বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল; কিন্তু আমরা হতাশ হয়েছি। মানুষ অনেক আশা নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। যাদের কাছে এ আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া আছে তাদের মনোজগতের পরিবর্তন করতে হবে।
সিলেটে আয়োজিত ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন ও সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধ: সরকার ও নাগরিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। এফআইভিডিবির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সিলেটের হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনালে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
এতে আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ, অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এএলআরডির প্রোগ্রাম ম্যানেজার অ্যাডভোকেট রফিক আহমেদ।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, সরকার বলছে দেশে সংখ্যালঘু নেই, এটা ঠিক নয়। সংখ্যালঘুরা শুধু নির্যাতনের শিকার হয় না, তারা প্রতিদিন নির্যাতনের ভয়ে থাকে যা আরও মর্মান্তিক। সংখ্যালঘুরা যখন হামলার শিকার হয় তখন আমরা সংখ্যাগুরুরা কেন প্রতিরোধ করতে পারি না? আগে রাষ্ট্র ছিল সাম্প্রদায়িক এবং সমাজ ছিল অসাম্প্রদায়িক। বর্তমানে সমাজকেও আমরা সাম্প্রদায়িক করে ফেলেছি। আমরা জানি না কে আমার নির্বাচিত প্রতিনিধি।
তিনি বলেন, কিছুদিন পর পর দেখি একের পর এক প্রতিনিধি হচ্ছেন, কিন্তু আমরা কষ্টে আছি এ কথা তাদের বলতে পারি না। তাহলে আমাদের রাষ্ট্র কোথায়? কিন্তু এতো সহজে আমরা আমাদের অধিকার ছেড়ে দেব না। কারণ মানবাধিকার হচ্ছে সবার সমান অধিকার।
সেমিনারে সুলতানা কামাল বলেন, গণতান্ত্রিক সরকার নির্দেশনামূলক আইন তৈরি করে। সংবিধানে বলা আছে- যেকোনো বৈষম্যমূলক আইন বাতিল বলে গণ্য হবে। সুতরাং কোনো অবস্থায়ই অর্পিত সম্পত্তি আইন থাকতে পারে না। কোনো সরকারই সংখ্যালঘুদের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
মনিন্দ্র কুমার নাথ বলেন, ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে তা প্রত্যর্পণ করা হচ্ছে না। ট্রাইব্যুনালের রায় থাকা সত্ত্বেও ডিসি, এসিল্যান্ডরা আবার কাগজ পত্র নিয়ে বিচার করতে বসেন। আদতে সে ক্ষমতা তাদের নেই।
তিনি বলেন, একবিন্দু জমিও আমরা ছাড়ব না। আমাদের লড়াই চলতেই থাকবে। সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে তার একটিরও বিচার হয়নি। উল্টো ভুক্তভোগীদের নির্বিচারে জেল খাটতে হয়েছে।
শামসুল হুদা বলেন, অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে আমাদের আর কত বছর আন্দোলন করতে হবে তা জানি না। কোনো অবস্থায় আমলারা এ সম্পত্তি ফেরত দিতে চান না। একটার পর একটা অজুহাত তারা দাঁড় করায়। এ আইনটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে সদিচ্ছা দেখিয়েছেন তা ভ্রুক্ষেপ না করে আমলারা বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন প্রতিরোধে আইন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমরা অতীতের অবস্থা বিবেচনা করে দেখছি প্রশাসন সবসময় ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঘটনা ঘটার পরে, আর এই আক্রমণ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট দলের লোকেরাই করে না, সব দলের লোকেরাই সেখানে থাকে।
অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে গত ৪০ বছর ধরে আন্দোলন করছি, কিন্তু তার সুফল পাচ্ছি না। ৭২-এর সংবিধান পাশ হওয়ার পরও কেন এখনো অর্পিত সম্পত্তি আছে তাই বোধগম্য নয়। উচ্চ আদালতের রায় থাকার পরও প্রশাসন ৭৪-এর পর অর্পিত সম্পত্তির তালিকা করেছে।
সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, শত্রু সম্পত্তি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিভিন্ন নামে বজায় থেকেছে। যার সর্বশেষ নাম অর্পিত সম্পত্তি; কিন্তু বিষয়বস্তুতে কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের সংবিধান সমঅধিকারের কথা বলছে কিন্তু আমরা এখনও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা ওয়াকফ স্টেটের ক্ষেত্রে এক ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করি, আর দেবোত্তর সম্পত্তির ক্ষেত্রে আরেক ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করি। তাহলে সমতা কোথায়? আমাদের অবশ্যই এ বৈষম্য দূর করতে হবে।
সভায় আলোচকরা আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে ডিক্রি হবার ৪৫ দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসক কর্তৃক অর্পিত সম্পত্তি ফেরত দেওয়া দ্রুত কার্যকরের জোর দাবি জানান।