট ইয়াহিয়া খান চেম্বারে বসে আছেন। বিকাল ৪-৩০ বাজে। চেয়ারে বসে হালকা ঝিমুনি আসছিলো। সারাদিন খুব পরিশ্রম গিয়েছে। এই কোর্ট সেই কোর্ট দৌড়াদৌড়ি। কত কাজ! এই সময় মোবাইলের রিং টোন বেজে ওঠে। একেবারে হিন্দী ছাঁইয়া ছাঁইয়া খানের সুর বেজে উঠেছে। কতবার যে হারামজাদা মুহুরী বদুকে বলেছেন রিং টোনটা বদলে দিতে! খান সাব বিরক্ত হন। আধ বোঝা চোখ খুলে দেখেন অতিরিক্ত কোর্টের পেশকার শামসুদ্দীন। মনে হয় কোন খবর দেবে। না হয় ঠিক মতো বখশিশ পায়নি। এজন্য ফোন দিচ্ছে। খান সাবের একটু প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। কাঁচা ঘুম নষ্ট করে দিলো। হ্যালো বলতেই শামসুদ্দীনের উত্তেজিত গলা ভেসে আসে। স্যার, তাড়াতাড়ি আসেন। আপনার মামলা ধরছে। কোন মামলা? বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসে-ট্রিপল মার্ডার। খান সাবের একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে। লক্ষণ সুবিধার নয় নতুন জজ সাবের। প্রথম দিন এসেই জেলার সবচেয়ে ঝামেলার মামলা ধরেছে! যেন তেন মামলা নয়। ইয়াহিয়া খানের মামলা! আসছি বলে কোট পরে গাউন চাপিয়ে আদালতের দিকে ছোটেন। মুহুরীকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেন আসামীরা কোথায়? মুহুরী উত্তর দেয়- তারাতো বাস স্ট্যান্ডে। পেশকার বললো- মামলা ধরবে না। বিশ্রী গালি দিয়ে গিয়ে শেষ মুহুর্তে আটকে খান সাব বলেন- বাস থেকে নেমে কোর্টে আসতে বল। পেশকার আজকে মামলা উঠবে না বললে মামলা ধরলো কেমনে?! মুহুরী নিরুত্তর থাকেন।
(৭)
আদনানের কোর্ট করতে কোন কষ্ট নেই। সারাদিন বসে থেকেও ক্লান্ত হয়না। আদালতে আসা মানুষের কষ্ট তাকে নাড়া দেয়। একজন বিচার প্রার্থীকেও যদি তাড়াতাড়ি আদালত থেকে বিদায় করা যায়! একজনকেও যদি বিচার দেওয়া যায়! ন্যায়বিচার হয়েছে কিনা সেটা যারা বিচার চায় তারা বলতে পারবে। শাস্তি হলে আসামী বলবে ন্যায়বিচার হয়নি। খালাস হলে যারা মামলা করেছে তারা বলবে ন্যায়বিচার হয়নি। তাই, দুপক্ষের কে বিচার পেয়েছে তা বিচারক হিসেবে তিনি বলতে পারবেন না। তার কাজ হলো আইন অনুযায়ী বিচার করে দেওয়া। তার উপরে আরো কোর্ট আছে। তিনি ভুল করলে তারা দেখবেন। তবে, আজকে আদালতে উঠে মামলার অবস্থা দেখে তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছেন। প্রায় সব মামলাই থেমে আছে। তাকে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। অবশ্য এটা নতুন নয়। সব জেলায় গিয়েই তাকে নথি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হয়। নথিতে যে অনেক ধুলোবালি পড়ে! কিছু কিছু নথিতে পোকা ঢুকে যায়। সেগুলোকে তাড়াতে হয়। বিরতির সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি আদালতে উঠার প্রস্তুতি নেন।
(৮)
