ফাইজুল ইসলাম: আমাদের সমাজে নারী ও শিশুদের ওপর ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দণ্ডবিধির বিধানসমূহ অপর্যাপ্ত থাকায় সরকার ১৯৯৫ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ১৯৯৫’ প্রণয়ন করেন, যা সর্বশেষ ২০২০ সালে সংশোধিত হয় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ নামে অভিহিত।
অস্বীকার করার উপায় নেই, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে অতীতেও। অবশ্য তখন মানুষের মধ্যে এত সচেতনতা ছিল না। তখন নারী নির্যাতন যে একটা অপরাধ সেটা হয়তো অনেকে জানত না। এখন সময় পাল্টাচ্ছে। শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়েছে মানুষ। সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে সকল ক্ষেত্রেই। কিন্তু নারী নির্যাতনের মতো একটি মারাত্মক স্পর্শকাতর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি আজও।
নারী সহিংসতা রোধে আছে আইন, বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সনদ ও চুক্তি। কিন্তু এগুলোর কোন বাস্তবায়ন নেই। এসব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষও সচেতন নয়। আবার অনেক নারীই এসব আইন সম্পর্কে জানেও না। সর্বোপরি আইন প্রয়োগকারী ও আইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী ও দরিদ্র মানুষের প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বছরের পর বছর ধরে শুধু আন্দোলন নয়, নারীর প্রতি এ সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বে নারীর অধিকার আদায় নিয়ে কাজ করছে এমন অনেক সংগঠন রয়েছে। শুধু সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ করাই কাজ নয়, সহিংসতার শিকার প্রতিটি নারীকে যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করতে হবে। প্রতিটি মানুষকে নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় তথ্য জানাতে হবে। যারা মুখ খুলে কথা বলতে ভয় পায় তাদের সাহস দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারবে। যার মাধ্যমে নারী পাবে সহিংসতার প্রতিকার। গড়ে উঠবে সহিংসতামুক্ত একটি সুন্দর সমাজ। তাই নারীদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
মানসিক নির্যাতন তো দূরের কথা, নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা যে একটি গুরুতর অপরাধ, এ ব্যাপারে ধারণাই নেই অনেক পুরুষের, এমনকি অনেক নারীরও। স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক বলে মনে করেন অনেক নারী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাল্টিপল ইন্ডিকেটর সার্ভে ২০১৯-এ উঠে এসেছে, দেশের প্রতি চারজন বিবাহিত নারীর একজন স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক বলে মনে করেন।
অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের এ মানসিকতা যে শুধু পুরুষকেই অপরাধী হিসেবে গড়ে তুলছে, তা কিন্তু নয়; বরং তা নারীর মধ্যেও পুরুষের অপরাধকে যৌক্তিক বলে মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করছে।
সরকারি হিসাবেই বাংলাদেশের ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ নারী পারিবারিক পরিসরে স্বামী বা ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হন। এ নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতন।
অবাক করা বিষয় হলো নির্যাতনকারী পুরুষের অধিকাংশই এসব নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবে স্বীকারই করেন না; বরং যেকোনো উপায়ে স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই তাঁরা তাঁদের অধিকার বলে মনে করেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের এ ধরনের অপরাধের জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
প্রতিবছর এ দেশের হাজার হাজার নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট অপরাধ করার পরও অধিকাংশ ধর্ষকই অনুতপ্ত হয় না। ধর্ষণের জন্য ধর্ষণের শিকার নারীকেই অভিযুক্ত করে এবং তার নিজের অপরাধের পক্ষে সাফাই গায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজের অনেককেই ধর্ষকের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখি এবং পুরুষকে প্রলুব্ধ করার জন্য উল্টো নারীকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধ কঠোরভাবে দমনের জন্য সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করে। ২০০০ সালে আইনটি প্রণয়নের পর ২০০৩ সালে এটি সংশোধীত হয়।
দহনকারী পদার্থের মধ্যে এসিড নিক্ষেপের অপরাধও অর্ন্তভূক্ত।
যদি কোনো ব্যক্তি দহনকারী, ক্ষয়কারী অথবা বিষাক্ত কোনো পদার্থ দ্বারা কোনো শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যু দণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এর পাশাপাশি সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করবেন। এছাড়া যদি কেউ দহনকারী পদার্থের দ্বারা আহত হন তবে সেক্ষেত্রেও শাস্তির বিধান রয়েছে।
আবার যদি কেউ পতিতাবৃত্তি বা বেআইনী বা নীতিবিগর্হিত কোনো কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে বিদেশ থেকে আনে বা বিদেশে পাচার বা প্রেরণ করেন অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা কোনো নারীকে ভাড়ায় বা অন্য কোনোভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হস্তান্তার করে বা কোনো নারীকে তার জিম্মায় রাখেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীব কারাদণ্ডে অনধিক বিশ বছর কিন্ত কমপক্ষে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বেআইনী বা নীতিবিগর্হিত উদ্দেশ্যে কোনো শিশুকে বিদেশ থেকে আনে বা বিদেশে প্রেরণ বা পাচার করেন অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা কোনো শিশুকে নিজ জিম্মায় রাখেন তা হলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
