মো. অলিউর রহমান: বাংলাদেশে ই-জুডিশিয়ারি চালু করার জন্য ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তখনই প্রধানমন্ত্রী ই-জুডিশিয়ারির অংশ হিসেবে ভার্চুয়াল কোর্ট স্থাপনের নির্দেশনা দেন। যার ফলে ই-জুডিশিয়ারি স্থাপনের একটি প্রকল্প হিসেবে ১০টি জেলায় পাইলট প্রকল্প বাছাই করা হয়। তখন যে সকল জেলার মন্ত্রীগণ কার্যত শক্তিশালী ছিলেন, সেসব জেলার নাম ওই পাইলট প্রকল্পের তালিকায় ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই তালিকা গেলে, তিনি প্রেরিত তালিকা বাতিল করেন। তিনি সিদ্ধান্ত দেন আটটি বিভাগীয় শহরে প্রথমে প্রকল্প হিসেবে চালু হবে। তারপর বিষয়টা আর বেশিদূর যায়নি।
সীমিত পরিসরে প্রথম ভার্চুয়াল আদালত শুরু হয় করোনার ভাইরাসের সময়। তখন করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ এক ধরনের মহামারি বিশ্বব্যাপী উদ্ভূত হওয়ার ফলে বাংলাদেশেও এর বিস্তার লাভ করে। যার ফলে সাময়িক ভার্চুয়াল আদালতের সৃষ্টি হয়। তবে এবার করোনা পরিস্থিতি নয়, সরাসরি ডিজিটাল বিচার বিভাগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ।
এক্ষেত্রে কিছু ‘প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ অনুসরণ করতে হবে। আদালত কর্তৃক ‘তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০’ (২০২০ সনের ১১ নং আইন) -এর ৫ ধারার ক্ষমতা বলে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এ সংক্রান্ত ‘প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ জারি করেছেন।
ডিজিটাল বিচার বিভাগ বাংলাদেশের নতুন এক অধ্যায়। অবশ্যই প্রশংসনীয় এক কাজ। অন্যান্য অনেক দেশেই ভার্চুয়াল আদালত রয়েছে। এমন কী আমাদের প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানে আমাদের অনেক আগেই চালু করেছে। এটা অবশ্যই ভালো খবর বিচারপ্রার্থীদের জন্য।
প্রতিটি জিনিসের ভালো খারাপ দুই দিক থাকে। আমার দৃষ্টিতে আপাতত কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ-
ভার্চুয়াল কোর্ট: সুবিধা
১। মামলার জট কমবে।
২। বিদেশ থেকে বিচার প্রার্থীরা বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
৩। বিশেষ করে প্রবাসীদের বিচারিক ভোগান্তি কমবে।
৪। কারাগারে সহজে আটক আসামি-কয়েদির জামিন শুনানির সুযোগ।
৫। শুনানি বা নিষ্পত্তি হবে কম সময়ে।
৬। তুলনামূলক ঘাটে ঘাটে খরচ কমে যাবে। ইত্যাদি।
ভার্চুয়াল কোর্ট: অসুবিধা
১। অপরিকল্পিতভাবে বিচার বিভাগকে ডিজিটাল যুগে ধাবিত করা।
২। বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টজনদের তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান।
৩। বিদেশে অবস্থানরত বিচার প্রার্থীদের ভার্চুয়াল আদালতের দায়িত্ব থাকবে সেখানকার দূতাবাসগুলো। সেখানে আলাদা অভিজ্ঞ লোকবল নিয়োগে রাষ্ট্রের টাকা অপচয় হবে এবং সবাইকে সময় বণ্টন কিংবা ভার্চুয়াল আদালতের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া কষ্টসাধ্যে হবে।
৪। ভার্চুয়াল আদালতের পূর্ব অনুমতি নিতে হবে। যেটা সময়ের অতিরিক্ত অপচয়।
৫। ইন্টারনেট সংযোগের ধীরগতি ও সংযোগ বিচ্ছিন্নতা।
৬। বিদ্যুৎ সংযোগের ধারাবাহিকতা বজায় না থাকা।
৭। সার্ভার ডাউন কিংবা হ্যাকারের কবলে পড়ে হ্যাক হওয়া।
৮। তথ্যের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব।
৯। ওকালতনামা কিংবা বেইল বন্ডের কাগজে স্বাক্ষরে ভার্চুয়াল ভোগান্তি।
১০। ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির আশঙ্কা।
১১। আরও নানাবিধ প্রযুক্তিগত ঝক্কি-ঝামেলা ইত্যাদি।
ভার্চুয়াল কোর্ট: সুপারিশ
আমাদের ডিজিটাল লিটারেসির অভাবে এবং আদালত সমূহ প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর স্বল্পতায় এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে মনে হচ্ছে। এজন্য প্রযুক্তিগত কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং আক্ষরিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল।
বিদেশে বিচার প্রার্থীদের জন্য নিজস্ব আইডেন্টি কার্ড প্রদর্শন মূলক নিজস্ব সুবিধামত জায়গায় বসে ভার্চুয়াল আদালতে বসা অধিকতর সহজ ছিল। এতে দূতাবাস গুলোর উপর বাড়তি ঝামেলা কিংবা অতিরিক্ত প্রযুক্তিগত লোকবল নিয়োগে রাষ্ট্রের বাড়তি টাকার অপচয় রোধ হতো।
তবে এসব কিছুর পরও বাংলাদেশে যে ডিজিটাল যুগের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে, এই পথচলা ফিনিক্স পাখির মতো দুরন্ত গতিতে চলমান থাকুক সে কামনাই থাকলো।
লেখক: মো. অলিউর রহমান, আইনজীবী; উপদেষ্টা, ফাইন্ড মাই অ্যাডভোকেট; পরিচালক, হাজী ইকবাল ফাউন্ডেশন, যুক্তরাজ্য থেকে।