মফিজের মামলা ডেকেছে। জরিনাও খুব উত্তেজিত। তারা অবাক হয়ে দেখছে আসামীর কাঠগড়ার ডকে রহিম মিয়া, করিম মিয়া, জসীম মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য তারা অনেকদিন দেখেনি। তাদের কপাল হতে ঘাম ঝরছে। মনে হচ্ছে দৌড়ে দৌড়ে এসেছে। মফিজ মিয়া দেখে জজ সাবের সাথে পিপি, উকিল ইয়াহিয়ার খুব বাহাস হচ্ছে। সবাই উত্তেজিত। জজ সাব বলছেন- একটা ট্রিপল মার্ডার কেসের বিচারের এই অবস্থা সমগ্র জেলার জন্য লজ্জাজনক এবং আইন শৃঙ্খলার জন্য হুমকিস্বরূপ। একটা হত্যা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। একটা মানুষকে মেরে ফেলা হলে সে বিচার সবার আগে করতে হবে। আসামী নির্দোষ হলে মামলা চালাতে গিয়ে সর্বশান্ত হওয়ার আগেই তাকে খালাস দিতে হবে। বিচার শুধু মামলা দায়েরকারীর জন্য নয়। আসামীর জন্যও বিচার করতে হবে। তিনি ছয় মাসের মধ্যে সব সাক্ষী নেবেন এবং বিচার শেষ করবেন। মফিজ মিয়া দেখে পিপি গাঁইগুই করছে। ইয়াহিয়া হাত নেড়ে নেড়ে চিৎকার করে বলছে- সে বারের সিনিয়র আইনজীবী। এভাবে কখনো কেউ তাকে বলেনি। সে এবং পিপি মিলে কখনো নথি গায়েব করেনি। মামলার কেইস ডকেট, আসামীর ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য, আসল সুরতহাল রিপোর্ট, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট, জব্দ তালিকা গায়েব করেননি। এসব অবিশ্বাস্য। নথি পেশকারের কাছে থাকে। আদালতের কাছে থাকে। নথি কোথায় গেলো সেটা আদালত বলতে পারবে। কিন্তু তার চিৎকার চেঁচামেচি কেউ শুনছে বলে মনে হয়না।
আদালতের ভেতরে এবং বাইরে মানুষ জমা হয়েছে। সবাই ইয়াহিয়া সম্পর্কে জানে। ইয়াহিয়া আইন খুব ভালো জানে। সে মার্ডার কেসের মাষ্টার। সে মার্ডার কেস দুইভাবে শেষ করে। এক- বুদ্ধি, জ্ঞান দিয়ে। সে যেকোন সাক্ষীকে ৫/৭ দিন ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে জেরা করতে পারে। আইনের জ্ঞান দিয়ে সে অনেক মামলায় আসামী খালাস করিয়েছে। দুই- কুবুদ্ধি দিয়ে। আসামী চাইলে সে অনেক কিছু করে। মামলার গলা টিপে মারে। এভাবে এই মামলা সে পনের বছর ধরে চালাচ্ছে। এই সময়ে কোন সাক্ষী কোথায় গেছে কে জানে? কত সাক্ষী মরে গেছে। পালিয়ে গেছে। কে দেবে সাক্ষ্য? কিছু সাক্ষীকে টাকাও দেওয়া হয়েছে। তারা আদালতে কিছুই বলবেনা। আদালতে অনেক কানাঘুষা থাকলেও কোন আদালত কখনো এভাবে সরাসরি বলেনি। আদালতের ভেতরে বাইরে থাকা সবাই বলাবলি করে এইবার ইয়াহিয়ার জ্ঞানের পরীক্ষা হবে।
আদালতের পেছনে বসে থাকা মফিজ এবং জরিনা দুইহাত জড়ো করে আদালতকে সম্মান জানায়। তাদের মনে হয় একজন বিচারক এসেছেন যে ন্যায়বিচার করতে পারে। তারা আস্তে আস্তে আদালতে উপস্থিত এডভোকেট শায়লা আফরিনের দিকে তাকায়। শায়লা চোখ মুখ শক্ত করে কথার বিপরীতে কথা দেখছে। বোঝার চেষ্টা করছে আসলে কি হচ্ছে? এগুলা আগে অনেকবার সে দেখেছে। কিন্তু কিছু হয়নি। তবে মনে হচ্ছে এই জজ সাব একটু ভিন্ন। সে উঠে দাঁড়ায়। ইয়াহিয়া বিরক্ত হয়। একে তো জজ সাব। তার উপর আবার শায়লা! একদম মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা। শায়লা আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা বলতে চায়। আদালত জিজ্ঞাসা করে তিনি কোন পক্ষে? শায়লা বলেন-তিনি ভিকটিমের আত্মীয়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে বলেন- তিনি এই মামলার অভিযুক্তদেরও আত্মীয়। করিম মিয়া, জসীম মিয়া, রহিম মিয়া এক দৃষ্টিতে শায়লার দিকে চেয়ে থাকে। করিম মিয়া পারলে চোখের দৃষ্টিতে শ্যালিকা শায়লাকে ভষ্ম করে দেন। শায়লা সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
