বারিস্টার চৌঃ মুর্শেদ কামাল টিপু: সম্প্রতি আপিলিট ডিভিশনের একজন সম্মানিত বিচারকের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশে যে ডিসকৌর্স চলছে তা হলো বিচারকগণ কি রাজনীতিবিদ? দেশে এ ডিসকৌর্স নতুন হলেও বিচারকগণের কর্ম রাজনৈতিক প্রকৃতির কি না এবং বিচারকগণ বিচারিক সিদ্ধান্তে political allegiance এর প্রতিফলন দেখান কিনা তা নিয়ে বিংশ শতাব্দির প্রথম থেকেই সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে লিগেল সমালোচকদের মধ্যে বিতর্ক চলছে।
যেসব দেশ গণতন্ত্র ক্লাইমেক্সে পৌছে গেছে সে সব দেশের বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার তুলনায় উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশে বিচারকগণ একই স্বাধীনতা ভোগ করেন না। ইংল্যান্ডের সাথে তুলনা করলে আমেরিকার গণতন্ত্রকে এখনো উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশ বলতেই হয়। আমেরিকার কোর্ট রাজনৈতিক আনুগত্যের বাইরে গিয়ে শুধু মাত্র কন্ক্রিট লিগেল প্রিন্সিপোলের উপর ভিত্তি করে বিশেষ করে জুডিশিয়াল রিভিউতে ডিসিশান দিতে পারে কি না – এ বিষয়ে আমেরিকার জনমত বিভাজিত।
২০০০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে ফ্লোরিডা অংগ রাজ্যের ইলেক্ট্রনিক কাউন্টিং মেশিনে যে একষট্টি হাজার ভোট গণনা করা হয়নি সেগুলো ম্যানুয়ালি গণনা করতে ফ্লোরিডা সুপ্রীমকোর্ট সিদ্ধান্ত দিলে জর্জ ওয়াকার বুশ ক্যামেপেইন সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমেরিকার সুপ্রীম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিল।
Attitudinal Approach অনুযায়ী একজন জাজ বিচারিক সিদ্ধান্ত দিতে নিজের আইডিওলজি ও বিবেকের উপর নির্ভর করেন। পক্ষান্তরে Strategic approach অনুযায়ী একজন জাজ সিদ্ধান্ত নিতে আইনসভা, নির্বাহী সভা ও জনগণের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করেন। এ প্রক্রিয়ায় বিচারকের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক রূপ লাভ করে।
George Waqar Bush ( Junior ) vs Al Gore মামলায় আমেরিকার সুপ্রীম কোর্টের মেজরিটি জাজ সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে, একষট্টি হাজার ভোট ম্যানুয়ালি গণনা করার ফ্লোরিডা কোর্টের রিকাউন্ট অর্ডার সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর Equal Protection Clause অনুযায়ী অসাংবিধানিক। অনেক একাডেমিক স্কলার ঐ রায়ের পর সমালোচনা করে বলেছিলেন যে, সেটা কোন বিচারিক রায় ছিলনা, বরং তা ছিল বিচারিক ভোট, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক গণ রাজনৈতিক আনুগত্যের পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন মাত্র।
হার্ভার্ড ল স্কুলের প্রফেসর Alan Dershowitz বলেছিলেন —“ …. that was cheating and violation of Judicial oath….” পক্ষান্তরে ইংল্যান্ডের Royal Prerogative সংক্রান্ত জুডিশিয়াল রিভিউ Council for Civil Service Union vs Minister of Civil Service হাউজ অভ লর্ডস এর ল লর্ড গণ রাজনৈতিক আনুগত্যের বাইরে গিয়ে সরকারের বিপক্ষে জাজমেন্ট দিয়ে বলেছিলেন রয়্যাল প্রেরোগেটিভ জুডিশিয়াল রিভিউের আওতাভুক্ত।
The judicial power is political phenomenon as well. জন্মগত ভাবেই আইন রাজনৈতিক। সে অর্থে কোর্ট হচ্ছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কোর্ট যে ক্ষমতা ভোগ করে তা পলিটিক্যালি ডিসাইসিভ- এটাই সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
Separation of powers and independence of Judiciary এর কিতাবী তত্ত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ কেহ কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করবে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুঃ ২২ – এ বলা হয়েছে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন মার প্যাচে তা লাভ করতে সাবর্ডিনেইট জুডিশিয়ারীকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন যদি ১/১১ রেজিমে নির্বাহী বিভাগের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিহিংসায় নির্বিকার ও নির্ভিক থেকে ডেসপারেইটলি কাজ না করতেন তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রাপ্তি সুদূর পরাহত ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সে স্বাধীনতার ফল ভোগ করছে, যদিও বারিস্টার মইনুল হোসেন নিজের জন্য সে ফল ভোগ করতে পারেন নি। সিম্পল মানহানির মামলায় তাকে একাধিকবার কাস্টডি ভোগ করতে হয়েছিল, একই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সারাদেশে একাধিক হয়রানিমূলক মামলা হয়েছিল যা ছিল তার জন্য Irony of fate.
