চেক ডিজঅনার: সর্বশেষ আপডেটসহ চেকের মামলা দায়েরের নতুন নিয়ম
ছগির আহমেদ টুটুল; মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, সিলেট

সর্বশেষ সংশোধনীর আলোকে পারিবারিক আদালতের গঠন ও এ সংক্রান্ত প্রতিকার

ছগির আহমেদ টুটুল: পারিবারিক বিষয় নিয়ে কোনে বিরোধের উদ্ভব হলে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে হয়। পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩ এর ধারা ৪ অনুযায়ী সহকারী জজ আদালত বা সিনিয়র সহকারী জজ আদালত পারিবারিক আদালত হিসেবে গণ্য হবে। পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩ অনুযায়ী সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদার ১ (এক) জন বিচারক সমন্বয়ে পারিবারিক আদালত গঠিত হবে। ১৯৮৫ সালের আইনে শুধু সহকারী জজ এর কথা উল্লেখ ছিলো।

সহকারী জজ আদালতের আর্থিক এখতিয়ার ১৫ লক্ষ টাকা এবং সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের আর্থিক এখতিয়ার ১৫ লক্ষ ১ টাকা থেকে ২৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ যখন পারিবারিক আদালতের বিচারক হিসেবে কাজ করে তখন তার আর্থিক এখতিয়ার সীমাহীন। উদাহরণ- একটা বিয়েতে ৫০ লক্ষ টাকার দেনমোহরের মামলার বিচার করার এখতিয়ার ও পারিবারিক আদালতের আছে।

পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩ এর ৫ ধারা অনুযায়ী নিম্নলিখিত ৫টি ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতের বিচার করার ক্ষমতা আছে। যথা:

ক. বিবাহ বিচ্ছেদ।
খ. দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার।
গ. মোহরানা।
ঘ. ভরণপোষণ।
ঙ. অভিভাবকত্ব এবং শিশুদের হেফাজত।

পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ বলবৎ হওয়ার পর একটি বিতর্ক দেখা দেয়। বলা হয় যে পারিবারিক আদালত কি মুসলমানদের জন্য একটি আদালত। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা এখানে মামলা করতে পারবে কি?

সর্বপ্রথম Krishnapada Talukdar V Geetasree Talukdar 14 (1994) BLD 415 নামক মামলায় এরকম প্রশ্ন দেখা দেয়। এই মামলায় প্রশ্ন উঠে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মহিলা তার স্বামীর বিরুদ্ধে ভরণপোষণের জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবে কিনা। এই মামলার রায়ে বলা হয় এই আইনের বিধান শুধু মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য। এই সংকটটি ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল।

Pochon Rikssi Das Vs Khuku Rani Dasi and others 50(1998)DLR(HCD)47 মামলায় এই সংকটটি চূড়ান্ত ভাবে দূর করা হয়। তিন জন বিচারকের সমন্বয় গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ বেঞ্চ এটা বহাল রাখে যে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের জন্য।

এখানে একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলা ভালো হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মোহরানা এবং বিবাহ বিচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে না। কারণ হিন্দু ধর্মে মোহরানা এবং বিবাহ বিচ্ছেদ নাই।

এই ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিরা শুধুমাত্র তিনটি ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। যথা:

ক. দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার (restitution of conjugal rights)
খ. ভরণপোষণ (maintenance)
গ. অভিভাবকত্ব এবং শিশুদের হেফাজত (guardianship and custody of children)

অন্যদিকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা উপরিউক্ত তিনটি বিষয় ছাড়া ও মোহরানা এবং বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পর্কিত বিষয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে।

(১) বিবাহ বিচ্ছেদ (Dissolution of Marriage) :

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৭ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে যেকোন পদ্ধতিতে তালাক ঘোষণার পর সাথে সাথে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ দিতে হবে। তালাকের নোটিশের একটি কপি স্ত্রীকে ও প্রদান করতে হবে। তারপর চেয়ারম্যান উক্ত নোটিশ পাবার ৩০ দিনের মাথায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপোষ-মীমাংসার লক্ষ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবেন।

সালিশী পরিষদ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করতে ব্যর্থ হলে চেয়ারম্যানের নিকট নোটিশ প্রদানের তারিখ হতে ৯০ দিন অতিবাহিত হবার পর তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। চেয়ারম্যান বলতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার চেয়ারম্যান, মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় চেয়ারম্যানের কাজ সম্পন্ন করার জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োজিত ব্যক্তিকে বুঝাবে। [রেফারেন্সঃ ধারা-২ (খ) মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১]

পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩ এর ৫ ধারা অনুযায়ী পারিবারিক আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য মামলা দায়ের করা যাবে। এই আইনের ৫ ধারাতে বলা আছে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর বিধানাবলী সাপেক্ষে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করা যাবে। তার মানে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান নোটিশের মাধ্যমেও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো যাবে।

(২) দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার (Restitution of Conjugal Rights):

স্বামী-স্ত্রী উভয়ই দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলা দায়ের করতে পারে। কোন বৈধ কারণ ছাড়া বিবাহের কোন পক্ষ যদি নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে অস্বীকার করে অথবা বৈবাহিক দায়িত্ব পালন করতে অবহেলা প্রদর্শন করে তাহলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ (aggrieved person) পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলা দায়ের করতে পারবে।

পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩ এর ২২ ধারা অনুযায়ী পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে হলে কোর্ট ফি ২০০ টাকা দিতে হবে। সে অনুযায়ী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলায় কোর্ট ২০০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলায় ৩০০ টাকা কোর্ট ফি দিতে হয়। কারণ এই ধরনের মামলা এক প্রকার ঘোষণা প্রকৃতির মামলা।

আদালত এই মর্মে ঘোষণা প্রদান করেন যে স্বামী যেহেতু স্ত্রীর প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছে সেহেতু স্ত্রী স্বামীর সাথে বসবাস করবে। আর আমরা জানি ঘোষণামূলক মামলার কোর্ট ফি ৩০০ টাকা।

(৩) দেনমোহর/মোহরানা (Dower):

দেনমোহর স্ত্রী মাফ করে দিলেও স্বামী স্ত্রীকে দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য। দেনমোহর প্রকৃতপক্ষে ঋণের সমতুল্য। স্বামীর মৃত্যুতে দেনমোহর অনাদায়ের স্ত্রীর অধিকার রহিত হয় না। স্বামী জীবিত থাকা অবস্হায় স্ত্রীর মৃত্যু হলে স্ত্রীর ছেলেমেয়ে ঐ দেনমোহর পিতার নিকট থেকে আদায় করে নিতে পারবেন। তবে সেটা স্ত্রীর মৃত্যুর ৩ বছরের মধ্যে আদায় করতে হবে।

(৪) ভরণপোষণ (Maintenance):

১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের ২(খ) ধারা অনুযায়ী স্বামী ২ বছর যাবত স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে অবহেলা করলে অথবা ২ বছর যাবত স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা করতে পারবে।

একইভাবে স্বামীকে ভরণপোষণ প্রদানে বাধ্য করতে পারবে। একজন পুরুষ তার স্ত্রীর পাশাপাশি সন্তানকেও ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। ছেলে সন্তানকে বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান হলে বিবাহের আগ পর্যন্ত ভরণপোষণ দিতে হবে।

পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ এর ধারা ৩ অনুযায়ী প্রত্যেক সন্তান তার পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করবে। পিতা-মাতার ভরনপোষণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ এর ৫ ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ১ লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। উক্ত অর্থদন্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস কারাদন্ডে দন্ডিত হবে।

(৫) শিশু সন্তানের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান (Guardianship and Custody of Childern):

পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩ এর ২৪ ধারা অনুযায়ী শিশু সন্তানের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালত জেলা জজ আদালত হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে পারিবারিক আদালত কর্তৃক কোন আদেশ সম্পর্কে জেলা জজ আদালতে আপীল দায়ের করা হবে।

১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ প্রণয়নের পূর্বে বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার ইত্যাদি মামলা দেওয়ানী আদালতে দায়ের করা হত। পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই সকল মামলা পারিবারিক আদালতে দায়ের করা হয়।

পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩ এর গেজেট প্রকাশের সাথে সাথে “পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫” রহিত হয়েছে।

(৬) পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩: যা কিছু নতুন

ক। নতুন আইন অনুযায়ী- সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদার ১(এক) জন বিচারক সমন্বয়ে পারিবারিক আদালত গঠিত হবে। ১৯৮৫ সালের আইনে শুধু সহকারী জজ এর কথা উল্লেখ ছিলো।

খ। ১৯৮৫ সালের আইন অনুযায়ী পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার যেমন ৫ বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিলো নতুন আইনেও একই রয়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, ভরণপোষণ এবং শিশু সন্তানদের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান- এই ৫টি বিষয়ের বিচার করার এখতিয়ার পারিবারিক আদালতের রয়েছে।

গ। ১৯৮৫ সালের আইন অনুযায়ী আরজি ও জবাব সংশোধনের সুযোগ ছিলো না। নতুন আইনের ৯ ধারায় এই সুযোগ রাখা হয়েছে।

ঘ। সাক্ষ্য লিপিবদ্ধকরণ সংক্রান্ত বিধান অর্থাৎ ১৩ ধারা অনেকটা স্পষ্ট করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে এই ধারায়। এফিডেভিটের মাধ্যমে জবানবন্দী গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

ঙ। দেনমোহরের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার বা তার কম টাকার ডিক্রী হলে আপীল করা যাবে না।

চ। নতুন আইনে সকল প্রকার পারিবারিক মামলার কোর্ট ফি নির্ধারণ করা হয়েছে- ২০০ টাকা।

সর্বোপরি নতুন পারিবারিক আদালত আইনে সকল বিষয় স্পষ্ট এবং অনেকটা যুগোপযোগী করা হয়েছে।

বিঃদ্রঃ পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩ এর গেজেট প্রকাশিত হয়েছে- ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং তারিখে।

আমি সর্বশেষ সংশোধনী পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩ এর আলোকে পারিবারিক আদালতের গঠন ও পারিবারিক বিষয়ে প্রতিকারের উপর একটা সাজানো আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। তা থেকে আপনারা কিছুটা উপকৃত হলেও আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। ধন্যবাদ সবাইকে।

লেখক: মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, সিলেট।