(৯)
আজ জরিনার গায়ে হলুদ। চারদিকে ব্যাপক ব্যস্ততা। মফিজ এই বাড়িতে আছে গত দশ বছর ধরে। সে এক প্রকার বলা যায় ঘরেরই মানুষ। এমন কাজ নেই যা সে পারেনা বা করেনা। কিন্তু তার একটা দুর্বলতা আছে। অনেকবার সে এই বাড়ি ছাড়তে গিয়েও পারেনি। দুর্বলতা হলো বাড়ির মালিকের মেয়ে জরিনা। কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে মফিজ মিয়া অপলক দৃষ্টিতে জরিনার দিকে চেয়ে থাকতো। যেন একটা প্রজাপতি এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। তার একটুও লজ্জা লাগতো না। মনে হয় এই একজনের দিকে চেয়ে থাকা তার অধিকার। আর সবাইকে তার লজ্জা লাগতে পারে। কিন্তু এই মেয়েটার দিকে সে নির্লজ্জের মতো সারাজীবন চেয়ে থাকতে পারবে। মফিজ বোঝে না জরিনাকে দেখলে কেন ওর এমন লাগে? জরিনার বাপের কামলা সে। সারাদিন কাজ করে। মালিকের মেয়ের দিকে এমন দৃষ্টিতে চাওয়া যায় না। মফিজ জানে মালিক জানলে ওকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। মালিক এলাকার চেয়ারম্যান। এই একটা মেয়ে। ওদের কত টাকা! ওদের সামনে সে সামান্য একটা পিঁপড়ে। মফিজের ভিটায় ছনের ঘর ছাড়া আর কিছুই নাই। মফিজ জানে ওর মনের ইচ্ছে অন্যায্য। সে কোনদিনও জরিনা এবং ওর মাঝের আকাশ সমান দূরত্ব ঘুচাতে পারবেনা। শুধু চেয়েই থাকতে পারবে। এতাই তার শান্তি। কদিন ধরে মফিজের মনটা কেমন করে! জরিনার বিয়ে হচ্ছে।ছেলে ওদের সমান। গঞ্জে ৪টা দোকান আছে। বাপ সানন্দে রাজী হয়েছে। বিয়ে উপলক্ষ্যে মফিজের খুব খাটা খাটনি যাচ্ছে। আগামীকাল বিয়ে। আজ গায়ে হলুদ গেলো। অনুষ্ঠানের খাটুনিতে মফিজের শরীর এবং মন কোনটাই চলছে না। কদিন পরেই জরিনাকে আর দেখতে পারবে না এটা চিন্তা করে বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। বিয়ের সময় মফিজ মিয়া বাড়ি ছেড়ে যাবে শেষ বারের মতো। বারান্দায় চিন্তা করতে করতে এক সময় মফিজ ঘুমিয়ে পড়ে। শেষ রাতে কারো হাতের টানে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ কচলে দেখে জরিনা! জরিনা স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে। এখনো ওর গায়ে হলুদের হলদে শাড়ি। মফিজ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে অবাক চোখে জরিনাকে দেখে। ওর কাছে মনে হয় একটা হলুদ পরী আকাশ থেকে নেমে এসেছে। জরিনা আবার হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলে- আমাকে নিয়ে পালাবি? মফিজের বিশ্বাস হয় না। সে বলে- তুমি মালিকের মেয়ে। জরিনা বলে- তাহলে সারাদিন হ্যাংলার মতো চেয়ে থাকতি কেন? মফিজ কথা বলতে পারেনা। ধরা পড়ে গেছে। তাহলে জরিনা সব জানতো! মফিজ জরিনার হাত শক্ত করে ধরে। চোখে চোখ রেখে বলে- চল পালাই।