যদি কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা চৌদ্দ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
যদি কোনো ব্যক্তি মুক্তি পণ আদায়ের উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে আটক করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন তাহলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন ও অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করলে করণীয়
প্রথম যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পরেও পুলিশ মামলা গ্রহণ করছে না। এখন কী করব? সাধারণত অপরাধের শিকার ব্যক্তির বর্ণিত ঘটনা এমন থাকে যে, অপরাধ যিনি করেছেন (অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি) তিনি স্হানীয়ভাবে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুলিশ গ্রহণ করছেন না।
উপরে বর্ণিত বর্ণনা অনুযায়ী কারণ বা অন্য যে কোনো কারণে হোক, কোনো অভিযোগকারী যদি পুলিশের কাছে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার অনুরোধ করে ব্যর্থ হন, তাহলে এই আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী অভিযোগকারী ব্যক্তি কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে কোনো অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছেন—এই মর্মে হলফনামা সহকারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কাছে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীন অপরাধ বিচারের জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল থাকে (প্রয়োজন অনুসারে একাধিক ট্রাইব্যুনালও থাকতে পারে)। এইরূপ ট্রাইব্যুনাল ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’ নামে অভিহিত বা পরিচিত।
কখন এই আইনের ১১ (গ) ধারার অধীন মামলা দায়ের করা যায়
বৈবাহিক জীবনে পারস্পরিক মনোমালিন্যের জের ধরে ঘটে যাওয়া শারীরিক নির্যাতনের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই সবাই ১১(গ) ধারা, যৌতুকের জন্য সাধারণ আঘাত মামলা করতে চান। শারীরিক নির্যাতন বা মারামারি ঘটলেই তার জন্য ১১(গ)-তে ঢালাওভাবে মামলা করা যাবে না।
যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন ঘটলে কেবল তখনই ১১(গ)-তে মামলা করা যায়। বিবাহিত জীবনে অন্য কোনো কারণে (যেমন:পরকীয়া আসক্ত হয়ে, ঝগড়া ইত্যাদি) মনোমালিন্য থেকে শারীরিক আঘাতে সাধারণ বা গুরুতর আঘাত করলে তার জন্য দণ্ডবিধির অধীন মামলা হতে পারে, তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০২০-এর অধীনে মামলা চলবে না।
বিএলসি (২০২০) ৮৫৭
তালাকের পরে অর্থাৎ পূর্বে সংগঠিত অর্থাৎ বৈবাহিক সম্পর্ক চলমান অবস্থায় সংঘটিত অপরাধের জন্য ন্যায়বিচারের স্বার্থে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১ (গ) ধারার অধীনে মামলা করতে পারবেন। তালাক হয়ে যাওয়া বা দাম্পত্য সম্পর্ক আর না থাকাতে মামলা করার অধিকার শেষ হয়ে যায় না। ঘটে যাওয়া ঘটনার ওপর মামলা চলবে কি না, তা বিচার চলাকালীন সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। [মো. তৌয়ব আলী মোল্লা বনাম সুলতান এবং গং ২২ বিএলটি ৮৮]
মিথ্যা মামলা, অভিযোগ দায়ের দণ্ডনীয় অপরাধ
অভিযুক্ত ব্যক্তির অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে মিথ্যা অভিযোগ, মামলা দায়ের করায় সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। সেক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, যদি কোনো ব্যক্তি কারো ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে, ন্যাঘ্য বা আইনানুগ কারণ না জেনেও এই আইনের কোনো ধারার অধীনে মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন, তাহলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ।
সহিংসতার শিকার নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ও এর সংশোধন ২০০৩ আইন হয়েছে। ২০০০ ও এর সংশোধনী ২০০৩-এ সর্বমোট ৩৪টি ধারায় নারী ও শিশুর ওপর সংঘটিত ১১ ধরনের অপরাধের বিচারের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভুক্তভোগী নারীরা আইনি অধিকার পাওয়ার অভিগম্যতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০ এর মাধ্যমে ৩২ক ধারা সংযোজন করে নতুন একটি বিষয় যোগ করা হয়েছে। আগে শুধুমাত্র ধর্ষিতার মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হত। এখন থেকে ধর্ষিতা এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি দুজনেরই মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হবে। ডিএনএ টেস্টে তাদের সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, ধর্ষিতা এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি দুজনেরই ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক টেস্ট করা হয়।
নারী নির্যাতন বন্ধে প্রচলিত আইনের পাশাপাশি বাংলাদেশে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাস করা হয় এবং ২০০৩ সালে কিছু সংশোধনী আনা হয়। এ আইনে বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী ও শিশু অপহরণ, আটক করে মুক্তিপণ আদায় বা দাবি, নারী ও শিশু পাচার, নারী ও শিশু ধর্ষণ বা ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ঘটানো, যৌন পীড়ন, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে অঙ্গহানি করা, ধর্ষণের ফলে জন্মলাভকারী শিশুসংক্রান্ত বিধানসংবলিত অপরাধের বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়গুলো এসেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সর্বশেষ ২৬ নভেম্বর ২০২০-এ সংশোধন করা হয়।
লেখক: ফাইজুল ইসলাম; এল এল এম, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
১। সগীর আহমেদ টুটুল, সহকারী জাজ
২। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
৩। হাসান ইমাম রুবেল, নারীপক্ষ
৪। শেখ আবদুস সবুর বনাম তাহের আলী, ৪৯ DLR