মূল প্রসঙ্গে ফিরা যাক। বিচারকগণের কর্ম রাজনৈতিক প্রকৃতির কি না বা বিচারকগণ রাজনীতিবিধ কি না তা ব্যাখা করতে Attitudinal Approach এবং Strategic Approach সম্বন্ধে একটু আলোকপাত করা দরকার। Attitudinal Approach অনুযায়ী একজন জাজ বিচারিক সিদ্ধান্ত দিতে নিজের আইডিওলজি ও বিবেকের উপর নির্ভর করেন। পক্ষান্তরে Strategic approach অনুযায়ী একজন জাজ সিদ্ধান্ত নিতে আইনসভা, নির্বাহী সভা ও জনগণের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করেন। এ প্রক্রিয়ায় বিচারকের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক রূপ লাভ করে।
সিটিজেন রাইটকে সমুন্নত রাখতে কোর্ট প্রহরীর মতো কাজ করে। রীট বা জুডিশিয়াল রিভিউ এর পরিধি দিনে দিনে বাড়ছে সারা বিশ্বে। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক পলিসি ম্যাটারে খুব কম ক্ষেত্রই আছে যা জুডিশিয়াল রিভিউের আওতামুক্ত। যদিও বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক পলিসি ম্যাটার বাস্তবায়ন কোর্ট কর্তৃক ইনফোর্সেবল নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮, ক্লজ ২ অনুযায়ী মৌলিক পলিসি নতুন আইন তৈরী করতে ও সংবিধানের ব্যাখায় গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সমূহ (যা কোর্ট কর্তৃক ইনফোর্সিবল) এবং ফান্ডামেন্টাল পলিসিগুলো একে অপরের সাথে ইন্টার লকে আবদ্ধ। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান সুপ্রীম কোর্ট Alga Teles vs Bombay Municipal Corporation মামলার অবজার্ভেশনে বলেছে মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রথমটাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয়টাকে এনফোর্স করা যায় না। ফলে জুডিশিয়াল রিভিউের পরিধি সরকারের মৌলিক পলিসি পর্যন্ত পৌছে যাচ্ছে। জুডিশিয়াল রিভিউ রাষ্ট্রের পলিসি মেকিংকে নতুন রূপ দিতে পারে।
এজন্যই বলা হয় সাংবিধানিক কোর্ট রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। সুপ্রীম কোর্টে জুডিশিয়াল রিভিউের ক্ষেত্র যত বাড়বে, বিচারকদের রাজনৈতিক প্রকৃতি ও ক্ষমতা ততই বাড়বে। The judicial power is political phenomenon as well. জন্মগত ভাবেই আইন রাজনৈতিক। সে অর্থে কোর্ট হচ্ছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কোর্ট যে ক্ষমতা ভোগ করে তা পলিটিক্যালি ডিসাইসিভ- এটাই সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। E-mail: barrister.cmktipu@gmail.com