(১০)
ভোর ৫:০৯ ঘটিকা। আমীম এখনো ট্রিপল মার্ডার কেসের নথি পড়ছেন। একবার ঘুমাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই মামলা তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। ৩টা লাশ খুব বিরক্ত করছে। এমন বিনিদ্র রাত আমীমের জীবনে অনেক দিন পরে এসেছে। এই টাইপের রাত সব বিচারকের কাছে পরিচিত। সকল বিচারককে রায়ের আগে চিন্তা করতে হয়। নথির আদ্যন্ত পড়তে হয়। আমীম তার কথা রাখতে পারেন নি। তিনি ছয় মাসের মধ্যে মামলা শেষ করতে পারেননি। তার মামলা শেষ করতে পাক্কা দুই বছর লেগেছে। পনের বছরের পুরাতন মামলা এত সহজে শেষ করা যায়! আর রাষ্ট্রপক্ষে পিপি’র অসহযোগিতা, সাক্ষীদের হাজিরা না দেওয়া আরো কত ঝামেলা ছিলো। আসামীপক্ষে ছিলো ডাকসাইটে ইয়াহিয়া খান। সে মামলা দেরী করার জন্য সবরকম চেষ্টাই করেছে। কয়েকজন সাক্ষীকে ৫/৭ দিন জেরা করেছে। তবে এডভোকেট শায়লার চেষ্টার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এই আইনজীবী ভিকটিম জরিনার আপন খালা। জরিনাকে সে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলো। একই সাথে সে আসামী করিমের শ্যালিকা। অন্য দুজন অভিযুক্তের মধ্যে রহিম তার বোনের ছেলে। জরিনার আপন ভাই। জসীম করিমের আপন ভাই। সে সাধারণ সাক্ষীদেরকে খুঁজে খুঁজে নিয়ে এসেছে। মামলার ঘটনা হতবাক করার মতো। একমাত্র মেয়ে ঘরের কামলার সাথে পালিয়ে বিয়ে করার কারণে বাবা, ভাই, চাচা কৌশলে বিয়ের ১০ মাস পরে দুজনকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। এরপর রাতের অন্ধকারে দুজনকেই হত্যা করে কেটে খালে ফেলে দেয়। একটু ভুল হয়েছে। জরিনা সন্তান সম্ভবা ছিলো। জরিনার সাথে সাথে তার পেটের সন্তানকেও ছিড়ে বের করে হত্যা করা হয়েছে। একসাথে তিনটা জীবন শেষ করে দেওয়া হয়েছে শুধু পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে সম্মান নষ্ট করায়। আমীমের চোখের কোনা দিয়ে মৃদু পানির ধারা নেমে আসে। এটাও নতুন নয়। আগেও হয়েছে।
(১১)
আদনান সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছেন। মামলা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ হয়েছে। জরিনা, মফিজ এবং তাদের অনাগত সন্তানকে করিম, রহিম, জসীম শুধু পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য হত্যা করেছেন। শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু কি শাস্তি দেবেন?
মফিজ এবং জরিনা আমীমের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আমীমের চিন্তা তারা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। মফিজ, জরিনা চিৎকার করে বলে ফাঁসি দেন স্যার। ফাঁসি দেন স্যার। দেখেন আমাদের কি অবস্থা করেছে? আমরা কি করেছিলাম? শুধু ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলাম। ভালোবাসা কি অপরাধ? পুরো দুনিয়াইতো ভালোবাসার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই ভালোবাসতে পারলে আমরা কি অপরাধ করলাম?
