অবসরে যাচ্ছেন দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর শূন্য হচ্ছে প্রধান বিচারপতির পদ। তবে পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে সুপ্রিম কোর্টে শরৎকালীন অবকাশ শুরু হচ্ছে। ফলে চলতি মাসের ৩১ আগস্ট প্রধান বিচারপতি হিসেবে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তার শেষ বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
তাই বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ এ পদে নিয়োগের অপ্রকাশ্য কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে আরো আগে থেকেই। যোগ্যতা যাচাইসহ চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিচারাঙ্গণের মানুষের তাই কৌতুহল- কে হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর স্থলাভিষিক্ত। কবেই বা দেয়া হচ্ছে এ নিয়োগ?
রাষ্ট্রপতি চাইলে আপিল বিভাগের যেকোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। আর প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দেবেন।
প্রথাগত প্রক্রিয়া
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রথাগত প্রক্রিয়া বলছে, আপিল বিভাগে কর্মে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিই পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাবেন। সেই হিসেবে বর্তমানে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর পর কর্মে প্রবীণ আপিল বিভাগের বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ফলে তিনি দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন- বিচারাঙ্গনের মানুষের কাছে এটি মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।
তার পরপরই কর্মে প্রবীণ বিচারপতি রয়েছেন বোরহানউদ্দিন। পরবর্তী ৪ বিচারপতির মধ্যে কর্মে প্রবীণ বিচারপতিগণ হলেন, আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো: আবু জাফর সিদ্দিকী এবং বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম।
জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন
সাংবিধানিক কিংবা আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় প্রথাগত প্রক্রিয়ার বাইরেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বহুল চর্চিত আরেকটি রেওয়াজ সুপ্রিম কোর্টে রয়েছে। সেটি হচ্ছে, সুপার সিডেড বা সিনিয়রিটি লঙ্ঘন।
গত দেড় দশকে বিশেষত প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সিনিয়রিটি লঙ্ঘিত হয়েছে বহুবার। যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীকে ডিঙিয়ে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া। ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাকে এ পদে নিয়োগ দেয়া হলে মোহাম্মদ ইমান আলী আর এজলাসে বসেননি।
এর আগে ২০১৮ সালে ২ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিঞাকে ডিঙ্গিয়ে প্রধান বিচারপতি করা হয় বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। তবে পরপর ৪ বার সিনিয়রিটি লঙ্ঘনের শিকার হলেও পঞ্চমবার প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন বিচারপতি ফজলুল করিম।
জ্যেষ্ঠতার ক্রমে আলোচনায় থাকা তিন বিচারপতির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান
প্রথাগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানই-এ পদে নিয়োগযোগ্য। ফলে দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার নামটিই আলোচিত হচ্ছে বেশি। তার ক্যারিয়ারও বর্ণাঢ্য। বর্তমানে আপিল বিভাগের ২ নম্বর বেঞ্চটির বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার নেতৃত্বাধীন ‘অনুসন্ধান কমিটি’র সুপারিশে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসএস, এমএসএস ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জনের পর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ১৯৮৬ সালে জেলা আদালত, ১৯৮৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগ এবং ২০০৫ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
২০০৯ সালের ৩০ জুন তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি এবং ২০১১ সালের ৬ জুন স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এই বিচারপতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হলে সিনিয়রিটি লঙ্ঘনের কোনো বিতর্ক উঠবে না। যেকোনো দিন প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হলেও এ নিয়োগ কার্যকর হবে শপথ গ্রহণের মুহূর্ত থেকে।
বিচারপতি বোরহানউদ্দিন
বহুল চর্চিত সিনিয়রিটি লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি ঘটলে প্রধান বিচারপতির আসনে বসতে পারেন আপিল বিভাগের দ্বিতীয় সিনিয়র বিচারপতি বোরহানউদ্দিন। তিনি ১৯৮৫ সালের ৩ মার্চ জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৮ সালের ১৬ জুন তিনি হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হন। ২০০২ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হন।
২০০৮ সালের ১৬ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি এবং ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর বিচারপতি হিসেবে স্থায়ী হন। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম
আপিল বিভাগের তৃতীয় সিনিয়র বিচারপতি এখন এম. ইনায়েতুর রহিম। রাষ্ট্রপতি ‘যোগ্য বিবেচনা’ করলে তিনিও নিযুক্ত হতে পারেন বাংলাদেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ১৯৮৬ সালের ১০ অক্টোবর আইন পেশায় যুক্ত হন। ১৯৮৯ সালের ২ জানুয়ারি তিনি হাইকোর্ট বিভাগ এবং ২০০২ সালের ১৫ মে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৫ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক নিযুক্ত হন। ২০০৯ সালে নিযুক্ত হন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল।
একই বছর ৩০ জুন তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। দু’বছর পর এ পদে স্থায়ী হন। ২০১৪ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হন।
ধারণা করা হচ্ছে, এই ৩ জনের মধ্য থেকেই রাষ্ট্রপতির কাছে ‘যোগ্য বিবেচিত’ বিচারপতিই দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে। কিন্তু কবে নাগাদ রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগ চূড়ান্ত করবেন তা নিশ্চিত করতে পারেনি বঙ্গভবন, আইন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের কোনো পক্ষ। তবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যেকোনো দিন নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করতে পারেন বলে জানিয়েছেন নির্ভরযোগ্য সূত্র।