মফিজ এসে ওর গলা দেখায়। আমীম সুরতহাল, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট উলটে পড়তে থাকেন। দেখেন স্যার- আমার গলা রহিম ছুরি দিয়ে দুঁফাক করে ফেলেছে। এখনো কেমন রক্ত পড়ছে দেখেন। আহ! কি কষ্ট স্যার! আমি, জরিনা ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার হাত ছিলো জরিনার পেটের উপর। আমাদের বাচ্চা নড়ছিলো। এই সময় ওরা হায়েনার মতো আসে। লাথি দিয়ে আমার ঘরের দরজা ভাঙ্গে। আমাকে, জরিনাকে গরুর মতো হাত পা বেঁধে ফেলে। মুখে কাপড় পুরে দেয়। রহিম ছুরি বের করে কোরবানীর গরুর মতো আমার গলায় পোঁচ দেয়। একটুও নড়তে পারিনি। গল গল করে রক্ত বের হলো স্যার। পুরো জায়গা ভেসে গেলো স্যার। আপনারা বলেন না। ঐ যে- Pool of Blood! এই যে দেখেন রক্ত! মফিজ নিজের গলা থেকে গলগল করে বের হওয়া রক্ত বের করে দেখায়। আমি কোনভাবে থামাইতে পারি নাই স্যার। একটু চেপেও ধরতে পারি নাই। হাত পা বাঁধা ছিলো যে! দেখেন স্যার আমার কলিজা দেখেন। নাই। নাই স্যার। কলিজা নাই। মফিজ বুকের দুপাশের হাড় সরিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে। সেখানে স্পষ্ট দেখা যায় কলিজা নাই। স্যার আমার শ্বশুর করিম ছুরি দিয়ে আমার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেললো। আমার বুক চিড়ে আমার কলিজা বের করলো স্যার। এরপর পালা কুত্তারে খাওয়াইলো। স্যার, দেখেন। আমীম সুরতহাল এবং পোস্ট মর্টেমে মফিজের দেখানো আঘাত দেখতে পান। একদম স্পষ্ট লেখা আছে গলা কেটে এবং বুক চিড়ে কলিজা কেটে বের করে ফেলার কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মফিজ মিয়ার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছে- Death was due to Shock and hemorrhage caused by above mentioned injury.
আমীম চিন্তা করতে থাকেন। এবার জরিনা এগিয়ে আসে। স্যার, আমি ৮ মাসের পোয়াতী ছিলাম। আর কদিন পরেই আমার বাচ্চা হতো। পেটে বাচ্চা আসার পরে আমাদের সে কি আনন্দ? আমার আর মফিজের কত স্বপ্ন ছিলো বাচ্চা নিয়ে! আমাদের ঘরে একটা আল্লাহর ফেরেশতা আসতো স্যার। ওর সাথে আমি জাগতাম। ওর সাথে আমি ঘুমাতাম। আমার পেটে সে নড়তো। আমি হাত দিয়ে হাত হাত পা মাথা স্পষ্ট বুঝতাম স্যার। জরিনা আর্তনাদ করে বলে- ওর সাথে আমি কথা বলতাম স্যার। আমি চাইতাম ছেলে। কিন্তু মফিজ মিয়া বলতো- ঠিক আমার মতো যেন একটা মেয়ে হয়! আমি আর মফিজ কত রাত জাগছি ওকে নিয়ে! আমার পেটের উপরে হাত দিলে এই মানুষটা আরো বাচ্চা হয়ে যেতো। তার কি হাসি!আমার সব শেষ হয়ে গেলো স্যার। আমি কত কাঁথা বানাইছি দেখেন। জরিনা নানা রং এর কাঁথা দেখায়। কাঁথার উপরে সুতোর আঁকিবুঁকি দেখায়। এরপর বলে আমারে ক্যান মারলো স্যার বাচ্চাসহ। আমিতো বাবার সম্পদ চাই নাই। খালি মফিজরে চাইছিলাম। ওরা ক্যান ধোঁকা দিয়ে আমাদেরকে নিয়া গেলো? ওরা সবাইরে বলতে পারতো এক মেয়ে ছিলো। মরে গেছে। কিন্তু আমাদেরকে ক্যান মারলো? জরিনা অঝোরে কাঁদতে থাকে। আমার সামনে ওরা মফিজরে পোঁচাইলো। ওর কলিজা বের করলো। মফিজ কিচ্ছু করতে পারে নাই। শুধু আমার দিকে চাইয়া আছিলো। ও মনে করছিলো আমারে ছাইড়া দেবে। ওরে কাটার পরে বাবা আমার দিকে আসে। বলে কামলার সাথে ভেগে আমার মান সম্মান নষ্ট করছস। আমি পাঁচ বারের চেয়ারম্যান। ঘর থেকে বাইর হইতে পারি নাই তোর কারণে। মানুষে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। কামলার বাচ্চা তোর পেটে। আমার রক্ত কামলার রক্ত একসাথে হয়েছে। আমি বাবার পা ধরতে চাইলাম। মাফ চাইলাম। স্যার, আমার মনে হয় আমার বাচ্চাটা টের পাইছিলো। সেও কি পেটের ভেতরে লাফালাফি করলো! মনে হয় বুঝতে পারছিলো ওর বাপ নাই। বাবা আমার চুল ধরে পেটে ছুরি চালালো। স্যার ছুরি লাগলো আমার স্বপ্নের গায়ে। বাবা পোঁচ দিয়ে আমার পেট চিড়ে ফেললো। আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার বাচ্চার হাত স্যার। বাচ্চার মাথা। পা। আহারে কি সুন্দর! স্যার বলে না! চান্দের লাহান! কি সুন্দর স্যার। জরিনা চিৎকার করে বলে- আমার পেটে একটা মেয়ে ছিলো স্যার। মফিজের মেয়ে। ছুরিতে ওর পেটসহ কেটে গিয়েছিলো। বাবা ওকে দূরে ছুড়ে মারলেন। আমার চাচা লাঠি দিয়ে আমার মেয়েকে মারলো। এরপর আমার মাথায় মারলো সাপ মারার মতো। জরিনা হাঁফাতে থাকে। আমীম স্পষ্ট দেখতে পান জরিনার চিড়ে দেওয়া পেটের ভেতরে ছোট ছোট হাত। জরিনা স্পষ্ট করে তার পেট থেকে মেয়েকে বের করে দেখায়। আবার আমীম পোস্ট মর্টেম, সুরতহাল দেখেন। স্পষ্ট সব আঘাত লেখা আছে।
আমীম ভাবতে থাকে কি শাস্তি দেবো? পনের বছর আগের অপরাধ। অপরাধীদের সামাজিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। সবার বাচ্চা কাচ্চা আছে। জরিনার ভাই বিয়ে করেছে। সেখানে তার দুইটা বাচ্চা আছে। জরিনার বাপ এবং চাচার বয়স প্রায় ষাট বছর। তারা জীবনের শেষ প্রান্তে। তাদের নাতি পুতি আছে। এর বিপরীতে পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে নিজের মেয়ে/বোনকে পেটের সন্তানসহ হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রধান বিচারপতি বলেছেন- বিচার শুধু জীবিত মানুষ চায় না। সবার আগে বিচার চায় যে মারা গিয়েছে সে। আদালতে শুধু জীবত মানুষ থাকেনা। যে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর অপরাধের বিচার হচ্ছে সে-ও উপস্থিত থাকে।
এই মামলায় তিনজনকে একসাথে নৃশংস পন্থায় হত্যা করা হয়েছে। যারা হত্যা করেছে তারা একই পরিবারের সদস্য। তারা চাইলেই এদেরকে বাঁচতে দিতে পারতো। কিন্তু বিয়ে মেনে নেওয়ার ভান করে ডেকে এনে মেরে ফেলেছে। অনাগত সন্তানকেও রেহাই দেয়নি। মেয়েটার পেটে মাথায় আঘাত আছে। একদম দুমড়ে মুচড়ে দেওয়া হয়েছে। মাথা বলতে কিছু অবশিষ্ট নাই। ব্রেন বের হয়ে গিয়েছে। আসামীরা মামলার নথি গায়েব করেছে। প্রায় সকল মূল কাগজ নথি থেকে সরিয়ে ফেলেছে। অনেক কষ্ট করে আদেশ দিয়ে থানা থেকে, শায়লার থেকে কাগজপত্র জোগাড় করতে হয়েছে। কিছু আদেশ হলেই আসামীপক্ষ অহেতুক উচ্চ আদালতে গিয়েছে। এতটা বছর বিচার আটকে রেখেছে টাকার জোরে। আমীমের চিন্তার ভাঁজ আরো গভীর হতে থাকে।
এই মামলা বিরল থেকে বিরলতর (Rarest of the Rare Case) মামলা। হত্যার পদ্ধতি, ভিকটিমের পরিচয়, নৃশংসতা সবকিছু শয়তানকেও হার মানাবে। এরা সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। এরা সমাজে থাকলে অন্য সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হবে। এরা সমাজের কলঙ্ক। কোন ব্যক্তি যখন সমাজের কলঙ্ক হয় তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়া শ্রেয়। নিঃসন্দেহে অপরাধ নৃশংস, পৈশাচিক, উন্মত্ত, শয়তানসুলভ এবং পাশবিক। কোথা থেকে যেন দমকা বাতাস আসে। আমীমের মনে হতে থাকে এই ঘরেই মফিজ, জরিনা, তাদের সন্তান বসে আছে। তার দিকে চেয়ে আছে। তার সিদ্ধান্ত কি জানার চেষ্টা করছে। তাকে বলছে তাদের হত্যার ন্যায়বিচার করতে।
এই অনুভূতিও নতুন কিছু নয়। আগেও অনেকবার মনে হয়েছে। আমীম নথি বন্ধ করলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘুমাতে বিছানায় গেলেন। আগামীকাল সকাল ১১-০০ ঘটিকায় রায়। যুক্তিতর্কের সময় এডভোকেট শায়লা অঝোরে কেঁদেছিলেন। ন্যায় বিচার চেয়েছিলেন আদালতের কাছে নিজের বোন জামাই, তার ভাই এবং বোনের ছেলের বিরুদ্ধে। আমীম আসামীদের জামিন বাতিল করে তাদেরকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আসামীদের উপস্থিতিতে রায় ঘোষিত হবে। আমীম পাশ ফিরে ঘুমাতে চেষ্টা করলেন। একজন প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ফাঁসি কখনো সমাজকে অপরাধ থেকে রক্ষা করেনা। কিন্তু, উপযুক্ত মামলায় ফাঁসির আদেশ দেওয়া আদালতের কর্তব্য। সেক্ষেত্রে আদালতের হাত কাঁপলে চলবে না। যার যা প্রাপ্য সেটা বুঝিয়ে দেওয়াই ন্যায়বিচার। এই কথা ভিকটিম এবং মামলার অভিযুক্ত উভয়ের ক্ষেত্রে সত্য।
(১২)
“করিম, রহিম, জসীমকে পেনাল কোড, ৩০২, ৩৪ ধারায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো এবং মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হলো”। রায় শুনে ইয়াহিয়া খান সিটে বসে পড়লেন। তার এত বছরের ক্যারিয়ারে এই প্রথম ফাঁসির আদেশ। শাস্তির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যেতে হবে। কিন্তু এই বিচারককে তিনি সম্মান করেন। কিন্তু এই আদেশ যথার্থ। কিছু কিছু অপরাধ আছে যেগুলো আইনজীবী হিসেবে পরিচালনা করলেও সমাজের স্বার্থেই সেগুলো দরকার।
রায় ঘোষণার পরে মফিজ, জরিনা হাত তুলে আবার আদালতকে সালাম জানালো। তারা ন্যায় বিচার পেয়েছে। তারা করিম, রহিম, জসীমের আর্তনাদ শুনলো। মফিজ শক্ত করে জরিনাকে জড়িয়ে ধরলো। সে কাঁদছে। তার কোলে একটা ফুটফুটে শিশু। মফিজ ভাবতে থাকে এত বছরে মেয়েটার নাম রাখা হলো না! ওর একটা নাম রাখতে হবে। এরপর, তারা আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে গেলো।
(১৩)
আদালতের পেছনে ভেলুয়া বিবি বসে আছেন। তার সারা গায়ে পোড়া দগদগে ঘা। সারা শরীরের কোথাও চামড়া নেই। চামড়া উঠে ভেতরের সাদা মাংস দেখা যাচ্ছে। তাকে তার স্বামী গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে তার মেয়ে লাবণীর সামনে। তিনি দশ বছর ধরে আদালতে আসছেন। এ কোর্ট সে কোর্ট ঘুরছেন। আজকেও আদালতে এসে এই রায় শুনেছেন। তিনি এক দৃষ্টিতে বিচারক এ.আর. মোঃ আমীম এর দিকে তাকিয়ে আছেন। এই বিচারক কি তার মামলার রায়টা দেবেন? তার প্রতি ব্যায়বিচার করবেন?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: গল্পের চরিত্রদের নাম ধাম সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
লেখক: আবদুল্লাহ আল মামুন, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজার।